এবারের সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদ থেকে মুক্তির সংগ্রাম
২৪ জুন ২০২৩ ১৭:৪৯
র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা; মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আমেরিকা এবং সুশীল সমাজের উৎকণ্ঠা; কল্পিত গুম নিয়ে কল্পকাহিনী; মত প্রকাশের স্বাধীনতা নেই বলে পত্রিকা, টেলিভিশনে হায় হায়, নাই নাই; সন্ত্রাসবাদী জামায়াত-বিএনপি’র হঠাৎ করে মানবতাবাদী এবং গণতন্ত্রী হয়ে ওঠা – এসবের মূল কারণ পাওয়া গেল প্রধানমন্ত্রীর ২১ জুনের সংবাদ সম্মেলনে। আমেরিকার সেন্টমার্টিন চাই।
সেন্টমার্টিনে তারা মার্কিন সামরিক ঘাঁটি বানাতে চায়। সেখান থেকে চীনের দিকে বন্দুক তাক করে বসে থাকবে। চীন বাড়াবাড়ি করলেই গুলি, বোমা ছুঁড়বে। দরকার মনে করলে পারমাণবিক বোমাও বসাতে পারে। সেনা, বোমা বসানোর পর চীন, বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া – যেই বাড়াবাড়ি করবে তার উপর পেট্রোল বোমা মেরে দেবে। সেন্টমার্টিনে একটা ঘাঁটি বসাতে পারলে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে সমগ্র দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এত বড় সুযোগ আটকে আছে শুধু একটা মানুষের কারণে। সে আবার ইজারা-টিজারা দেওয়ার লোক না। সে কথা জানিয়ে দিয়েছেন স্পষ্ট করে। তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারলেই দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার উপর পুরা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে আমেরিকা। ফিরিয়ে আনা যায় হারিয়ে ফেলা এককেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা। তাকে সরাতে হলে চাই রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি। আমেরিকার পক্ষে পরিবেশ তৈরি করার কাজ বরাবরের মতো এবারেও করছে চিহ্নিত কয়েকটি মিডিয়া আর জামায়াত-বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী চক্র।
আমেরিকা সেন্টমার্টিন ইজারা নিতে চায় এমন কথা শুনেছি নব্বইর দশকের প্রথম দিকে যখন জামায়াতের সমর্থন নিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। তারপর বহুকাল এ বিষয় আলোচনায় ছিল না। যুদ্ধবাজ বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর ধরা খেয়েছে আফগানিস্তানে। আফগান তালেবানরা মোড়লের ইজ্জত খুলে রেখে দিয়েছে। সে ইজ্জত উদ্ধারের চেষ্টা করছে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ লাগিয়ে। রাশিয়াকে ইউক্রেনের মাঠে হারানোর জন্য তিনি আদাজল খেয়ে নেমেছেন গোটা তিরিশেক যুদ্ধবাজ দেশকে নিয়ে। ন্যাটোর নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জি৭ দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধ করেও মাঠে মারতে পারছে না মাত্র একটি দেশ, রাশিয়াকে। বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ব নিরঙ্কুশ করতে হলে একই সঙ্গে থামিয়ে দিতে হবে চীনের জয়যাত্রা।
চীনকে থামানো অত সহজ নয়। ব্যাপক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা এবং একটা পুরোদস্তুর যুদ্ধ দিয়ে রাশিয়াকেই দমাতে পারছে না; চীনকেও পারবে না সহজে। এখানে পুরোমাত্রায় সামরিক শক্তি দিয়েই থামাতে হবে চীনের জয়যাত্রা। সেজন্য চারদিক থেকে বন্দুকের নল তাক করে রাখতে হবে চীনের দিকে। চীনের পূর্ব দিকে আছে জাপান আর দক্ষিণ কোরিয়া। সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে জাপানে এবং ৫৭ সাল থেকে দক্ষিণ কোরিয়ায় রয়েছে মার্কিন ঘাঁটি। জাপানে বর্তমানে আছে প্রায় ৫০ হাজার এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৮ হাজার মার্কিন সৈন্য। সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় মোতায়েন করেছে পারমাণবিক বোমা। সামরিক ঘাঁটি তৈরি হচ্ছে চীনের দক্ষিণে, তাইওয়ানে। সেখানে জাহাজ জাহাজ অস্ত্র, গোলাবারুদ পাঠানো হচ্ছে। চীনের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ফিলিপাইনে আমেরিকা বানিয়েছে চারটা সামরিক ঘাঁটি। সেখানেও মোতায়েন করা হয়েছে সৈন্য, অস্ত্র। চীনের আরও দক্ষিণে রয়েছে আমেরিকার আরেক ঘাঁটি, অস্ট্রেলিয়া। যুক্তরাজ্য সেখানে পরমাণু বোমাসহ চারটি সাবমেরিন পাঠানোর চুক্তি করেছে বছর খানেক আগে। কিছুদিনের মধ্যেই সেখানে পৌঁছাবে আমেরিকার নিয়ন্ত্রণাধীন পরমাণু বোমা। চারদিক থেকে চীনকে ঘিরে ফেলতে চায় আমেরিকা। এ ঘেরাও নিশ্চিত করতে তাদের দরকার সেন্টমার্টিন। সেন্টমার্টিনে ঘাঁটি হলে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে চীনের প্রতিবেশীদেরও। ভারত ও প্রশান্ত – দুই মহাসাগরেই নিশ্চিত হবে আমেরিকার সর্বময় কর্তৃত্ব।
আমেরিকার এই দুই মহাসাগরব্যাপী সর্বময় কর্তৃত্ব নিশ্চিত করার পথে বাঁধা শুধু একটা মানুষ, শেখ হাসিনা। গত বুধবার তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “সেন্টমার্টিন লিজ দিলে ক্ষমতায় থাকতে অসুবিধা নেই। কিন্তু সেটা আমার দ্বারা হবে না।” তিনি আরও বলেন, “আমি জাতির পিতা শেখ মুজিবরের কন্যা। আমার হাত দিয়ে এই দেশের কোনো সম্পদ কারও কাছে বিক্রি করে আমি ক্ষমতায় আসতে চাই না।” বিগত কয়েক মাস ধরে বিএনপির মিথ্যা, বানোয়াট এবং অযৌক্তিক ইস্যুগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছে আমেরিকা। তারা বারবার বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলে জামায়াত-বিএনপি স্বাধীনতা বিরোধী, খুনি ও সন্ত্রাসী জোটকে উস্কে দিচ্ছে। ভোল পাল্টে ফেলেছে জাতীয় পার্টির একাংশ। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ইস্যুতে মনগড়া এবং মিথ্যা ইস্যু বানিয়ে, বক্তব্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বিরোধী জোড়াল অবস্থান নিয়ে রাজনীতির মাঠে সোচ্চার রয়েছে তথাকথিত সুশীল সমাজ। দেশের মানুষ এদের আমেরিকার দালাল হিসেবেই চেনে। আমেরিকা এবং আমেরিকার দালালেরা চায় শেখ হাসিনাকে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিতে। তাকে সরিয়ে দিতে পারলে আমেরিকা পাবে সেন্টমার্টিন, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং ইচ্ছেমত বাণিজ্যের কর্তৃত্ব, জামায়াত-বিএনপি পাবে দেশ লুটেপুটে খাওয়ার ক্ষমতা।
শেখ হাসিনা আগেও বলেছেন, আবার সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনেও বলেছেন, “২০০১ সালে বিএনপি গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল।” তার এ বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হয় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের বক্তব্য থেকে। ২০০১ সালে সরকার গঠনের কিছুদিনের মধ্যেই তিনি জনসমক্ষে বলেছিলেন, “সম্পদ মাটির নিচে রেখে লাভ কী?” তার এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিবাদ ওঠে তৎক্ষণাৎ। সে সময়ের বিরোধীদলীয় নেত্রী, শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ৫০ বছরের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস মজুদ রাখার পর রফতানির কথা ভাবা যেতে পারে। শেখ হাসিনার এক বক্তব্যে ভেস্তে যায় আমেরিকা ও ভারতের গ্যাস বাণিজ্যের ষড়যন্ত্র। জিয়াউর রহমানের অবৈধ সামরিক সরকার এবং খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দুটো সরকার দেশের সাধারণ মানুষের উপকারের জন্য করেছে এমন কোন কাজের উদাহরণ নেই। জামায়াত-বিএনপি শুধু রাষ্ট্র ক্ষমতা উপভোগ করেছে; দুর্নীতির হাওয়া ভবন, খাম্বা কোম্পানি বানিয়েছে; ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট, পেট্রোল বোমা ঘটিয়েছে। এদের পক্ষেই সম্ভব ক্ষমতার জন্য গ্যাস রফতানি এবং সেন্টমার্টিন ইজারা দেয়া।
