বদলে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা
২৫ জুন ২০২৩ ১৪:৩৪
২৫ জুন, ২০২২। বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। এইদিন বঙ্গকন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা স্বপ্নের পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন করেন। এবং পরের দিন ২৬ মার্চ থেকে সেতুটি সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেয়া হয়।
পদ্মাসেতু নির্মানের আগে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষদের ঢাকা আসতে পোহাতে হতো নিদারুণ দুঃসহ যন্ত্রণা। যারা এই অঞ্চলে যাতায়াত করেন নি তারা কল্পনাও করতে পারবেন না। ঈদ,পূজা কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানের সময় যন্ত্রণা কয়েক গুন বেড়ে যেতো। এছাড়া শীতে ঘন কুয়াশায় রাতে ফেরি বন্ধ থাকতো। আবার বর্ষায় প্রবল স্রোতে ভেঙে যেত ঘাট, ফেরি থাকতো বন্ধ। শুষ্ক মৌসুমেও স্বস্তি ছিলনা, নাব্যতা সংকটে ফেরি আটকে যেতো। পারাপার সবসময়ই ছিল দুর্বিষহ। খ্যাতনামা গীতিকার আবদুল লতিফের লেখা ও সুরে ‘সর্বনাশা পদ্মা নদী’ গানে পদ্মানদীর দুর্দশার কথাই তিনব ফুটিয়ে তুলেছিলেন।
অথচ গত একবছরে পুরো চিত্রই বদলে গেছে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরতে কোন তাড়া নেই। গাড়িতে চড়ে বসলেই মুহুর্তেই বাড়ি পৌছে যাচ্ছেন। গ্রামের বাড়ির সাথে শহরের মানুষের যোগাযোগ বাড়ছে, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় হচ্ছে। শুক্র-শনিবার সহ ছুটির দিন গুলোতে মানুষদের বাড়ি যাওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। বৃহস্পতিবার বাড়ি গিয়ে আবার রবিবার এসে অফিস করেন এমন লোকজনের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে। ট্রেন চালু হওয়ার পর আনন্দ ও স্বস্তি আরো বেড়ে যাবে। সেপ্টেম্বরই চালু হতে যাচ্ছে ট্রেন। প্রথম দফায় রাজধানী ঢাকা থেকে ট্রেন যাবে ভাঙ্গা। আর যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার পুরো রেল সংযোগ শেষ হবে আগামী বছরের জুনে।
পদ্মা সেতু সম্পূর্ণ নিজস্ব নির্মিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার অদম্য সাহসের কারণে তা সম্ভব হয়েছে। পদ্মা সেতুতে মোট ব্যয় হয়েছে ৩২ হাজার ৬০৫ কোটি ৫২ টাকা। পদ্মাসেতুতে গত একবছরে টোল আদায় হয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। প্রথম দিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১৮টি গাড়ী নিয়ে পার হয়ে টোল দিয়েছিলেন ১৬ হাজার টাকা। তারপর থেকে একবছরে প্রায় ৫৭ লক্ষ গাড়ী টোল পরিশোধ করে পার হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাথে সেতু মন্ত্রণালয়ের ঋণ চুক্তি অনুযায়ী ১ শতাংশ সুদ সহ ৩৫ বছরে ঋণের টাকা সম্পূর্ণরূপে পরিশোধ করবে বলা হয়। গত ৫ এপ্রিল সেতু কর্তৃপক্ষ ঋণের জন্য প্রথম ও দ্বিতীয় কিস্তির ৩১৬ কোটি ৯০ লক্ষ ৯৭ হাজার ৫০ টাকা এবং ১৯ জুন তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তির ৩১৬ কোটি ২ লক্ষ ৬৯ হাজার ৯৩ টাকা পরিশোধ করে। দুই দফায় ৬৩২ কোটি ৯৩ লাখ ৬৬ হাজার ১৪৩ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়কের পর ভাঙ্গা থেকে তিন দিকে তিনটি রাস্তা চলে গেছে। একটি বরিশাল অঞ্চলে, একটি গোপালগঞ্জ -খুলনা-যশোর অঞ্চলে, অন্যটি ফরিদপুর-রাজবাড়ি-কুষ্টিয়া অঞ্চলে। অর্থাৎ তিনটি সড়কই পুরো ২১ জেলাকে সংযুক্ত করেছে। এবং সড়ক গুলো পায়রা, মোংলা সমুদ্রবন্দর ও বেনাপোল, ভোমরা স্থলবন্দর সংযুক্ত করার কারণে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে এসেছে নতুন গতি।
পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনীতিতে আমুল পরিবর্তন এসেছে। ম্যাজিকের মতো বেড়ে যাচ্ছে জায়গার দাম। উন্নত হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা। সেতুর দুই পাড়ের অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-পর্যটন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কৃষিক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেতু চালু হওয়ার পর সকল পণ্য সময় মতো রাজধানীতে পৌঁছে যাচ্ছে। যার কারণে কৃষক কিংবা পাইকারদের লোকসানে পড়তে হচ্ছেনা। সহজলভ্য হচ্ছে কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণ। পরিবহনে বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে না বলে ক্রেতা বিক্রতা উভয়ই লাভবান হচ্ছে। আগে পদ্মা পার হতে ফেরি সংকটে পড়ে কাঁচামাল অনেক সময়ই ফেরি ঘাটে নষ্ট হতো। এজন্য কাঁচামাল নিয়ে কেউ ঢাকা আসতে সাহস পেত না। ফলে কৃষকেরা ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হতো। পদ্মা সেতুর কারণে সে সমস্যা আর নেই মাত্র ৩-৪ ঘন্টায় কৃষিপণ্য রাজধানীতে চলে আসছে।
