উৎপাদন ও সম্পদের ভারসাম্য এবং নতুন মুদ্রা
২৬ জুন ২০২৩ ১২:১১
মানব সভ্যতার শুরুতে মানুষ জিনিসের বিনিময়ে জিনিস লেনদেন করে জীবন পরিচালনা করত। এটাকে (Barter system) বলা হত। কিন্তু ‘বার্টার’ করার অসুবিধা হল যদি একজন চাল চায় এবং তার বদলে সে মাছ বিক্রি করতে চায় তবে, তাকে এমন কাউকে খুঁজে বের করতে হবে যার কাছে দেয়ার মত চাল আছে এবং সে বদল করে মাছ কিনতে ইচ্ছুক। অর্থনীতির ভাষায় এটাকে (Coincidence of wants) বলে। অর্থাৎ সবার চাহিদা একে অন্যের সঙ্গে মিশতে হবে। এই লেনদেনের পন্থাটা খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না বলে তারা কোন বিশেষ বস্তুকে মূল্যবান বলে নির্বাচিত করে সব লেনদেন তার নিরিখে করতে লাগলো। কাগজে মুদ্রার বা নোটের প্রচলন শুরু হয় চীনে, ট্যাঙের রাজত্বকালে ৬১৮-৯০৭ সাল। এরপর ধীরে ধীরে প্রচলন শুরু হয় কাগুজে নোটের। ১৬৯০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস কলোনিতে সর্বপ্রথম কাগজের নোটের প্রস্তাবনা করা হয়। ১৭৬০ সালে প্রথম ডলার ছাপানো হয় এবং তা সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়। বাংলাদেশের মুদ্রার নাম টাকা। ১৯৭১ সালে ডিসেম্বরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলে এই নামটিই মুদ্রার সরকারি নাম হিসেবে গৃহীত হয়। ১৯৭২ সালের ৪ মার্চ থেকে ১ টাকার নোট প্রচলনের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজস্ব ব্যাংক নোট চালু করে।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন টাকা এত কম ছাপানো হয়? বেশি ছাপালে আর তো কোন সমস্যা থাকে না! সরকার নিজেই যদি বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা প্রিন্ট করে জনগণের হাতে তুলে দিত তাহলেই তো সব আর্থিক সমস্যা সমাধান হয়ে যেত। প্রশ্নটা অতি সহজ। কিন্তু, এত সহজ সমাধান হলে পৃথিবীতে আর কোন চিন্তাই থাকত না। নির্দিষ্ট করে বললে টাকা প্রিন্ট করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তাহলে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কীসের ভিত্তিতে টাকা ছাপায়? টাকা প্রিন্ট করা হয় সেই দেশের অথনৈতিক প্রয়োজন অনুসারে তার সাথে ভারসাম্য রেখে। টাকা উৎপাদনের পরিমাণের সাথে জড়িত মানুষের উপার্জন, অর্থনৈতিক চাহিদা, দেশের সম্পদ ইত্যাদি এর বেশি উৎপাদন করলেই হয় সমস্যা। দেশের অর্থনীতি ভারসাম্য হারাতে শুরু করে।
সাধারণত পৃথিবীর যে কোন পারস্পরিক রাষ্ট্রের বা সারা বিশ্বের সমস্ত দেশেরই মুদ্রার মূল্যায়ণ নির্ধারিত হয় বেশ কিছু মানদন্ডের ওপর নির্ভর করে। আন্তর্জাতিক বাজারে সেই পণ্যের চাহিদা, পারস্পরিক দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রতিযোগিতা, সেই দেশের সামরিক ক্ষমতা, জনসংখ্যা, সেই দেশের সার্বিক আর্থিক স্থিতি, তথা জনসাধারণের আর্থিক ক্রয়ক্ষমতা সেই দেশে অন্যান্য দেশ থেকে মানুষের ভ্রমন গমন বা স্থানান্তরের মাত্রা তথা সর্বোপরি অর্থনীতির এক মৌলিক সূত্রের ওপরে, তা হল চাহিদা এবং যোগান (Demand and supply)। চাহিদা এবং যোগান শুধু মুদ্রারই নয়, সমস্ত কিছুর সমন্বয়ের অর্থাৎ কারিগরি বিদ্যা তথা শিক্ষার চাহিদা এবং যোগান, শিল্পের উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত কাচাঁমালের চাহিদা এবং যোগান, প্রস্তুত হওয়া পণ্যের চাহিদা এবং যোগান, কর্মঠ শ্রমিকদের চাহিদা এবং যোগান তথা দেশেই সমগ্র বাজারের উপভোগ্যতার চাহিদা এবং যোগান। ধরা যাক, একটা দেশে সম্পদ বলতে রয়েছে দশটা আম গাছ। আর সেই, দেশ বছরে ২০ টাকা প্রিন্ট করে। পরিবহন খরচ, খুচরা মূল্য পাইকারি মূল্য ইত্যাদি জঠিলতা বাদ দিয়ে ধরেই নেই প্রতিটি আমের মূল্য ২ টাকা তাহলে দেশের মোট সম্পদ আর মোট (Currency) ভারসাম্য পূর্ণ হল। পরের বছর ঐ দেশটি সর্বমোট ৪০ টাকা প্রিন্ট করল, কিন্তু মোট সম্পদ বলতে দশটি আমই রইল। যেহেতু দেশে নতুন কোন সম্পদ নেই ঐ ১০টি আম কেনার জন্য বরাদ্দ হলো ৪০ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি আম দ্বিগুন হলো। এভাবে দেশের মোট সম্পদের তুলনায় অতিরিক্ত টাকা উৎপাদন করলে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যায়, টাকার দাম বা ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। একে বলে মুদ্রাস্ফীতি। দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেলে বেশি করে টাকা ছাপিয়ে আর লাভ কি হল। তাই একটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রীতিমতো গবেষণা করে চাহিদা নির্ধারণ করতে হয়। আর সে অনুযায়ী টাকা প্রিন্ট করতে হয়। টাকার ক্রয় ক্ষমতার অনিশ্চয়তার কারণে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, আর স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি হবে। যে দেশে মুদ্রাস্ফীতি হবে সে দেশের মুদ্রার দাম অন্য দেশের তুলনায় কমে যাবে। ধরা যাক, ভারতে মুদ্রাস্ফীতির হার ২০% আর বাংলাদেশের ০% অর্থাৎ ১০০ টাকার একটি দ্রব্যের মূল্য আগামীকাল হবে ভারতে ১২০ টাকা আর বাংলাদেশে ১০০ টাকা থাকবে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ১০০ টাকার মূল্য হবে ভারতের ১২০ রুপির সমান।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি পরাজিত হলে মিত্রশক্তি তাদের উপর অপমানজনক ভার্সাই চুক্তি চাপিয়ে দেয়। ক্ষতিপূরণ হিসাবে জার্মানির কাছ থেকে এক বিশাল পরিমাণ অর্থ চাওয়া হয়। কিন্তু সদ্য বিশ্বযুদ্ধ থেকে হেরে এসে তাদের কোষাগার প্রায় শূন্য হয়ে গিয়েছিলো । তাই তারা ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য অতিরিক্ত পরিমাণে টাকা ছাপাতে থাকে। ফলে, তাদের দেশে দেখা দেয় হাইপার মুদ্রাস্ফীতি। হাইপার মুদ্রাস্ফীতি গ্যালপিং মুদ্রাস্ফীতির থেকেও ভয়ংকর।
জিম্বাবুয়ে অস্বাভাবিক মুদ্রাস্ফীতির কথা আমরা জানি। ২০১১ সালে দারিদ্রতা দূর করার জন্য ইচ্ছামত মুদ্রা ছাপিয়ে ছিল, যার ফলে ঐ দেশে চরম পর্যায়ের মুদ্রাস্ফীতি (The high inflation of Zimbabwe) দেখা দেয়। সামান্য একটা পাউরুটি কিনতে এক বস্তা টাকা নিয়ে দোকানে যেতে হত। সবার কাছে অনেক মুদ্রা থাকা সত্ত্বেও সে মুদ্রার বিনিময়ে কোন সম্পদ (Goods and service) নাই। তাই ইচ্ছামতো মুদ্রা ছাপানো মোটেও ভালো নয় দেশের জন্যে।
