বইহীন সমাজ থেকে আমাদের বেরুতে হবে
৮ জুন ২০২৩ ১৫:৪৬ | আপডেট: ৮ জুন ২০২৩ ১৫:৪৮
আজকাল মনে হচ্ছে বই মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ক্রমেই আমরা একটা বইহীন সমাজের মধ্যে প্রবেশ করছি। নানা প্যারামিটার আছে এব্যাপারে। গত বই মেলাও কিছুটা ইঙ্গিত দিয়ে গেছে। বৈশ্বিক সংকটে কাগজের দাম ৪০-৫০ শতাংশ বাড়ার পরেও বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী গত মেলায় আগের বছরের তুলনায় নতুন বইয়ের প্রকাশ বেশি হলেও বিক্রি কম হয়েছে। এবার বিক্রি কম হওয়ার কারণ হতে পারে গত এক বছরে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় বই কেনার বাজেটে টান পড়া এবং সেই সাথে কাগজের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বইয়ের দামের আকাশ ছোঁয়া। এছাড়া আরও নানা কারণ থাকতে পারে। হতে পারে পাঠাভ্যাস ও পাঠক কমে যাওয়া, নতুন পাঠক আকৃষ্ট করা বা তৈরী করতে না পারা, বইকে পাঠকরে কাছে সহজলভ্য করতে না পারা ইত্যাদি।
বইকে পাঠকের কাছে সহজলভ্য না করে দিনকে দিন আমরা কিছুটা দুর্লভ করে ফেলেছি। বিদেশি বইয়ের সাথে আমাদের দেশিয় বইপত্রের কাগজ, কভার, ওজন, সহজলভ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বিদেশি বইগুলো ওজনে পাতলা,দৈর্ঘ-প্রস্থে ছোট, সহজে বহনযোগ্য, পাতলা পেপারব্যাক কভার। বইয়ের গুরুত্ব ও ধরণ অনুযায়ী বিদেশি বইয়েও হার্ডকাভার যে নেই তা নয়। অন্যদিকে আমাদের বইগুলো প্রায় সবই ওজনে ভারি, দৈর্ঘ- প্রস্থে বড়,সহজে বহনযোগ্য নয়, হার্ডকাভার। বিদেশিরা নিউজপ্রিন্টে, পেপারব্যাক কভারে বই ছাপছে। দেখতেও মন্দ লাগে না। ওদেরগুলো দামে কম, সহজলভ্য। আমাদেরগুলো অফসেট এবং হার্ডকাভার হওয়ায় দেখতে হয়ত আরও সুন্দর। কিন্তু দামে অনেক বেশি। খানিকটা দুর্লভ। কিন্তু বইকে দুর্লভ রাখলেতো আর চলে না। এখনকার কাগজের দুর্মূল্যের বাজারে আমাদের প্রকাশকরা কেন যে বিদেশিদের পন্থায় বই ছাপতে আগ্রহী হয় না সেটি এক বড় প্রশ্ন। আমার মনে হয় নিউজপ্রিন্টে নান্দনিকভাবে বই ছেপে স্বল্পমূল্যে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছানো যেতে পারে। তাছাড়া বই ওজনে ও সাইজেও সহজে বহনযোগ্য হওয়া উচিৎ। সব জায়গায় যেন সহজে বই বয়ে নেওয়া যায়। একসময় সেবা প্রকাশনী নিউজপ্রিন্টে পেপারব্যাক কভারে বই ছেপে বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে বই পৌঁছে দিয়েছিল। এখনকার প্রকাশকরা চাইলে সেবার সেই উদহারণটি কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করে দেখতে পারেন। কারণ সত্যিকারের পাঠক তৈরি খুব বেশি প্রয়োজন। পাঠক তৈরি না হলে লেখক তৈরি হবে না। সাহিত্যও এগুবে না। এক জায়গায় থেমে থাকবে।
বই নিয়ে সেলফি তোলারা আসলে পাঠক নয়। সেলফি তোলার কথা এজন্যই বলছি-সেদিন ধানমন্ডি ২৭ নংয়ে ‘বেঙ্গল বই’য়ে গিয়েছিলাম কয়েকটি প্রয়োজনীয় বইয়ের খোঁজে। গিয়ে দেখি একের পর এক তুরণ তরুণী আসছে আর বইয়ের দোকানটির বিভিন্ন প্রান্তে দাঁড়িয়ে বই হাতে ছবি তুলছে। যেগুলো ফেসবুকের টাইমলাইন ভরাবে। কিন্তু তাদের কাউকেই বই কিনতে দেখলাম না। একুশে বই মেলাতেও বই না কেনা শুধু ছবি তুলতে আসা এমন মানুষজনের দেখা পাওয়া যায়। দুই কোটি মানুষের এই ঢাকা শহরে হাতে গুণে ‘বেঙ্গল বই’ ‘বাতিঘর’ ‘পাঠক সমাবেশ’ মাত্র এই তিনটি মানসম্মত বইয়ের দোকানের নাম মানুষ ভালোভাবে বলতে পারে। ভাবা যায়? ক্রেতা-পাঠকের অভাবে পুরনো যে ঐতিহ্যবাহি বইয়ের দোকানগুলো ছিল সেগুলোও একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর নিউমার্কেটে ১৯৬৩ সালে যাত্রা শুরু করা ঐতিহ্যবাহি জিনাত বুক সাপ্লাই লিমিটেড ৬০ বছর যাত্রার যবানিকাপাত করে গত মাসে বন্ধ হয়ে গেছে। ২০১৭ সালে প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের স্মৃতি ও চেতনাকে ধরে রাখতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ভিন্নধর্মী বুকশপ ক্যাফে ‘দীপনপুর’। তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে আর্থিক লোকসানের পর ২০২০ সালের জুন মাসে সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। নতুন বুকশপ উদ্যোক্তাদের জন্য এটি নিসন্দেহে নিরুৎসাহিত হবার মত একটি ঘটনা। বনানীতে পেন্সিল নামের একটি বইয়ের দোকান ছিল সেটিও ওই বছরই বন্ধ হয়ে গেছে। তালিকা করলে দেখা যাবে এমন আরও অসংখ্য বইয়ের দোকান বন্ধ হয়ে গেছে। দিন যত যাচ্ছে তালিকাটি দীর্ঘ হচ্ছে। রাজধানীর কথা বাদ দিলাম সারাদেশের বাস টার্মিনাল এবং রেল স্টেশনে একসময় কমপক্ষে একটি হলেও বুকস্টল থাকত। এখন বেশিরভাগ জায়গায় সেগুলো নেই। বন্ধ হবার একমাত্র কারণ পাঠক-ক্রেতাশূন্যতা।
পর্যাপ্ত কিনা সেটি বলা কঠিন। তবে আগের তুলনায় প্রচুর বই প্রকাশ হচ্ছে আমাদের দেশে। স্বাধীতার পর থেকে যাত্রা শুরু করে এখন একটি বেশ বড়সড় পুস্তক প্রকাশনা শিল্পই গড়ে উঠেছে। প্রশ্ন হচ্ছে- প্রতিবছর প্রকাশ হওয়া কতগুলো বই মানসম্মত এবং পাঠযোগ্য? ১০ শতাংশও হবে কিনা সন্দেহ আছে। এর প্রধান কারণ বেশিরভাগই কবিতার বই নাম দিয়ে ছাপার অক্ষর দিয়ে ভরিয়ে তোলা একপ্রকার কাগজের দলা প্রকাশ। কিছুদিন আগে জাতীয় কবিতা পরিষদের অফিসে বসে ছিলাম। হঠাৎ ঢাকা কলেজের বিজ্ঞানের কোন সাবজেক্টের এক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ভদ্রলোক এলেন। এসে আলাপ জুড়ে দিলেন সদ্য প্রয়াত কবিতা পরিষদের দপ্তর সম্পাদক কবি হানিফ খানের সাথে। আমি নীরব স্রোতা হিসেবে তাদের কথা শুনছিলাম। অধ্যাপক