পদ্মা সেতুর পর সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শুরু হয়েছে শিল্পায়ন। শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে শেখ হাসিনা তাঁতপল্লি নির্মান করা হয়েছে। সেখানে থাকবে ৮ হাজার ৬৪ টি তাঁত শেড। সরকারি উদ্যোগে এই প্রকল্প পুরোপুরি চালু হলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে এই তাঁতশিল্পের বাজার প্রসারিত হবে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) পদ্মা সেতুর দুই পাশে বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। যার অনেক গুলো শেষ পর্যায়ে। মাদারীপুর ও যশোরে শিল্প পার্ক নির্মানের কাজ চলছে। এছাড়া ফরিদপুর, খুলনা, নড়াইল ও মাগুড়ায় নির্মানের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মুন্সিগঞ্জে প্লাস্টিক কারখানা, রসায়নিক কারখানা, মুদ্রণশিল্প ও এপিআই শিল্পপার্ক। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) বাগেরহাটের মোংলায় একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করেছে। এছাড়া গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় আরেকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির কাজ চলছে। এছাড়া খুলনা, সাতক্ষীরা, মাগুড়া ও শরীয়তপুরে অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। মোট ১৭ টি ইকোনমিক জোন, বিনোদন কেন্দ্র ও পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠবে।
পদ্মা সেতু চালুর পর যশোরের বেনাপোল ও সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন কয়েক গুন বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে চিকিৎসা কিংবা ভ্রমণে যায়। পদ্মা সেতুর কারণে তারা খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। ঢাকা -কলকাতার দুরত্ব কমেছে প্রায় দেড়শ কিলোমিটার। ঢাকা থেকে ৪-৫ ঘন্টায় তারা বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করতে পারছে। আমদানি -রপ্তানিও সহজতর হয়েছে।
পদ্মা সেতু শুধুমাত্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নয়, পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতিই বদলে দেবে। এই সেতু দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ, বানিজ্য, পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। সেতুটি ভবিষ্যতে ট্রান্স এশীয় রেলপথের অংশ হবে। তখন যাত্রীবাহী ট্রেনের চেয়ে মালবাহী ট্রেন বেশি চলবে। এশিয়ার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে এই সেতুর উপর দিয়ে মালামাল নিয়ে যাবে ট্রেন। এশিয়ান হাইওয়ে, উপ-আঞ্চলিক ও আঞ্চলিক যোগাযোগ হাব তৈরি হবে। পায়রা ও মোংলা বন্দরে সংযোগ স্থাপনের ফলে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সাথে আমদানি-রপ্তানি সহজ হবে।
কুয়াকাটা, সুন্দরবন ও আশপাশের ছোট ছোট দ্বীপ গুলো ইতিমধ্যেই পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে। ভবিষ্যতে এই অঞ্চলের চর গুলোকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপের মতো পর্যটনকেন্দ্রে পরিনত হবে। পর্যটকদের জন্য নতুন নতুন হোটেল মোটেল গড়ে উঠেছে। যার কারণে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। সব মিলিয়ে পর্যটন ক্ষেত্রে পদ্মা সেতু নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও দেশের অর্থনীতির বিকাশে পদ্মা সেতু ইতোমধ্যেই গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করছে। মাত্র এক বছরেই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চের মানুষের বদলে জীবনযাত্রা ।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই