শুভ সংকেত নয়
২৫ মে ২০২৩ ২০:৪৭
বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের স্বার্থে এক নতুন ভিসা নীতির কথা ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্টনি ব্লিংকেন সম্প্রতি এ কথা ঘোষণা করেন। এই নীতির আওতায় যে কোন বাংলাদেশি ব্যক্তি যদি সেদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের প্রক্রিয়া ব্যাহত করার জন্য দায়ী হন বা এরকম চেষ্টা করেছেন বলে প্রতীয়মান হয় – তাহলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেয়ার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এর আওতায় পড়বেন বর্তমান এবং সাবেক বাংলাদেশি কর্মকর্তা, সরকার-সমর্থক ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যবৃন্দ, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা, বিচারবিভাগ ও নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সদস্যরা।
মার্কিন বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, যে সব কর্মকাণ্ড গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বানচালের আওতায় পড়বে তার মধ্যে আছে – ভোট কারচুপি, ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন, শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করার অধিকার প্রয়োগ করা থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার জন্য সহিংসতাকে কাজে লাগানো, এবং এমন কোন পদক্ষেপ – যার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ বা সংবাদমাধ্যমকে তাদের মত প্রচার থেকে বিরত রাখা। বাংলাদেশে অবাধ-সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনকে সমর্থন দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন এ্যান্ড ন্যাশনালিটি এ্যাক্ট-এর ২১২(এ)(৩)(সি)(৩সি) ধারা বলে এই নতুন নীতি ঘোষণা করা হয়েছে।
মি. ব্লিংকেন বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সবার দায়িত্ব, এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেবার জন্য যারা কাজ করছেন তাদের সবার প্রতি সমর্থন জানাতে তিনি এই নীতি ঘোষণা করছেন। ওয়াশিংটন সময় বুধবার (২৪ মে) দুপুরবেলা মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার বাংলাদেশীদের ভিসা সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু মন্তব্য করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রশ্নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র তার সমর্থনকে শেয়ার করছে। তিনি বলেন, বুধবার যে নীতিমালা ঘোষণা করা হয়েছে, তা সেই প্রচেষ্টাকে সমর্থন করার লক্ষ্য নিয়েই তৈরি করা হয়েছে। একই সাথে এর লক্ষ্য, বাংলাদেশের জনগণ যাতে একটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন এবং তাদের নেতা বেছে নিতে পারেন। “সবশেষে আমি বলবো, বাংলাদেশে যখন গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে এমন কিছু কাজ আমরা দেখতে পেয়েছি তখন বন্ধু হিসাবে আমরা আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছি।“
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশের বিবাদমান রাজনৈতিক দলগুলির চলমান উত্তপ্ত পরিবেশের মধ্যে এই ভিসা নীতি নতুন আলোচনার সুত্রপাত করলো। মার্কিন এই ভিসা নীতি ঘোষণায় বিরোধী দল গুলির মধ্যে বেশ কিছুটা উৎফুল্ল ভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারি দলের মন্ত্রী নেতারা সতর্কতামুলক বক্তব্য দিয়েছেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন,মার্কিন সরকারের নতুন ভিসা নীতিতে বাংলাদেশ সরকার “বিচলিত নয়,” কারণ সে দেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সরকার ‘প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।‘ মার্কিন সরকারের ঘোষণার পর বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে দেয়া এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় মি. আলম বলেন, “এটি কোন নিষেধাজ্ঞা নয়। বিএনপির উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত কারণ নির্বাচনের আগে বা নির্বাচন চলাকালীন সহিংসতা ঘটলে [নীতিমালার আওতায়] ভিসা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ কার্যকর হবে।” একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও।