ভদ্রলোক কবিতা লেখেন এবং ঢাউস সাইজ একটি সচিত্র কবিতার বই হানিফ খানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পড়তে বল্লেন। হানিফ কয়েক পাতা পড়েই অধ্যাপক মহোদয়কে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কবিতা লেখেন কেন? অধ্যাপক মহোদয়ের সহজ উত্তর- অল্প শব্দ, বাক্যে অল্প সময়ে সহজে লেখা যায় তাই তিনি কবিতা লেখেন। আমি শুনে তাজ্জব বনে গেলাম। একজন শিক্ষাবিদ, অধ্যাপকের কবিতার ব্যাপারে যদি এমন মনোভাব হয় তাহলে যাই কোথায়?শিক্ষা, দীক্ষা, বোধের জায়গায় পিছিয়ে থাকা যারা কবিতার নামে এসব লেখেন তাদের অবস্থাটা তাহলে কী সহজেই অনুমেয়। আগেও এমনটা ছিল কিন্তু আজকের অনলাইন দুনিয়া এসে চারপাশে কবি আর কবিতায় সয়লাব। না হোক সেটি কবিতা। আবার কোন পত্রপত্রিকায় প্রকাশযোগ্য নয়তো কী হয়েছে? নিজের ফেসবুকতো আছে। সারা বছর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সেগুলো একুশে বই মেলার সময় এলে কোন একটা প্রকাশককে ধরে গাঁটের পয়সা খরচ করে বই বের করতে হবে। বইমেলাকে কেন্দ্র করে কিছু সুযোগসন্ধানী মৌসুমী প্রকাশকও গড়ে উঠেছে। যাদের কাজই হল মান বিবেচনা না করে এসব লোকের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে বই প্রকাশ করা। এসব অকবিরা সেগুলো আবার পরিচিত অপাঠক বন্ধু, বান্ধবের কাছে গছিয়েও দেয়। একবার মজা পেয়ে গেলে প্রতিবছর মেলাতেই এগুলো চলে। এই করে করে একজন অকবি অসংখ্য গ্রন্থের প্রণেতায় পরিণত হয়ে ওঠেন। সাহিত্য পত্রিকা, লিটল ম্যাগ এখন একপ্রকার নির্বাসনে। অন্যদিকে সুপ্রতিষ্ঠিত দৈনিকগুলোর সাহিত্য পাতার মান নিম্নগামী হওয়ায় কবি হিসেবে প্রস্তুতির ময়দানটাও আর নেই। যার কারণে কবিতা নয় কিংবা কবি নয় এমন কিছুকেও কবিতা বা কবি বলতে হচ্ছে। এসবের ভিড়ে সত্যিকারের নবীন প্রতিশ্রুতিশীল শক্তিমান কবি হালে পানি পায় না।অথচ বোধবুদ্ধি সম্পন্ন একজন মানুষের কাছে কবিতা হচ্ছে সাহিত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম। কবিতা লেখা সবচেয়ে কঠিন কাজ। কারণ একটি প্রবন্ধের বা গল্পের শত লাইন যা না পারে কবিতার শক্তিশালী মাত্র দুটি লাইন তীরের মত বিধে যেতে পারে। কালজয়ী কবিতামালা কিংবা কবিরাতো এজন্যই অমরত্ব লাভ করেন। গদ্যের ক্ষেত্রেও দূর্বলতা আছে।বিশেষ করে গল্প হয় না তবুও জোর করে গল্প বানানোর একটি প্রবনতা আছে। মান সম্মত প্রবন্ধ, প্রবন্ধকারের অভাব আছে। অনুবাদ সাহিত্য সমৃদ্ধ না হবার কারণে আজ পর্যন্ত বিশ্বসাহিত্যে আমাদের ন্যূনতম স্থনটিও হয়নি। অথচ আফ্রিকার অনুন্নত ছোট ছোট দেশেরও একটি জায়গা আছে। সব মিলিয়ে সাহিত্যের সকল শাখাতেই একটি মানের খরা রয়েছে। এই খরা দিয়েই বিশেষ করে একুশে বই মেলার সময় মানহীন বইয়ের বাহুল্য চোখে পড়ে। তবে এসবের ভিড়েও স্বল্প কিছু ভালো সাহিত্য যে আমরা পাই সেটিই কম কী? অন্যদিকে আমাদের বই প্রকাশ অনেকটা মেলা কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। এর থেকে বের হওয়া দরকার। মানসম্মত বই সারাবছরই প্রকাশ হওয়া উচিৎ। শুধু বই প্রকাশ হলে চলবে না একই সাথে সত্যিকারের পাঠকের কাছে বই পৌঁছাতে হবে। অপাঠক মানে যারা বই পড়ে না তাদের হাতে বই পৌঁছে লাভ নেই। অন্যদিকে বইকে সহজলভ্য করতে হবে। সহজলভ্য করার উপায় আগেই বলেছি।
বই পড়ার উপকারিতার কথা বলে শেষ করা যাবে না। বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়। ভালো বই পড়লে মানুষ ভালো চিন্তা করতে পারে। আমাদের সমাজে প্রচুর ভালো চিন্তার মানুষ প্রয়োজন। বই-ই কেবল পারে সমাজে অসংখ্য ভালো চিন্তার মানুষ তৈরি করতে। মানুষ যত বেশি বই পড়বে, তার মধ্যে তত বেশি জ্ঞানের তৃষ্ণা বৃদ্ধি পাবে এবং বই পড়ার প্রতি তার মনোযোগ আকৃষ্ট হবে। বই পাঠকের মধ্যে পাঠাভ্যাস সৃষ্টি করে। বই না পড়তে পড়তে আজকাল আমরা পাঠবিমুখ হয়ে পড়ছি। ফলে মানুষ বই পড়ার অভ্যাস হারাচ্ছে এবং নতুন নতুন বই কেনার প্রবণতাও কমছে। মার্ক টোয়েন বলেছেন, ‘বই পড়ার অভ্যাস নেই আর পড়তে জানে না এমন লোকের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।’ রম্যরচয়িতা, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক ও কবি সৈয়দ মুজতবা আলী ‘বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না’ এমন একটি বিখ্যাত উক্তি করেছেন। এখানে দুটি উক্তিই যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। বই না পড়তে পড়তে লোহায় মরিচা ধরার মত আমাদের মস্তিষ্কে মরিচা ধরে যায়। আবার আমরা কত অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে অপচয় করি। কিন্তু দুটো বই কিনতে গেলে হাজার বার ভাবি। আমাদের সমাজে কিছু স্বল্প শিক্ষিত মানুষ আছেন যারা প্রচুর বই পড়েন। তাদের সাথে সার্টিফিকেট সর্বস্ব শিক্ষিত কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস নেই এমন লোকের পার্থক্য বিস্তর। আর একটি বিষয় লক্ষনীয়-উপহার হিসেবে আমরা নানা রকম বস্তুগত জিনিস দিয়ে থাকি। কিন্তু সেই জিনিসগুলোর পরিবর্তে যদি বইকে উপহারের প্রধানতম উপকরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যায় তাহলে এর চেয়ে ভালো উপহার আর হতে পারে না। কাজেই আমাদের সাধ্য মত বই কিনতে হবে, নিজে পড়তে হবে এবং অন্যকে বই পড়তে উৎসাহ দানের জন্য বই উপহার দিতে হবে। সব মিলিয়ে বইহীন সমাজ থেকে আমাদের বেরুতে হবে।
লেখক: তথ্যচিত্র, টিভি অনুষ্ঠান নির্মাতা, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই