নাস ডেইলির ব্রেকাপ; পুরুষতন্ত্রের কাছে প্রেমের পরাজয়
২৪ মে ২০২৩ ১৭:২২
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিখ্যাত কন্টেন্ট ক্রিয়েটর নাস ডেইলি ও তার গার্লফ্রেন্ড/পার্টনার অ্যালাইন তাদের ছয় বছরের সম্পর্কের ইতি টেনেছেন অনস্ক্রিন এক ঘোষণার মাধ্যমে। আরব বংশোদ্ভূত ইসরায়েলি নাগরিক নুসায়র ইয়াসিন নাস ডেইলি নামে নেট দুনিয়ার সবার কাছে অত্যন্ত পরিচিত মুখ। বাংলাদেশ নিয়েও তার একটি ভ্লগ খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অনেক কঠিন সময় পার করে তবেই সে জীবনে সফলতার মুখ দেখতে পেয়েছিল বলেই জানা যায়। জীবনের প্রয়োজনে সে-ও একজন জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়; যার নাম অ্যালাইন। নাস অ্যালাইনের সখ্যতা গড়ে উঠেছিলো কাজের সূত্রেই। একটা সময় নাস ও অ্যালাইন একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠেন। দু’জনে একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। ঘুরে বেড়ান দেশ থেকে দেশান্তরে। অসম্ভব প্রাণ চঞ্চলতায় মুখর দু’জনের একইসঙ্গে বানানো ভ্লগগুলো মিলিয়ন মিলিয়ন ভিউ হয়। বিশ্বব্যাপী দু’জনেই বেশ সুনাম কুড়ান।
গতকাল ঠিক এমনই একটি ভিডিও এলো সামনে। দু’জন পাশাপাশি বসা। গম্ভীর মুখে কিছু বলা শুরু করলো। ভাবছিলাম হয়তো নতুন কোন শুরু, নতুন কোন বিষয়। কিন্তু নাহ! এবার জীবনের অত্যন্ত কঠিন একটি মুহূর্তের সামনাসামনি দু’জন। কথা বলতে বলতেই দুজনে আবেগিও হয়ে পড়ছিল। এমন চঞ্চলতায় ভরা দু’টি জীবনে হঠাৎ কী এমন ঝড় এলো যে আজ তাদেরকে একসাথে ভিডিও করে সবার সাথে কান্নার ঘটনা শেয়ার করতে হলো?
খুব মনোযোগ দিয়ে তাদের কথাগুলো শুনছিলাম। নুসায়র ইয়াসিন বা নাস নামে পরিচিত এই ছেলেটাকে আমার ভালো লাগে তার এনার্জি ও এনথুজিয়াজমের জন্য। অ্যালাইনের সঙ্গে তার ছয় বছরের সম্পর্ক। বেশ চলছিল তাদের। অন্তত বাইরের দুনিয়া তেমনই দেখছিল। আসলেই কি চলছিল, নাকি চালানোর চেষ্টা ছিল সেগুলো? ভিডিও দেখে জানলাম, ৬ বছর পর এসে তারা উপলব্ধি করেছে যে তারা আসলে দু’জন দুইপথের ভিন্ন মানুষ। যে আবেগ দিয়ে দুজন কাছে এসেছিল, ভালোবেসেছিল বা একসঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সেই আবেগের সুতাটি ক্ষীণ হতে হতে শেষ পর্যন্ত ছিঁড়েই গেল। তাদের প্রায়োরিটি এক জায়গায় আসেনি। মেয়েটার অভিযোগ ছিল ছেলেটা তাকে আর প্রায়োরিটি দিচ্ছে না যতটা সে ডিজার্ভ করে আবার ছেলেটাও টের পাচ্ছিল যে তারা ধীরে ধীরে দুইজন দুইদিকে চলে যাচ্ছে। তাদের কথা শুনে যতটা বোঝা গেছে সম্পর্কের সূত্রটা পাল্টাতে থাকলেও তারা নিজেদের মুখোমুখি হয়নি এতদিন। হয়তো বা হয়েছিল। কিন্তু ভিডিওতে তারা বিষয়টি স্পষ্ট করেনি। একটা সময় এসে দুইজনেই সিদ্ধান্ত নিল তারা কেউ কারও চাহিদা পূরণের জায়গায় আর নেই।
