স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ সংবাদপত্রে ভুল খবর সীমাবদ্ধতা নাকি ব্যর্থতা?
১১ মে ২০১৮ ১৬:১৫
ঢাকার বাইরে এখনো যারা সংবাদপত্র পড়ে খবর জানেন, তারা আজ একটি ভুল খবর জেনেছেন। তারা জেনেছেন, বঙ্গবন্ধু-১ নামের স্যাটেলাইটটি মহাকাশে উৎক্ষেপণ হয়ে গেছে। অথচ প্রকৃত তথ্য হচ্ছে— স্যাটেলাইটটি গত গভীর রাতে (বাংলাদেশ সময়) শেষ পর্যন্ত ঊর্ধ্বাকাশে পাঠানো সম্ভব হয়নি। কাজটি পিছিয়ে গেছে পুরো ২৪ ঘণ্টার জন্য।
শুক্রবার (১১ মে) ঢাকার বাইরে, কিংবা ঢাকাতেও বিভিন্ন স্থানে বিলি করা প্রধান কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরটির শিরোনামগুলো এমন—
– মহাকাশের পথে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট: দৈনিক প্রথম আলো
– মহাকাশে জয়যাত্রা, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ: দৈনিক সমকাল
– বাংলাদেশের মহাকাশ জয়: দৈনিক যুগান্তর
– মহাকাশে এখন বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ: বাংলাদেশ প্রতিদিন
এসব খবরের কারণে পাঠকরা কি সত্যিই জানেন যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ সম্পন্ন হয়েছে? নাকি তারা প্রকৃত ঘটনাটি জেনে গেছেন? সে প্রশ্নটি করা যায়। উত্তরও সহজ— ইলেকট্রনিক ও ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে পাঠকের কাছে খবরটি পৌঁছে গেছে। তবে তা সত্ত্বেও পত্রিকান্তরে আজ তারা যে খবরটি পাচ্ছেন, সেটি প্রশ্নবিদ্ধ।
কেন ভুল খবরটি তাদের কাছে গেল— সে প্রশ্নও সামনে আসবে।
সংবাদপত্রে প্রথম সংস্করণ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ছাপাখানার ডেডলাইন, মেইল ধরানো— এমন কিছু তথ্য, তত্ত্বে তাদের হয়তো সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া যাবে। কিন্তু সে উত্তর কতটা গ্রহণযোগ্য?
বিষয়টিকে সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। কারণ ওই ডেডলাইন, মেইল ধরানোর বিষয়গুলো সংবাদপত্রের জন্য সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। তবে অভিজ্ঞ-বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক খবরটি জানতে পারা। পাঠকদের কয়েকজন সঠিক খবর জানবে, কয়েকজন জানবে না— সেটা হতে পারে না।
বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক মফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, খবরটি ঢাকায় একরকম আর ঢাকার বাইরে অন্যরকম করে উপস্থাপনায় আমি অস্বাভাবিকতা কিংবা বিচ্যুতি দেখতে পাচ্ছি।
সংবাদপত্রগুলোর ডেডলাইনের, মেইল ধরানো সীমাবদ্ধতা রয়েছে— এটা ঠিক। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তা করতে গিয়ে পেশাদারিত্বে আপোস করা যাবে, বলছিলেন তিনি।
সাংবাদিকতার নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এটি গ্রহণযোগ্য নয়— এমন মত দিয়ে সাংবাদিকতার এই অধ্যাপক বলেন, এ ক্ষেত্রে সংবাদপত্রগুলো দিনের সংবাদপত্রটি সবশেষ খবর দিয়ে প্রকাশ করতে পারত। তাতে পত্রিকাটি ছাপা হয়ে বের হতে দেরি হতো নিশ্চয়ই; তা পাঠকের কাছে পৌঁছাতেও দেরি হতো। কিন্তু সঠিক খবরটি পাঠকের কাছে পৌঁছানো যেত।
দু’জন পাঠককে স্রেফ কাছের ও দূরের বলে দুই রকম খবর দেওয়ার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়, বলেন মফিজুর রহমান।
কথা হচ্ছিল দেশে অন্যতম দুই জনপ্রিয় সংবাদপত্র দৈনিক আজকের কাগজ ও দৈনিক ভোরের কাগজের প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক ও বর্তমানে দৈনিক আমাদের অর্থনীতির সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খানের সঙ্গে। তিনি এ ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নীতি মানা হয়নি বলেই জানান। নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, এখানে সংবাদপত্র প্রকাশের সময় পর্যন্ত যতটুকু তথ্য ছিল ততটুকু দিয়েই খবর হবে। আর খবরের শিরোনামটিও হবে সে অনুযায়ী। কোনোভাবেই শিরোনাম যেন মিসলিডিং না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।
দুর্ঘটনা কিংবা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কারো যদি মৃত্যু না হয়, কিন্তু মৃত্যু হবে বলেই অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তখন অনেক সাংবাদিকই মৃত্যু হয়েছে বলে দিতে পছন্দ করেন।
‘মরবেই তো ভেবে আমরা লিখে দেই মরেছে… এটি হতে পারে না’, বলেন নাঈমুল ইসলাম খান।
স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য নির্ধারিত ক্ষণটি সনাতনি সংবাদমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্রের জন্য খুবই নাজুক সময় ছিল— এমন মত দিয়ে এই সম্পাদক বলেন, ‘সে ক্ষেত্রে সাংবাদিকতায় একটা চ্যালেঞ্জ থাকে বটে; কিন্তু তা কাটিয়ে উঠতে রিপোর্টটি লেখার ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন ছিল।’
একটু চেষ্টা করলে সময় নিরপেক্ষ একটি শিরোনাম যেমন করা যেত, খবরের বর্ণনাতেও থাকতে পারত সঠিক অভিব্যক্তি। এটি সংবাদ, ঘটনা কিংবা সাংবাদিকতার সীমাবদ্ধতা নয়, ব্যক্তি সাংবাদিক কিংবা সংবাদপত্রের সীমাবদ্ধতা— বলেন নাঈমুল ইসলাম।
সংবাদপত্রগুলো এই দিনে একটু দেরি করে প্রকাশ করতে পারত এবং তা পরে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারত কিনা— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে ব্যাকওয়ার্ড-ফরোয়ার্ড লিংকগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। আর একজন সম্পাদক হিসাবে আমি জানি, সেটা সম্ভব হয় না।
‘এখানে সংবাদ পরিবেশনায় ফেয়ার থাকাটাই ছিল সমাধান। আর সবশেষ ফ্যাক্ট দিয়েই শিরোনামগুলোও করা যেত’, বলেন নাঈমুল ইসলাম খান।
তিনি বলেন, “যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণই হয়নি, তা নিয়ে ‘মহাকাশের পথে স্যাটেলাইট’, কিংবা ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ’— এমন শিরোনাম করে খবর প্রকাশ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একে সীমাবদ্ধতা বললে সাংবাদিকতার ওপর অবিচার করা হবে।”
ঘটনাটি বাংলাদেশে সাংবাদিকতা চর্চার একটি আইকনিক উদাহরণ হয়ে থাকবে বলেও মত দেন নাঈমুল ইসলাম খান।
আগেই বলেছি, দেশের অনলাইন সংবাদমাধ্যগুলো ও টেলিভিশন চ্যানেলের কল্যাণে পাঠকের কাছে খবর রয়েছে যে স্যাটেলাইটটি রাতে উৎক্ষেপণ হয়নি। তাহলে কি ডিজিটাল মাধ্যমই এখন হয়ে উঠছে সবচেয়ে ভরসার স্থল?
সে প্রশ্নটি রাখা হলে বাংলাদেশে ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমের পাইওনিয়ারখ্যাত দু’টি জনপ্রিয় অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিডিনিউজ২৪ ডটকম ও বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম’র প্রতিষ্ঠাতা এডিটর ইন চিফ আলমগীর হোসেন বলেন, ‘এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর সে কারণেই সংবাদপত্রগুলোও তাদের ডিজিটাল ভার্সন চালু করে তার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।’
তবে এখানে মাধ্যমটির গুরুত্বের চেয়েও সাংবাদিকতার চর্চার ওপর বেশি গুরুত্ব দেন আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, খবর আসলে যখন যেমন, তখন তেমন। সে কারণেই অনলাইন সেভাবে খবর প্রকাশের সুবিধাটি পায়। সংবাদমাধ্যম হিসেবে সংবাদপত্র সেটা পাবে না। তাদের উচিত যতটুকু পাবে, ততটুকু খবরেই সীমাবদ্ধ থাকা। কী ঘটবে, সেটা ঘটে গেছে বলে লিখে দেওয়া সাংবাদিকতা চর্চায় মেনে নেওয়া যাবে না।
তবে খবরের আপডেট পাঠক জানতে চায়। সে কারণে অনলাইন পোর্টালগুলোই ভরসার স্থান হয়ে দিনে দিনে আরও বিস্তৃত হচ্ছে, বলেন আলমগীর হোসেন।
একই ধরনের কথা বলেন অধ্যাপক মফিজুর রহমানও। তিনি বলেন, প্রযুক্তিকেন্দ্রিক সংবাদমাধ্যমগুলোই এখন সবশেষ আপডেট পেতে পাঠককে সহায়তা করছে। সে কারণে প্রতিযোগিতার বাজারে তারাই এগিয়ে থাকবে।
‘তবে এই মাধ্যম এখনো দেশের সব মানুষের কাছে পৌঁছায়নি। এখনো মানুষ সংবাদপত্র পাঠে অভ্যস্ত। তাদের সামনে ভুল খবর তুলে ধরা মোটেই উচিত কাজ নয়’, বলেন মফিজুর রহমান।
অনলাইনকে এই সময়ের রিয়েল নিউজ প্ল্যাটফর্ম বলে উল্লেখ করেন বেশ কয়েকটি দৈনিক সংবাদপত্রের জনক নাঈমুল ইসলাম খানও।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সারাবাংলা ডটনেট
সারাবাংলা/এমএম