Friday 11 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অধীর স্যারের দেশত্যাগ এবং আমেরিকার উদ্বেগ

অরুণ কুমার গোস্বামী
১২ জুলাই ২০২৩ ১৪:১২

অধীর সারের দেশত্যাগ নিয়ে তিনি নিজে বা তার আত্মীয়স্বজন বিব্রত নন, যেমনটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছয়জন কংগ্রেসম্যান উদ্বিগ্ন। ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলাই ভালো। হঠাৎ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট কংগ্রেসের ছয় জন সম্মানিত সদস্য বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু ও খ্রিস্টানদের ভাগ্য নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন! এব্যাপারে কিছু একটা করার জন্য তারা সেদেশের প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাইডেনের কাছে চিঠি দিয়েছেন! বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া নিয়ে তাদের উদ্বেগ ও উৎকন্ঠা দেখে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গণহত্যার সময় তারা কেন সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকা পালন করেছিল তা অনেকের মনেই প্রশ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে! একাত্তরে বাংলাদেশের গণহত্যায় আমেরিকান সরকারের সমর্থনের কথা মণে করে অনেকেই মানবাধিকার নিয়ে বর্তমান আমেরিকার বাড়াবাড়ি রকমের দৌঁড়-ঝাপকে ‘কুম্ভিরাশ্রু’ হিসাবেই গণ্য করছেন! ১৯৭১ সালে আমেরিকার বন্ধু এবং আমেরিকার অস্ত্র-শস্ত্রে সমৃদ্ধ পাকিস্তানের সেনাদের ভয়ে ১ কোটি বাঙালি প্রাণ বাঁচাতে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল! তখন সরকারিভাবে আমেরিকা কিছুই করে নি। বরঞ্চ পাকিস্তানকেই তারা অব্যাহতভাবে মদদ দিয়েছে। এখন হঠাৎ একেবারে উঠে পড়ে লেগেছে দেখে আমেরিকার বন্ধুত্বের প্রকারভেদ সম্পর্কে অভিজ্ঞ সুধী জনেরা মুচকি হাসি দিচ্ছেন! ডাল মে কুচ কালা হ্যায়!

বিজ্ঞাপন

অধীর স্যারের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। এবার (২০২৩-এ) ইদুল আজহার ছুটিতে গিয়েছিলাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। উদ্দেশ্য, চিকিংসা এবং বেড়ানো। যেমনটি বেশীর ভাগ বাংলাদেশের বাঙালিদের ভারত ভ্রমণের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। সেখানে পৌঁছানোর পরের সন্ধ্যায় স্বস্ত্রীক গিয়েছিলাম অধীর স্যারের সাথে দেখা করতে। তিনি সপরিবারে দেশ (বাংলাদেশ) ত্যাগ করেছেন অতি সম্প্রতি। ২০১৮-১৯ সালের দিকে। না কেউ তাকে তাড়িয়ে দেয় নি। অবশ্য, তার ভাই-বোনেরা সবাই অনেক আগে থেকে পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অন্যান্য জায়গায় বসবাস করছেন। একমাত্র মেয়ে থাকে বাংলাদেশে। মেয়ে জামাই বাংলাদেশের বিচার ক্যাডারের একজন উর্ধ্বতন জজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রাক্তন ছাত্র।

বিজ্ঞাপন

সুদূর অতীতে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে ছিল ‘বঙ্গ প্রদেশ’। অপ্রিয় হলেও সত্যি যে, ১৯৪৭ সালের আগে, যখন বাংলা তথা ভারতীয় উপমহাদেশ বিভক্ত হয়নি তখন বর্তমান বাংলাদেশের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপন বা প্রাত্যহিক কর্মকান্ডের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল পশ্চিমবঙ্গ এবং বিশেষত কোলকাতা। এটি বিপরীত দিক থেকেও কিছুটা হলেও সত্যি ছিল! বঙ্গভঙ্গের আগে যখন ঢাকা কেন্দ্রিক জীবনযাপন সক্রিয় হয়ে ওঠে নাই তখন এমনটাই ছিল। ভুগোল, প্রাত্যহিক জীবন-যাপন, এবং সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের স্বাভাবিক ঘনিষ্টতা ঐতিহাসিকভাবেই এপার ও ওপারের জনগণকে অবিচ্ছেদ্য সূত্রে গেঁথে রেখেছিল। ব্যাপারটি আফগানিস্তান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প ‘কাবুলিওয়ালা’র প্রধান চরিত্র ছিলেন কাবুলের বাসিন্দা। এই ছোট গল্পটি ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয়। সুদূর আফগান্তিান থেকে কোলকাতা বা তার আশে-পাশে বানিজ্যের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন এই কাবুলওয়ালা। আলোচিত এই কাবুলিওয়ালার নাম হচ্ছে রহমত শেখ। ফল বিক্রি করতে সে কলকাতায় আসে। সেখানে বাঙালি এক লেখকের ছোটো বাঙালি মেয়ে মিনির সঙ্গে তার ভাব জমে। মিনিকে দেখে কাবুলে ফেলে আসা তার নিজের মেয়ের কথা মনে পরে। রহমত একটি বোর্ডিং হাউসে নিজের দেশের লোকেদের সঙ্গে থাকতেন এবং তার ব্যবসা চালিয়ে যেতেন।