পর্দার বা ভার্চুয়াল জগতের মানুষ হলেও গোটা ঘটনার মধ্যে আমি নারী ও পুরুষের সম্পর্কের যে ডাইমেনশন এমনকি আমাদের নিজেদের জীবনেরও মিল খুঁজে পেলাম। এভাবেই তো একটা সময় কাছের মানুষটি দূরে যেতে থাকে। পাশে থেকেও কখন যেন আমরা দূরের হয়ে যাই। পার্থক্য হচ্ছে আমরা বুঝতে পারার পরেও ধরে রাখার জন্য নিজের উপর অত্যাচার করি কিন্তু তারা দু’জন সেটা করেনি। তবে এটুকু বলা যায় যে মেয়েটি চেষ্টা করেছিল। তার বক্তব্যেই বিষয়টা পরিষ্কার। মেয়েটা তার দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছিল কারণ সে নিজেকে পুরোনো অবস্থা থেকে সরাতে পারেনি। কিন্তু অন্যদিকে ছেলেটি তার সরে আসার বিষয়টি অবগত করেনি মেয়েটিকে। দু’জন মানুষ যখন নিজেদের সম সিদ্ধান্তে কাছে আসে তখন দূরে যাওয়ার সিদ্ধান্তটাও কিন্তু জানানোর দায়িত্ব থাকা উচিত। হুট করে একদিন যখন জানানো হয় তখন পাশের মানুষটির প্রস্তুতি সেভাবে থাকে কি-না সেই অনুভূতিটুকু যদি নাই থাকে তাহলে আর ভালোবাসার সম্পর্ক কেন?
এমন ঘটনা আমরা আমাদের সবার জীবনে দেখতে পাই। দায়িত্বের জায়গাটুকু নিতে নারাজ থাকি। সম্পর্ক চাইলেই ভেঙে দেওয়া সম্ভব কিন্তু ভাঙ্গার পরেও যেন কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের তীর না থাকে সেটিও কি ভাবা উচিত না?
নাস ডেইলি হয়তো কষ্টকর জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই তার জীবনে প্রায়োরিটি ঠিক করেছে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। সেজন্যই সে সঙ্গীর আবেগের চাইতে তার প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েছে অনেক বেশি। এখন বলাই যায় যে প্রতিষ্ঠা পেতে চাওয়া কি অন্যায়? নাহ! মোটেও অন্যায় নয়। বরং আমার অভিলাস বা প্রায়োরিটির সঙ্গে যদি আমার পাশের মানুষটিকেও সারথি করে নিতে পারি তাতে বরং সামর্থ্য অনেক বাড়ত। এই জায়গায় আমাকে নাসকে অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক মনে হয়েছে। সে কেবল নিজের দিকটাই ভেবেছে অথবা হয়তো সে অ্যানকে কেবল একজন নারী হিসেবেই বিবেচনা করেছে, সেজন্যই তাকে তার পেশার ক্ষেত্রে সমব্যাথি করতে পারেনি। এটা হয়। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক ইগো জীবনসঙ্গীকে পেশার জায়গায় সমান ভাবতে দেয় না।
খেয়াল করলে বোঝা যায় পুরুষ দিন শেষে পুরুষই থাকে তারা তাদের প্রায়োরিটি থেকে এক পা নামতে রাজি না। আগেও বলেছি, পুরুষ প্রাকৃতিকভাবেই খোলসের মধ্যে বেড়ে উঠে অর্থাৎ তাদের একটা আলাদা জগত তৈরি করে ফেলে, যেখানে তারা নারীকে কেবল একজন ইমোশনাল পার্টনারই ভাবতে পারে আর কিছু না। তারা নারীকে দুর্বল করে দেয়, কিন্তু তার দুর্বলতাকে কাটাতে সাহায্যের দায়িত্বটুকু নিতে রাজি হয় না। আবার মেয়েরাও আসলে তার প্রিয় পুরুষের কাছে প্রায়োরিটিতেই থাকতে চায়। ধন সম্পদের চাইতেও এই সম্পর্কের প্রায়োরিটিকেই মেয়েরা হিসাব করে বেশি। অথচ এই জায়গাতেই দু’জন মানুষ আলাদা হয়ে যায়।
