প্রফেসর ইউনুসের কর ফাঁকির মামলা প্রসঙ্গ
৭ জুন ২০২৩ ১৪:৪৬
গত ৩১শে মে, বাংলাদেশের হাইকোর্ট অধ্যাপক ডক্টর মোহাম্মদ ইউনুসের আয়কর ফাঁকির মামলা রায় প্রদান করে। হাইকোর্ট রায়ে ঘোষণা করেছে যে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক কর ফাঁকির মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এবং তাকে ট্যাক্স হিসাবে ১২কোটি টাকা দিতে হবে। আট বছর ধরে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার পর এই রায় এলো। অবশেষে, রায়টি অধ্যাপকের বিরুদ্ধে গিয়েছে এবং তিনি ১৯৯০ সালের উপহার কর আইন লঙ্ঘনের জন্য দোষী প্রমাণিত হয়েছেন।
পুরো সময়ে, ড. ইউনূস একটি বিচারাধীন বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় পর্যায়ে মিডিয়ার সহানুভূতি অর্জন করছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে, আসলে কী ঘটেছিল এবং কীভাবে ড. ইউনূস কর ফাঁকির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেন তা খোঁজা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
কর ফাঁকির মামলা
ডক্টর ইউনূস তার ব্যক্তিগত সম্পদ তার তিনটি অলাভজনক ট্রাস্টে পাঠালে বিষয়টি শুরু হয়। ২০১১-১২, ২০১২-১৩, এবং ২০১৩-১৪ কর বছরে, প্রফেসর ইউনূস ৭৬কোটি টাকা অনুদান দিয়েছিলেন। ট্রাস্ট তিনটি হলো, প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাস্ট, ইউনূস ফ্যামিলি ট্রাস্ট, এবং ইউনূস সেন্টার।
আয়কর বোর্ডের তথ্যানুসারে, ড. ইউনূস ২০১০-১১ সালে ৫৬কোটি টাকার ব্যক্তিগত সম্পদের মালিক ছিলেন এবং ১কোটি ৩৭ লক্ষ টাকা কর প্রদান করেন। ২০১১-১২ সালে, তিনি ১০কোটি টাকা আয় করেন এবং ১কোটি ৩৬ লক্ষ টাকার কর প্রদান করেছেন।
২০১১-১২, ২০১২-১৩, এবং ২০১৩-১৪ কর বছরে, তিনি উল্লিখিত ট্রাস্টগুলিতে ৭৬কোটি টাকা দান করেছিলেন। এই অনুদানের ফলে, তার আয়কর পরের করবছরে ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এই ধরনের অস্বাভাবিক হ্রাস জাতীয় রাজস্ব ব্যুরো (এনবিআর) এর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নিরীক্ষার পর, এনবিআর উপহার কর আইনে এসব উপহারের বিপরীতে ১৬ কোটি টাকা দাবি করে।
কিন্তু প্রফেসর তার নিজস্ব যুক্তি দেখিয়ে টাকা দিতে অস্বীকার করেন। তার আইনি যুক্তি ছিল যে তিনি এই অনুদানগুলি ‘মৃত্যুর ভয়ে দান’ করেছিলেন এবং তাই সেগুলি করযোগ্য নয়।
কিন্তু মজার বিষয় হল, ট্রাস্টগুলির দিকে লক্ষ্য করলে বোঝা যাত তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরাই এই ট্রাস্টগুলির ট্রাস্টি সদস্য। এই ট্রাস্টগুলির গঠনতন্ত্রও বেশ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করে। এই ট্রাস্টগুলির এমন বিধান রয়েছে যার জন্য প্রফেসর ইউনুস ও তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতে হবে ট্রাস্টের অর্থেই।
আবার, আরেকটি ধারায় তাকে তার নিজের মত করে ট্রাস্টের সম্পদ ব্যয় করার একমাত্র ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। সুতরাং, আপাতদৃষ্টিতেই মনে হয় এই ট্রাস্টের সম্পদ সম্পূর্ণরূপে তার নিয়ন্ত্রণে, এবং ভোগকারীও তিনি এবং তার পরিবার। সুতরাং, এটা স্পষ্ট যে তিনি আসলে কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য তার নিজের ট্রাস্টে ব্যক্তিগত সম্পত্তি স্থানান্তর করেছেন।
আইনী প্রক্রিয়া
একটি স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ রায় এলো। এনবিআরের ১৬কোটি টাকা করের দাবির পর, ড. ইউনূস অসম্মত হন এবং আইনি হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আপিল রেঞ্জ-৩-এ আপিল করেন। পরে আপিল রেঞ্জ-৩ থেকে আপিলটি খারিজ হয়ে গেলে তিনি এনবিআরের আপিল ট্রাইব্যুনালে আপিলও করেন।
তবে ট্রাইব্যুনালও তার আবেদন খারিজ করে দেয়। পরে তিনি এ বিষয়ে হাইকোর্টে তিনটি রেফারেন্স মামলা করেন। ২০২৩ সালে পুঙ্খানুপুংখ শুনানির পর, উচ্চ আদালত এখন তাকে ১৯৯০ সালের উপহার কর আইন লঙ্ঘনের জন্য দোষী ঘোষণা করেছে এবং তাকে ১২ কোটি টাকা কর প্রদানের নির্দেশ দিয়েছে।
পুরো প্রক্রিয়া চলাকালীন, ডঃ ইউনূস নিজেকে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার হিসাবে উপস্থিত করেছেন। তিনি তার খ্যাতিকে ব্যবহার করে একটি বিচারাধীন বিষয়ে গণমাধ্যম ও বৈশ্বিক পরিমন্ডলে সহানুভূতি উপভোগ করেছিলেন। কিন্তু মনে হচ্ছে স্বাধীন বিচার বিভাগ তাকে দোষীই সাব্যস্ত করছে বাধাবিপত্তি থাকলেও।
অনুদানের পেছনে অধ্যাপক ইউনূসের সন্দেহজনক উদ্দেশ্য ছিল বলেই মনে হয়। তিনি তার ব্যক্তিগত সম্পদকে নিজের এবং তার পরিবারের মালিকানাধীন এবং আধিপত্যপূর্ণ কিছু ট্রাস্টে স্থানান্তরের মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত সম্পদ হ্রাস করতে চেয়েছিলেন যাতে আয়কর না দিয়েই সেগুলি উপভোগ করা যায়। এটা আইনের চোখে সুস্পষ্ট কর ফাঁকি। তাই হাইকোর্ট তাকে দোষী সাব্যস্ত করে তার নিজেরই দায়ের করা মামলার রায় হিসেবে অর্থ প্রদানের নির্দেশ দিলো। অতএব, কর ফাঁকির মামলাটি তার বিরুদ্ধে কোন ‘দমনমূলক’ ব্যবস্থা ছিল না। বরং, তিনি আইন এড়াতে ও সহানুভূতি অর্জনের জন্য তার খ্যাতি এবং সম্মান ব্যবহার করেছিলেন। একজন নোবেল বিজয়ী এবং অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদদের জন্য, কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য এমন অবৈধ উপায় বেছে নেওয়া দুর্ভাগ্যজনক এবং লজ্জাজনক।
লেখক: গবেষক ও লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই