পিতার রক্তস্নাত মাটিতে যেদিন ফিরে এসেছিলেন তিনি
আমির হোসেন আমু
১৭ মে ২০২৩ ১৬:১১
১৭ মে ২০২৩ ১৬:১১
স্বাধীনতাবিরোধী চক্র বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট। ভয়াল সেই বছরের ১২ই মার্চ শেখ হাসিনা তার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার সাথে তার ছোট বোন শেখ রেহানা এবং ছেলে জয় ও মেয়ে ও পুতুলকে নিয়ে পশ্চিম জার্মানীতে যান। জার্মানীতে থাকার কারনেই তারা প্রাণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে এই দেশের মানুষের বুকের উপর সামরিকতন্ত্র জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছিল। এই সামরিকতন্ত্র মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মূল্যবোধকে হত্যা করে সংবিধানের চার মূলনীতি ফেলে দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা পুনঃপ্রবর্তন করেছিল।
এই অপশক্তি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকুরী দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকভাব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নব্য পকিস্তান সৃষ্টির প্রক্রিয়া চালু করছিল। এ সময় দেশে চলছিল দল ভাঙ্গার রাজনীতি। যা থেকে আওয়ামীলীগও রেহাই পায়নি। রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরিত্র হনন ছিল সহজ, জিয়াউর রহমান ঘোষিত ‘I Shall Make Politics difficult for the Politicians’ এর মতো বিরাজনীতিকরণের হুঙ্কার। হুন্ডা-গুন্ডা-ষ্টেনগানের মাধ্যমে ভোট ব্যবস্থা বিধ্বস্ত ও গনতন্ত্র হত্যা, জেল, জুলুম, গুম, হত্যা, নির্যাতননে মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে উঠেছিল অতিষ্ঠ।
তখন দেশের বিরাজমান এই পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ই ফেব্রুয়ারী আওয়ামীলীগ কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ই ফেব্রুয়ারী সন্ধায় আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ও বিভিন্ন জেলার সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক সমন্বয়ে সাবজেক্ট কমিটি মিটিং শুরু হলে আব্দুল মালেক উকিল, এম. কোরবান আলী, আব্দুস সামাদ আজাদ ও ড. কামাল হোসেনের নাম সভাপতি পদে প্রস্তাব হয়। তখন হাউজ থেকে তাদেরকে সিদ্বান্ত নেওয়ার জন্য বলা হয়। এই চারজন ভিতরের কক্ষে বসে কিছুক্ষণ আলোচনা করে শেখ হাসিনাকে সভাপতি করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আসেন এবং উপস্থিতিকে জানান। এরপর সরাসরি ইডেন হোটেলের কাউন্সিলে মালেক উকিল শেখ হাসিনার নাম ঘোষনার সাথে সাথে আকাশ-বাতাসে কাঁপিয়ে স্লোগান ওঠে ‘জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধু’। ওই বৈঠকেই সর্বসম্মতভাবে শেখ হাসিনাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
১৯৮১ সালের ১৭ই মে তিনি পিতৃ-মাতৃহীন স্নেহের ভাই রাসেলসহ ভাইদের হারিয়ে স্বজনহারা বুকভরা বেদনা নিয়ে ঢাকায় অবতরন করেন। সে সময়ে ৬৫-৭০ মাইল বেগের ঝড় ঝঞ্জা, প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাকে স্বাগত জানায়। মনে হচ্ছিল মানুষ তাদের হারিয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্খায় ছুটে এসেছে। বিমানবন্দর থেকে শেরে বাংলা নগরে ঝড়-ঝঞ্জার মধ্যে বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় তার সম্বর্ধনা সভায় উপস্থিত হয়ে তিনি জনতার উদেশ্যে বলেন, খুনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা কেউ জনগনের কোনও কল্যাণ করতে পারে না। এই সভায় শেখ হাসিনা জনগনের কাছে বিচার দাবি করেন। তিনি বলেন, যেদিন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে, বঙ্গবন্ধুর ২য় বিপ্লবের কর্মসূচী বাস্তবায়ন হবে সেদিনই শোষনমুক্ত সমাজ, শোষনহীন গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। আর এর মধ্য দিয়ে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা হবে। এই সভায় মধ্যেই সংগ্রামের ঘোষণা দিয়ে সকল ভেদাভেদ ভুলে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহব্বান জানান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমি নেতা নই, সাধারন মেয়ে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার একজন কর্মী। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য আপনাদের নিয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাব। এই সংগ্রামে জীবন দিতে আমি প্রস্তুত।’