আসলেই তাই। নারী পুরুষের সম্পর্কের রসায়নটাই এতো অদ্ভূত রকমের জটিল যে এটাকে কোনো হিসাবের খাতাতে আটকে রাখতে যাওয়া বোকামি। এখানে দু’টি মানুষকে বসে হিসাবটা সবসময় রিফ্রেশ দিতে হয়। পরিবর্তনের হাওয়াটা আসতে শুরু করা মাত্রই বসে অত্যন্ত লজিক্যালি বিষয়টাকে ডিল করতে হয়। ‘ডিফারেন্স অব অপনিয়নগুলোকে’ উপেক্ষা করে একসাথে চলা যায় না। পার্থক্যের মাত্রা বাড়তে থাকলেই কেবল একজন আরেকজনকে আগানোর পথে বাধা মনে করতে থাকে। কিন্তু দুজনেই যদি সমান প্রায়োরিটিতে থাকে তাহলে সমস্যা অল্প থাকতেই আলোচনায় বসবে এবং সিদ্ধান্তের পথে হাঁটবে। দিনশেষে সম্পর্কটা ম্যাটার করে কিনা ভাবা উচিত। সেখানে যদি বোঝা যায় যে আগের জায়গায় আর নেই সম্পর্কটা, তাহলেই মনে হয় সরে আসা উচিত। অশ্রদ্ধা নিয়ে ভালোবাসা হয় না। তাই যেকোনো সম্পর্ক অশ্রদ্ধার জায়গায় চলে যাওয়ার আগেই আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো।
নাস বলছে, সে ইমোশনাল চাহিদা পূরণে অক্ষম, মানে সে আর প্রেম চায় না অথচ মেয়েটা বলছে সে ১০০% নিশ্চিত যে ছেলেটা সক্ষম কিন্তু সে চাইছে না। এটা অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য যে অবশ্যই ছেলেটার মধ্যে সেই পরিমাণ আবেগের উপস্থিতি ছিলো বলেই মেয়েটাকে সে আকৃষ্ট করতে পেরেছে, কিন্তু বছরের পর বছর থাকতে থাকতে সম্পর্কের মাঝে আর আকর্ষণ ছিল না। ছেলেটা এখন মনে করছে তার আবেগী ক্ষমতা নাই। পুরুষ নিজের প্রয়োজনে হারতেও রাজি। নাস বলতে চাইছে, সে প্রেমিক পুরুষ নয় তাহলে ৬ বছর আগের নাস কে ছিল যখন সে একজন নারীর মাঝে শান্তি খুঁজতে গিয়েছিলো? আসলেই প্রায়োরিটি ম্যাটারস।
আমাদের প্রতিটা মানুষের জীবনের কাহিনী এক। পুরুষরা কখনোই নিজের জায়গাটাকে অ্যানালাইসিস করতে চায় না কারণ প্রকৃতি তাদেরকে শিখিয়েছে তারা সুপিরিয়র এবং তার কাছে তার নিজের জন্য প্রায়োরিটি সেট করতে হবে নিজের স্বার্থ অনুযায়ী। মানে যখন যেটা তার জন্য সুবিধাজনক। অন্যদিকে যে আরেকজন মানুষেরও প্রায়োরিটি থাকতে পারে এবং সেই প্রায়োরিটিও যে পুরুষটির জীবনের সাথে যুক্ত এই ভাবনাটাকে তারা ডিজএলাউ করে দেয় এক নিমিষেই।
নারী চিরকাল নারীই থেকে গেলো। ভালোবাসার কাঙ্গালীপনায় নারীর কোন দেশ সীমানা থাকে না। মানে প্রকৃতি সকল নারীর অনুভূতিকে একই প্যাটার্নের করে পাঠিয়েছে। আর পুরুষ চিরকাল স্বার্থপরের মতো কেবল নিজেরটাই ভেবে যায় অথচ স্বীকার করবেনা বা দায়িত্ব নিতে নারাজ। ঠিক নাসের মত। সে আসলে আবেগের জায়গায় ইনভেস্ট করতে নারাজ আর নারী তো কেবল তার সঙ্গীর আবেগটাকেই ভালোবাসতে চায়।
নারী পুরুষের সম্পর্ক এক ভিন্ন ক্যালকুলেশন। এ এক কঠিন রহস্য। এ এক অমিমাংসিত কাব্যের পংক্তি, মহাকাব্যের রেখাপাত। সৃষ্টির এক অপার রহস্য লুকিয়ে আছে এই প্রেমের খেলাঘরে। মিছেই আমরা কেঁদে মরি। যা হবার তা হবেই, ঘটবেই। বিচ্ছেদের সুতার বুনন শুরু হলে সেখানে কোন উলই বুননের কাজ করবে না।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
নাস ডেইলির ব্রেকাপ; পুরুষতন্ত্রের কাছে প্রেমের পরাজয় মত-দ্বিমত লীনা পারভীন