আজকে বেশ কিছুদিন যাবৎ বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন হস্তক্ষেপের কথা বেশ জোরেশোরে শোনা যাচ্ছে। বিশেষ করে র্যাবের বিরুদ্ধে বছর দেড়েক আগে দেয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের পর থেকে এ আলোচনা প্রবল ভাবে হচ্ছে। এলিট ফোর্স র্যাবের উপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দেয়ার পর থেকে সরকারও সতর্ক পথ অবলম্বন করে চলছে, এবং এই নিষেধাজ্ঞা নিয়ে পাল্টা পালটি বক্তব্য আসছে। এসব বিষয়ে সরকার যে কিছুটা উদ্বিগ্ন তা অস্বীকার করা যাবে না। এই নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা নীতি এসব যখন চলছে দেশে তার ৬/৭ মাস পরেই জাতীয় নির্বাচন। আর গুরুত্বপূর্ণ পাচ সিটিতে এখন নির্বাচন চলমান। অন্যদিকে নির্বাচন ও অন্যান্য ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সাথে বর্তমান সরকারের খুব ভাল সম্পর্ক যাচ্ছে না বলেই মনে করছে বিরোধী পক্ষ। তারা মনে করছে আগামি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বিস্তার করবে এবং তারই অংশ হিসেবে এই ভিসা নীতি। যদিও এই ভিসা নীতিতে বিরোধীদের কথাও উল্লেখ আছে তবুও তারা মনে করছে এটা সরকারের প্রতি একটা সংকেত।
এই যে নির্বাচনসহ নানা ইস্যুতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ যে একটি দেশের জন্য শুভ সংকেত না তা কারো বুঝতে বাকি থাকার কথা না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তারা যেকোন বিষয়ে কোন স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে আগায় না, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে তারা চলে। মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন প্রশাসনের ভূমিকা যাই থাক না কেন পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিল এবং বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবেই এ পর্যন্ত চলে আসছে। আমাদের দেশের কোন ব্যক্তি বা দল যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী দেশকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে বা সহযোগিতা করে সেটা দেশের জন্য কোন শুভ লক্ষণ নয়। এবং তার প্রেক্ষিতে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যখন তখন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করা কোনভাবেই শুভ সংকেত নয়। যদিও এই ভিসা নীতি মার্কিন সরকার ঘোষণা করে বলেছেন বাংলাদেশ সরকার যে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনের কথা বলেছে তার সমর্থনেই এই ভিসা নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। সরকার যদি সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারে এতে যদি কোন বাধা বিঘ্নের সৃষ্টি না হয় তাহলে এই ভিসা নীতি তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ হবে না। এই ভিসা নীতি যে এক ধরনের চাপ এতে কোন সন্দেহ নেই। আবার বিরোধী দলও যদি নির্বাচন বানচালের চেস্টা করে তাদের ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য। অর্থাৎ এই ভিসা-নীতির আওতায় বাংলাদেশের সমগ্র জনগণই পরলো। কারন যে কোন ব্যক্তিকে এই অজুহাতে ভিসা দেওয়া বন্ধ করতে পারে বা ভিসা বাতিল করতে পারে।
এই ভিসা নীতির পর বিরোধীদল গুলিও এই সরকারের অধীনে নির্বাচন করার একটা চাপে থাকতে পারে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই সরকারকেই অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান আয়োজনের তাগিদ দিয়ে বেড়াচ্ছে। তারা চাচ্ছে বাংলাদেশে একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। ক্ষমতাসীন দলও সব সময় বলছে এই সরকারের অধীনেই অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সরকারের এই কথাতে বিশ্বাস রাখতে পারছে না বিরোধীদল। তারা বলছে যে এই সরকারের অধীনে কোনভাবেই সুষ্ঠু আবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন একটি নিরপেক্ষ সরকার দরকার। যা কোনক্রমেই মানবে না বা মানছে না ক্ষমতাসীনরা। কোন সন্দেহ নাই মার্কিন এই ভিসা নীতিতে সরকার অনেকটাই চাপে থাকবে। আবার বিরোধী দলও চাপে থাকবে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে। এখন দেশবাসীর চাওয়া বিদেশি শক্তি বা পরাশক্তিরা কি বলল সেটা বড় কথা নয় দেশের মানুষ যাতে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে। একটি সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করবে দেশের সরকার এ দেশের প্রশাসন এবং এদেশের বিরোধী দল এ দেশের সরকারি দল। যেখানে কোন দেশের মোড়লগিরি বা দাদাগিরি চলবে না। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ তার নিজস্ব স্বকীয়তায় এগিয়ে চলবে। কারণ দেশের অভ্যান্তরীন বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ কোন দেশের জন্য শুভ সংকেত নয় এটা প্রমাণিত। তাই দেশবাসীর প্রত্যাশা আগামী নির্বাচন হোক অবাধ,সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ এবং তাতে সব দল অংশগ্রহণ করুক। কারন দেশটা আমাদের,বিদেশিদের না।
লেখক: কলামিস্ট,রাজনীতিক
সারাবাংলা/এজেডএস