সেন্টমার্টিন ইজারা দেয়ার মার্কিন দাবীর কথা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে আমেরিকার বিরাগভাজন হবার অনেক বড় ঝুঁকি নিয়েছেন। অল্প কিছু দিন আগে তিনি নিজেই বলেছেন, আমেরিকা যে কোন দেশের সরকার পরিবর্তন করার ক্ষমতা রাখে। এটা শুধু শেখ হাসিনার বক্তব্যই নয়, অতীতে এমন ঘটনা আমরা অনেক দেখেছি। শুধু সরকার পরিবর্তনই নয়, আমেরিকার অঙ্গুলি হেলনে অনেক সরকারপ্রধানকে জানে মেরে ফেলার উদাহরণও আমরা জানি। সপরিবারে আমাদের জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডে আমেরিকা যে জড়িত ছিল তার প্রমাণ রয়েছে ভুরি, ভুরি। তাছাড়া কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা, চিলির আলেন্দে, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ার মোয়াম্মর গাদ্দাফিকে আমেরিকা হত্যা করেছে বিশ্ববাসীর চোখের সামনে। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নিজেই বলেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবার কথা। রাশিয়ার কারণে প্রকাশ্যে চেষ্টা করেও ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি সিরিয়ার বাসার আল আসাদকে।
আমেরিকার সেন্টমার্টিন ইজারা নেবার দাবী জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব হারানোর ঝুঁকি যেমন নিয়েছেন তেমনি অন্যদিকে তিনি নিজের জীবনের ঝুঁকি কমিয়েছেন; আমেরিকার কূটকৌশলের কারণে বাংলাদেশের কাঁধে মামদো ভুতের মত বসে থাকা স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-বিএনপি গংদের অপরাজনীতি জনসমক্ষে প্রকাশ করে দিয়ে তাদের চলমান আন্দোলনকে ভিত্তিহীন করে ফেলেছেন; এবারকার রাজনীতি বাতিল করে দিয়েছেন; এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের উপর মার্কিন আগ্রাসন চিরতরে নির্মূল করার পথ বের করেছেন। ১৩ সালে একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের ব্যবস্থা করে যেমন তিনি এদেশে তাদের অপরাজনীতির ভিত দুর্বল করে দিয়েছেন তেমনি আগামী নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে পারলে তার এই মার্কিন বিরোধী অবস্থানের কারণে চিরতরে বাংলাদেশের বুকে অকিঞ্চিৎকর হয়ে যাবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য। এ কথা তখনই সঠিক বলে প্রমাণিত হবে যখন আওয়ামী লীগ নেতারা শেখ হাসিনার দেখানো পথে সঠিক পদক্ষেপে এগিয়ে যাবে এবং জনসাধারণ পরিস্থিতি বুঝে সুশীল সমাজের বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী অপরাজনীতির কবল থেকে মুক্ত হয়ে আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে উঠবে। আওয়ামী লীগের রাজনীতি এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। এই চ্যালেঞ্জ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ সাম্রাজ্যবাদ মুক্ত হবার চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ ৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবার লক্ষ্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করাই এখন আওয়ামী লীগের প্রধান দায়িত্ব, প্রধান রাজনীতি।
সারাবাংলা/আইই