ধরা যাক, কোন দেশে ২ টা কাঠাঁল আছে, এখন ১০ টাকার দুটি নোট ছাপানো হলো। যদি দুটি কাঠাঁলের মূল্য সমানভাবে নির্ধারণ করতে বলা হয় তাহলে কত টাকা নির্ধারিত হবে? নিশ্চয়ই একটা কাঠাঁলের দাম দশ টাকা করে নির্ধারণ করতে হবে। তাহলে দুটি কাঠাঁলের দাম হবে বিশ টাকা। এইবার কাঠাঁল সেই দুইটাই আছে, কিন্তু অতিরিক্ত আরো দশ টাকার দুটি নোট ছাপানো হল। এখন যদি কাঠাঁলের দাম নির্ধারণ করতে বলা হয় তাহলে কত হবে? অবশ্যই একটা কাঠাঁলের দাম ২০ টাকা নির্ধারণ হবে। তাহলে শেষ পর্যন্ত কি হলো? কাঠাঁলের দাম বেড়ে গেল। টাকা হচ্ছে একটা বিনিময়যোগ্য মাধ্যম মাত্র। টাকা আমাদের তৈরি করা ভ্যালুকে বহন করে। কি পরিমাণ পণ্য কিংবা সেবা দেশে উৎপাদন হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে টাকা ছাপানো হয়। এখন আসা যাক টাকা কিভাবে কাজ করে। ধরা যাক, একজন শিক্ষক স্কুলে শিক্ষকতা করেন। এখন তিনি যদি একজন রিক্সাওয়ালাকে বলেন আমি তোমাকে ইংরেজি শেখাবো আমাকে ওই জায়গায় নিয়ে চলো। সে কি নিয়ে যাবে? কখনোই না। তাহলে সমাধান? সমাধান হচ্ছে এমন একটা জিনিস সেটা সবাই গ্রহণ করবে, আর টাকা সেই কাজটাই করে। টাকা আমাদের তৈরি করা সেবাকে বিনিময়যোগ্য করে তুলে যে কোনো কিছুর সাথে। শিক্ষকতা কিন্তু একটা (skill) এটাই প্রোডাক্ট। একজন শিক্ষক প্রোডাক্ট অর্থাৎ তাঁর দক্ষতা বিক্রি করছেন আর বিনিময়ে পাচ্ছেন টাকা। রিক্সাওয়ালাও কিন্তু সেবা দিচ্ছে সে মানুষের গন্তব্যকে সহজ করছে। এটা হচ্ছে তার প্রোডাক্ট। এখন চিন্তা করা যাক, একজন ব্যক্তি যখন রিক্শায় উঠছেন এবং রিক্সা চালককে টাকা দিচ্ছে তারা কিন্তু দুজনের প্রোডাক্ট একজন আরেকজনের সাথে বিনিময় করছেন। তাহলে কোনটি গুরুত্বপূর্ন? অবশ্যই প্রোডাক্ট। একটা দেশে কি পরিমাণ পণ্য বা সেবা তৈরি হচ্ছে সেটা পরিমাপ করেই টাকা ছাপাতে হয়। প্রোডাক্ট না থাকলে কাঠাঁলের মত সব কিছুর দাম হু-হু করে বাড়তে থাকবে। তাহলে টাকা ছাপিয়ে সেটা দিয়ে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করা হলে সমস্যা কী? সে ক্ষেত্রে তো টাকা বিদেশেই চলে যাচ্ছে। আমাদের দেশে তো প্রবেশ করছে না, বিষয়টা হচ্ছে আমরা অতিরিক্ত ছাপা হওয়া টাকা দিয়ে যে দেশের ঋণই শোধ করি, যে দেশেই খরচ করি তা ঘুরে ফিরে আমার নিজের দেশেই ফেরত আসবে। কারণ, আমার দেশের মুদ্রা আমার দেশের মানুষকেই শেষ পর্যন্ত গ্রহণ করতে হবে। অন্যান্য দেশে তো আমরা এই মুদ্রায় কেনাকাটা করতে পারছি না। সুতরাং, বাড়তি টাকা ঘুরে ফিরে আমার দেশের অর্থনীতিতেই প্রবেশ করছে। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই টাকা কিন্তু আমরা সরাসরি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কাজে ব্যবহার করতে পারছি না। কারণ, ঋণের চুক্তিতে একটি নির্দিষ্ট কারেন্সীতে তা পরিশোধ করার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সাধারণত, উৎসবকেন্দ্রিক সময়গুলোতে যেমন- ঈদের আগে নতুন টাকার জন্য অনেক সাধারণ মানুষও ভিড় করে বাংলাদেশ ব্যাংকে বা খোলাবাজারে। বাংলাদেশ ব্যাংক সারা বছর ধরে ছিঁড়ে যাওয়া, পুড়ে নষ্ট হওয়া বা রি-ইস্যু করা যায় না এমন নোটগুলো ব্যাংকিং চ্যানেলে মার্কেট থেকে তুলে নেয়। যার পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা। এ ঘাটতি পূরণের জন্যও নতুন নোট সরবরাহ দরকার হয়। আরেকটি বিবেচ্য বিষয় হলো মানি মার্কেট সার্কুলেশন অর্থাৎ অর্থের প্রবাহের বিষয়টি। একটি দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন করতে বেশি করে টাকা তৈরি করা কোন সমাধান নয়, সমাধান হল উৎপাদন বৃদ্ধি করা। এর ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই