Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ব্রিকস জোটে বাংলাদেশ, অর্থনৈতিক সক্ষমতার স্বীকৃতি

তাপস হালদার
২০ জুন ২০২৩ ১৭:০০

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ওয়ার্ল্ড অব ওয়ার্ক সামিট:সোশ্যাল জাস্টিস ফর অল’ নামে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সম্মেলনে যোগ দিতে ১৩-১৬ জুন সুইজারল্যান্ড সফর করেন। সামাজিক ন্যায় বিচারের সমর্থনে বর্ধিত, সমন্বিত ও সুসঙ্গত পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা মোকাবিলায় বৈশ্বিক কণ্ঠস্বরের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের এই সম্মেলনে এক ডজনেরও বেশি সরকার প্রধান, জাতিসংঘ, অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। অনুষ্ঠানের সাইড লাইনে বৈঠক করেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট মাতামেলা সিরিল রামাফোসার সাথে। সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আস্বস্ত করেন আগস্টে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে বাংলাদেশকে সদস্য পদ দেয়া হবে। এবিষয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তারা যে ব্রিকস ব্যাংকটা করেছে, তাতে আমাদের সদস্য করেছে। আগস্ট মাসে ওদের সম্মেলন হবে। সেখানে তারা বাংলাদেশকে সদস্য করবে। সেসময় প্রধানমন্ত্রী ইনশাল্লাহ সেখানে যাবেন।’

বিজ্ঞাপন

ব্রিকস(BRICS) হলো -ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও সাউথ আফ্রিকার অর্থনৈতিক জোট। এই পাঁচটি দেশের ইংরেজি আদ্যাক্ষর দিয়ে সংস্থাটি গঠিত হয়েছে। ২০০১ সালে বিশ্বের উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তির ধারণা দিতে গিয়ে গোল্ডম্যান স্যাকসের তৎকালীন প্রধান অর্থনীতিবিদ জিম ও’নিল ব্রিকসের ধারণা প্রবর্তন করেন। শুরুতে অবশ্য তিনি চারটি দেশের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তখন এটার নাম ছিল ব্রিক। পরে ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগদানের পর ‘এস’ হয়ে ব্রিকস নাম হয়। ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত সকল রাষ্ট্র উন্নয়নশীল অথবা সদ্য শিল্পোন্নত। কিন্তু তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভাবে প্রভাবশালী রাষ্ট্র। ব্রিকসের বর্তমান পাঁচটি রাষ্ট্রই জি-২০ এর সদস্য।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে ব্রিকস দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা ৩৪৫ কোটি, যা বৈশ্বিক মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ। বাংলাদেশ, সৌদিআরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইন্দোনেশিয়া যোগ দিলে এবছরই জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। ২০২১ সালের হিসেব মতে, এই জোট বৈশ্বিক জিডিপিতে প্রায় ৩২ শতাংশ এবং বিশ্ব বাণিজ্যে ২০ শতাংশ অবদান রাখছে। বাংলাদেশ সহ অন্যান্য দেশগুলো আগস্টে যোগদানের পর বৈশ্বিক জিডিপি ও বিশ্ব বানিজ্যে ব্রিকসের গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে যাবে।

২০১৫ সালে ব্রিকস ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে নাম দেয়া হয় নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। যার সদরদপ্তর চীনের সাংহাইয়ে। ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে ব্রিকস ব্যাংকে যোগদানের অনুরোধে করেন। পরে ২০২১ সালে বাংলাদেশ ব্রিকস ব্যাংকের সদস্য হয়। ব্যাংকটি পর্যায়ক্রমে মার্কিন ডলার থেকে সম্পূর্ণরূপে সরে আসার সিন্ধান্ত নিয়েছে। সদস্য দেশগুলোকে দেয়া ঋণের অন্তত ৩০ শতাংশ স্থানীয় মুদ্রায় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য ডলারের উপর নির্ভরশীলতা কমানো এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে মুদ্রার বিনিময় হারের উঠানামার নেতিবাচক প্রভাব থেকে সদস্য দেশগুলোকে রক্ষা করা।

ব্রিকস মূলত: বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ গুলোর বৃহত্তম অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির একটি জোট। সদস্য পাঁচটি দেশের বৈশ্বিক জিডিপিতে অবদান বিশ্বের ধনী দেশ হিসেবে পরিচিত জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর থেকেও বেশি। ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জিডিপিতে ৫০ শতাংশের বেশি অবদান রাখবে। আর ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর অর্থনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করবে।

ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগদান বৈদেশিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করবে। জোটটি যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন ডলারের আধিপত্য হ্রাসের লক্ষ্যে কাজ করছে, সেখানে বাংলাদেশও দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা পাবে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আরো বৈচিত্র্য আসবে। ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে চীন ও ভারত বাংলাদেশের বৃহত্তম বানিজ্য অংশীদার। মোট আমদানির প্রায় ৪০ শতাংশই এই দুই দেশ থেকে করা হয়। ব্রিকস বিকল্প মুদ্রা চালু করলে বাংলাদেশ এর সুবিধা পাবে। ডলারের বাইরে বিকল্প বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ বহুমুখীকরণের সুবিধা পাবে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে (এসডিজি) সরকার ১৫ বছরের জন্য প্রায় এক হাজার বিলিয়ন ডলারের বাজেট করছে। যাতে প্রতি বছর খরচ হবে জিডিপির প্রায় ২০ শতাংশ। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক, এডিপি, আইএমএফ, জাইকাসহ থেকে ঋণ গ্রহণ করা হচ্ছে। চাহিদা মেটাতে আরো নতুন জায়গার দরকার আছে। ব্রিকস এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

বিশ্বের সর্বত্র মার্কিন ডলার বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার হয়। তাই মার্কিন অভ্যন্তরীণ মুদ্রানীতি বিশ্ব অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ২০২২ সালের মার্চ থেকে মার্কিন কেন্দ্রীয় ফেডারেল ব্যাংক রিজার্ভের সুদের হার ব্যাপক হারে বাড়িয়ে দিয়েছে। যার কারণে উন্নয়নশীল অনেক দেশের উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন হওয়ার কারণে আমদানি-রপ্তানি ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। এতে দেশগুলো থেকে পুঁজি চলে যাচ্ছে যার কারণে রিজার্ভ সংকটে পড়ছে।

ব্রিকসে আমেরিকা ইউরোপের খবরদারি নেই। বিশ্বব্যাংক আইএমএফ বিশ্বের অর্থ ব্যবস্থা একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। গভর্নি বোর্ডে উন্নয়নশীল দেশের তেমন কিছু করার থাকে না। তাই মুরব্বিদের চাপিয়ে দেয়া নীতি বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়। কিন্ত ব্রিকস উন্নয়নশীল দেশেরই প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে খবরদারির তেমন সুযোগ থাকবে না। এখানে সদস্য দেশগুলোর স্বার্থই প্রাধান্য পাবে।

আগামী বছরই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হবে। তখন সহজ শর্তে ঋণ পাওয়ার সুযোগ সীমিত হবে। তখন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা(এসডিজি), ভিশন-২০৪১ ও ডেল্টাপ্লান বাস্তবায়নের জন্য নতুন অর্থায়নের উৎসের প্রয়োজন হবে। তখন ব্রিকস ব্যাংক অর্থাৎ নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে।

ব্রিকসে ৩০ টি দেশ যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। কিন্তু তারা এবছর বাংলাদেশ, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া সহ ৮ টি দেশকে সদস্য হিসেবে নেওয়ার সিন্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই সম্প্রসারণ নিঃসন্দেহে ভালো ফল বয়ে আনবে। জোট শক্তিশালী হবে। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ থেকে জিডিপি অনেক এগিয়ে থাকবে। তখন ডলার ও ইউরোর দাপট কমে যাবে। ব্রিকসে যোগদান করিতেছে এমন দেশগুলোর মধ্যে সৌদিআরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তেল সমৃদ্ধ দেশ। যদি জোট বিকল্প মুদ্রা চালু করে, তাহলে ডলার সংকটে পড়বে। তখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিও অনেক চাপে পড়ে যাবে।

বাংলাদেশকে জোটে নেওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বের ৫০ টি বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ৩৫ তম। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। ২০২২ সালে জিডিপির মোট আকার ছিল ৪৬৫ বিলিয়ন। বাংলাদেশের ঠিক আগে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও অস্ট্রিয়ার মতো দেশ। আর ঠিক পরেই রয়েছে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনাম। ২০৩০ সালের মধ্যেই ২৪ তম অর্থনীতির দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিনত হবে। করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ দেশ মন্দার কবলে পড়লেও বাংলাদেশ নিজস্ব দক্ষতায় তাদের অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে পেরেছে। নিন্দুকেরা যা-ই বলুক না কেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মর্যাদা অনেক সুউচ্চ সেটা ব্রিকসের আমন্ত্রণ থেকেই বোঝা যায়। কারণ সেসব দেশ ব্রিকসের সদস্য তারা অর্থনৈতিক ভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতারই স্বীকৃতি দিয়েছে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
ই-মেইল: [email protected]

সারাবাংলা/এজেডএস

তাপস হালদার ব্রিকসে জোট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর