মার্কিন ভিসানীতি: অতি কূটনীতি
২৬ মে ২০২৩ ১৬:২১
নব্বইর দশক জুড়ে রাজধানীর বিভিন্ন-দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে দেখা যেত ‘ভিসামুক্ত বিশ্ব চাই’ স্লোগান। বিশ্বের কিছু পাশাপাশি এবং দূরদেশে ভিসা ছাড়া যাতায়াতের নজির দৃষ্টে আন্দোলনটি জমানোর চেষ্টা হয়েছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ব্যতিব্যস্ততায় মানুষের এদিকে দৃষ্টি পড়েনি। অথবা এ আন্দোলনের মাজেজাও তখন মানুষকে ঠিকভাবে বোঝানো হয়নি। এতে দেশে মাঝেমধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচিত হলেও জমেনি। প্রবাসে কিছু সাড়া মিললেও বেশিদূর এগোয়নি।
মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানুষে মানুষে ঘনিষ্টতা বাড়ানোর তাগিদ থাকলেও ভিসামুক্ত যাতায়াতে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ওয়াজ দৃষ্টে আওয়াজ নেই। এ ক্ষেত্রে বরং ইহুদি-খ্রিস্টান দেশগুলোর উদারতার দৃষ্টান্ত বেশি। ইউরোপীয় অন্তত ২৬ টি দেশে ভিসামুক্ত যাতায়াত রয়েছে। দেশগুলোর নাগরিকদের এক দেশ থেকে আরেক দেশে যেতে কেবল ভিসা নয়, বাড়তি তেমন অনুমতিও দরকার হয় না। সেই বিবেচনায় সৌদী আরব, কুয়েত, দুবাই, ইরাক, ইরান, বাহরাইন, কাতার, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মধ্যে এমন ভ্রাতৃত্ববোধের ভিসামুক্ত যাতায়াত একটি স্বাভাবিক প্রত্যাশা। ইসলামের ভ্রাতৃত্বের শিক্ষার সঙ্গেও প্রত্যাশিটি বেশ মানানসই। কিন্তু, বাস্তবটা সেরকম নয়। যদিও মাঝেমধ্যে বাংলাদেশিদের নানান দেশে ভিসা ছাড়া যাতায়াতের সুযোগের সুখবর মেলে। এ নিয়ে তখন আলোচনা জমে। মানুষের প্রত্যাশার ডানা ছড়ে।
এ ধরনের খোশ মজোজের মঝে ঘটে উল্টাটা। সামনে আসে বাংলাদেশিদের ভিসা নিয়ে বিভিন্ন দেশের কড়াকড়ির খবর। হালনাগাদে কুখবর হয়ে এসেছে কেবল আমাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতির দুঃখজনক দুঃসংবাদ। সেটার সঙ্গে জুড়িয়ে দেয়া হয়েছে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়আসয়। সেখানে জুড়ে দেয়া হয়েছে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রতিবন্ধকতায় যুক্তদের যুক্তরাষ্ট্রে ভিসা না দেয়ার নীতি।
এই কুখবরটিকে ভাষার প্যাঁচে উল্টা করে লিখলে সুখবর হয়ে যায়। ‘বাংলাদেশে যারা সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দেবে তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি’কে এভাবেও রেখা যায়- ‘বাংলাদেশে যারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়, তাদের সমর্থনে নতুন ভিসা নীতি’। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এমন পজেটিভ ভাষাই উল্লেখ করেছেন। নতুন ভিসা নীতি সম্পর্কে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, যারা বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বান জানিয়েছে তাদের প্রত্যেকের প্রতি সমর্থন হিসেবে এই নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিশ্বের সুপার পাওয়ার এ দেশটির কাছে আমরা ভাষার মারপ্যাঁচের আইটেম। নিয়তি না কর্মফল? বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ঘোষিত এই ভিসা নীতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার পথে দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যে কোনো বাংলাদেশি নাগরিকের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করবে যুক্তরাষ্ট্র। স্বাভাবিকভাবেই এ নিয়ে কূটনৈতিক ভাষার প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন। তার মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ ভিসা নীতি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি সমর্থন করে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সরকার কোনো বাড়তি চাপে নেই এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক চমৎকার। এই ঘোষণার মাধ্যমে তিনি আশা প্রকাশ করেন, যেসব দল সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তারা সতর্ক থাকবে। এর একদিন আগে, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশ এসবে কেয়ার করে না। এতে মাথা ব্যথার কিছু নেই।
বাস্তব কঠিন সত্য হচ্ছে, এটি অবশ্যই কেয়ার করার বিষয়। মাথা ব্যথার বিষয়। মোটেই পল্টন বা ধুপখোলা মাঠে গরম বক্তৃতা দিয়ে হাত তালি পাওয়ার বিষয় নয়। যে কারণে দিন দুয়েকেই ভাষার কী তফাৎ! দেশের রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন মহলেও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতিতে কে লাভবান, কে ক্ষতিগ্রস্ত- এর নানা ব্যাখ্যা। বহু বিশ্লেষণ। নীতিটি কতোটা নিজের পক্ষে, কতোটা প্রতিপক্ষের বিপক্ষে- সেই বিশ্লেষণ বহুমুখী। তা বাঙালি বৈশিষ্ট্যেরও সাক্ষর। এখানে মহাকূটনীতিকে পথে-ঘাটে, গায়ে গায়ে ধাক্কা খাওয়া অবস্থা। যার মন যা চায় বলে দেন। আবার কথা বদলাতে একটুও সময় লাগে না। যদিও এসব ভিসা বিধিনিষেধ কার বা কাদের জন্য প্রযোজ্য হবে- তা বলা আছে স্পষ্ট করে। সেই বিষয়টাকে কেউ নিজের জন্য পরম আনন্দের, আর প্রতিপক্ষের জন্য মহাবিপদের ভেবে তৃপ্তির ঢেঁকুরে বায়ুদূষণ করে ছাড়ছেন।