বঙ্গবন্ধু-কন্যা দেশে এসে আন্দোলন ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্বৈরশাসনের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করেন। এরপর গনতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামের বাঁকে বাঁকে ২০০৪ সালের ২১শে আগষ্ট ন্যাক্কারজনক গ্রেনেড হামলাসহ ২১ বার তার প্রাননাশের চেষ্টা করা হয়। জীবনকে তুচ্ছজ্ঞান করে বঙ্গবন্ধুর মতো অকুতোভয় নেতৃত্ব দিয়ে তিনি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন অবিরত। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, মূল্যবোধ হত্যা করা হয়েছিলো তা পুনঃপ্রতিষ্ঠাসহ সংবিধানে জাতীয় চার মূলনীতি পুনঃস্থাপন করার সংগ্রামে তিনি অবিরত এক যোদ্ধা। যে ইন্ডেমেন্টারি বিলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিল তা তুলে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করেছেন তিনি। যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার অনুষ্ঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে পাপ মুক্ত করেছেন। এককথায় তার নেতৃত্বেই আমরা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ করে এই অর্জন করেছি।
আজ শেখ হাসিনার নির্ভীক, তেজস্বী ও দুরদর্শি নেতৃত্বের এবং সফল রাষ্ট্রনায়কোচিত সিদ্ধান্ত ও পরিচালনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার বাস্তব প্রতিফলন দেখিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ নির্মাতা ও উন্নয়নের কান্ডারী। উন্নত, সমৃদ্ধ, মর্যাদাশীল বাংলাদেশ নির্মানের রুপকার।
শেখ হাসিনার দুরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ স্বল্পোন্নোত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। দেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বে পদ্মা বহুমুখি সেতু প্রকল্প, কর্নফুলী নদীর তলদেশে সড়ক টানেল নির্মান, ঢাকার মেট্রোরেল, দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেল, রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতার বাড়ি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প, পায়রা বন্দর, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্র বন্দরসহ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে।
শেখ হাসিনার সফল রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্য দিয়ে তিনি খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র বিমোচন, শিশু ও মাতৃ-মৃত্যুর হার হ্রাস, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার, বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান, শিক্ষানীতি প্রনয়ণ, নারীর ক্ষমতায়ন, গনতন্ত্র, শান্তি, জঙ্গী দমন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার মাধ্যমে তিনি বহু মর্যাদাসম্পন্ন আর্ন্তজাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন। ২১শে ফেব্রুয়ারী আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা হিসাবে স্বীকৃতির মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতিকে গৌরবান্বিত করেছেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বে মর্যাদার নতুন মাত্রা দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি আজ বিশ্বে একজন নন্দিত সফল রাষ্ট্রনায়ক। তিনি সৎ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বিশ্বে তৃতীয় স্থানের অধিকারী হয়েছেন। বৈশ্বিক মহামারি করোনা মোকাবিলায় শেখ হাসিনার সফলতা জাতিসংঘ, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বসসহ সারাবিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। তার ঘোষিত ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশে রুপান্তরিত হবে বাংলাদেশ। এই দিনে জননেত্রীর দীর্ঘায়ু কামনা করি।
লেখক: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য, কেন্দ্রীয় ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র
সারাবাংলা/এসবিডিই
আমির হোসেন আমু পিতার রক্তস্নাত মাটিতে যেদিন ফিরে এসেছিলেন তিনি মত-দ্বিমত