বলার কোনো অপেক্ষা রাখে না যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এ নীতিটি ক্ষমতাসীনদের জন্য অপমানের। আবার অপমানের কথা স্বীকার করাও যাচ্ছে না। বরং সমর্থন জানিয়ে মনের কষ্ট লুকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিতে হচ্ছে কথার পাণ্ডিত্যে। আর বিরোধী মহলের জন্য খুশিতে বগল বাজানোর ঘটনা। কিন্তু, বিশ্বমানচিত্রের এ স্বাধীন দেশটির জন্য কি সম্মানের? কোথায় নিয়ে ঠেকানো হলো দেশটির জনগণকে। হোক বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করায় দায়ী বা জড়িতদের জন্য প্রযোজ্য এটি। বাংলাদেশের বর্তমান বা সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারের সমর্থক এবং বিরোধী দলীয় সদস্যরা এর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের ব্যক্তিদের নিকটতম পরিবারের সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকবে। মোটকথা, এই ভিসা বিধিনিষেধের নিশানা সরকার তথা বা আওয়ামী লীগের দিকেই বেশি। স্বাভাবিকভাবেই বিরোধীদল বিএনপির জন্য এটি বেহেস্তের মেওয়া পাওয়ার মতো। কিন্তু, এর আখেরাত কি ভেবে দেখেছেন? এখন কথার মার দিচ্ছেন বুলেটের মতো।
যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতির ভাষার তীর কতোদিকে যায় বা যেতে পারে, তা বিএনপির মতো দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা এবং ভবিষ্যতে আবার ক্ষমতায় ফেরার আশাবাদী দল বোঝে না-মানে না, মনে করার কোনো কারণ নেই। এখনই এই নীতিমালার আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে কারো ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়নি। তবে, ভেতরে-ভেতরে হাই-ভল্টেজ অ্যাকশন যাচ্ছে। পরিবার-স্বজন নিয়ে আচ্ছা রকমের যন্ত্রণায় পড়ে গেছেন অনেকে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন ঘরানার পাল্লা ভারি। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনতৈকি মিষ্টিমধুর ভাষায় বলেছেন, আমাদের ভীষন দরদি তারা। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একটি শক্তিশালী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারকে তারা স্বাগত জানান।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন তৃপ্তির চাকা আরেক দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করেছেন। কথাটি একটু ঘুরিয়ে বলেছেন, মার্কিন ভিসা নীতি কেবল সরকারি দলের জন্য নয়, তা বিরোধী দলের ওপরও বর্তাবে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ ভিসা নীতির ব্যাপারে সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে গেল ৩ মে। কিন্তু, তথ্য গোপন থেকেছে। দেশের মানুষ তা জেনেছে ২১-২২ দিন পর মার্কিন কর্তৃপক্ষের বরাতে। সেখানেও কূটনীতির ওপর কূটনীতি। এ সময়টা গুজব-গুঞ্জন চলছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে নতুন আরো স্যাংশন আসার বিষয়ে। স্যাংশন আসেনি। এসেছে নতুন ভিসা নীতির খবর। তেজ বিচারে সেটি স্যাংশনের মতো নয়। তবে বিরোধীদল মনে করে স্যাংশনের চেয়ে কমও নয়। তৃপ্তি পাওয়া দিয়ে কথা।
যুক্তরাষ্ট্রের এ ভিসা কূটনীতিকে বাংলাদেশে ভোটের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে নজিরবিহীন ঘোষণা বলে বর্ণনার একটি প্রবণতা চলছে। ঘোষণাটিতে নির্বাচনে বাধা প্রদানকারীদের মার্কিন ভিসা বন্ধের হুশিয়ারিকে যে যে ভাবে পারছেন ব্যাখ্যা করছেন। নিজে জিতছেন, অন্যকে হারাচ্ছেন। মনে রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রের এ নীতিটি কেবল একটি মাত্র দেশ বাংলাদেশের জন্য- সেই লজ্জা আমরা ভুলে যাচ্ছি। বুধবার বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি জে ব্লিংকেন ভিসা কড়াকড়ি সংক্রান্ত ঘোষণাটিতে ঈদ ঈদ ভাব লুকিয়ে রাখতে পারেননি অনেকে। ভিন্নরকম এ নিষেধাজ্ঞায় কী লজ্জা লুকানো- সেই বোধও হারিয়ে যাওয়া মহলের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে গত ক’দিন। ব্লিংকেনের টুইট বার্তা, স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ বিষয়ক নতুন ওই ভিসা নীতি একযোগে প্রচার হয়। এর উদ্দেশ্য-বিধেয় বুঝতে কূটনীতিক হওয়ার দরকার করে না।
কথার মারপ্যাঁচ না করলে এর সারসংক্ষেপ হচ্ছে- নতুন ভিসা নীতির আওতায় বাংলাদেশের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা, সরকার সমর্থক, বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা পড়বেন। সেই সঙ্গে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়া কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয় তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে ভোট জালিয়াতি, ভোটারদের ভীতি প্রদর্শন, জনগণকে স্বাধীনভাবে সভা-সমাবেশ ও শান্তিপূর্ণভাবে জমায়েত হওয়ার অধিকার থেকে বিরত রাখতে বল-প্রয়োগ বা সহিংসতা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কাছে এটি আনন্দের। তাদের বাঁধভাঙ্গা এ আনন্দ-স্বস্তি কতোটা বিকৃত, কতোটা কাঙ্খিত?- প্রশ্নটি আপাতত তোলাই থাক।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন
সারাবাংলা/এজেডএস