সুদূর আফগানিস্তান থেকে বাংলা মুলুকে আসা যাওয়ার জন্য তখন নিশ্চয়ই কোন পাসপোর্ট ভিসার দরকার হত না। যেমন নিকট প্রতিবেশী বর্তমান বাংলাদেশ সেসময়ের পূর্ব বঙ্গের ক্ষেত্রেও হত। জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তার কোলকাতার ছাত্র ও রাজনৈতিক জীবনের অনেক স্মরণীয় ঘটনার কথা উল্লেখ দেখা যায়। উপমহাদেশ তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর রাজনীতির যুগস্রষ্টা জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার বয়সী অনেকেই তিনটি ঐতিহাসিক ‘সময়-কালের’ মানুষ ছিলেন। তাদের কেউ কেউ এখনও জীবিত আছেন! আবার অনেকেই ইহধাম ত্যাগ করেছেন! এভাবে ভারতের সাথে অবিভাজ্য ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা বা স্মৃতিচারণের কথা স্বাধীন বাংলাদেশের অনেকেই বলেছেন বা লিখেছেন। ভবিষ্যতেও হয়তো বলবেন বা লিখবেন।

কিন্তু ভুগোলের সাথে যখন রাজনীতির সংমিশ্রণ ঘটেছিল তখন থেকেই বর্তমান আমেরিকার ‘ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠি’ লেখার রসদ ও এগুলোর সাম্প্রদায়িক উপাদান সৃষ্টি হওয়া শুরু করেছিল! এটি একটি ঐতিহাসিক সত্য যে এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িকতার মূল স্পন্সর ও চিফ প্যাট্রন বা প্রধান পৃষ্ঠপোষক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসককূল। বর্তমান বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্বসুরী বিশ্ব মোড়ল ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি। তারা (ব্রিটিশ শাসকেরা) যখন এটিকে লালন পালন করে উন্মুক্ত চর্চার জন্য ছেড়ে দিয়েছিল তখন উপমহাদেশের জনগণ তখন থেকে সাম্প্রদায়িকতার অসহায় শিকারে পরিণত হচ্ছে। আর এখন আধুনিক পরিভাষায় ‘মানবাধিকার রক্ষার’ নামে আমেরিকা সাম্প্রদায়িকতাকে পাহাড়া দিচ্ছে!

ছয়জন কংগ্রেসম্যান তাদের চিঠিতে যা লিখেছেন তার মর্মার্থ হচ্ছে অগ্নি সংযোগ, লুটপাট, মন্দির এবং দেব-দেবীর মূর্তি ভাঙ্গা, হত্যা, ধর্ষণ, এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের ফলে বাংলাদেশের হিন্দরা দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছে। এই সাথে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকেরাও সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বিদের আক্রমনের শিকার হচ্ছে। আলোচিত অধীর স্যারের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এবং তার পরে কিছু মন্তব্য দ্বারা ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠির বিষয়বস্তুর সঠিকতা উপলব্ধি করা যেতে পারে। না কি, তিনি স্বেচ্ছায় দেশ ছেড়েছেন?

তবে, অধীর স্যারের দেশত্যাগের কারণের বাইরে অনেক কারণে অনেকে দেশত্যাগ করেছেন এবং করছেন। এক্ষেত্রে বিশেষত: হিন্দুদের দেশত্যাগের কারণের প্রতীকি কারণ হিসাবে বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। অধীর স্যারের মত হিন্দু ধর্মাবলম্বী অনেকেই দেশত্যাগ করে প্রতিবেশী ভারতে বসবাস করছেন। তিনি তাদেরই একজন। বাংলাদেশ ছেড়ে পশ্চিম বঙ্গের এক নিভৃত পল্লীতে একাকি জীবন যাপন করছেন। অধীর স্যারের সাথে দেখা করার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ফেসবুকে’ পোস্ট করেছিলাম। তাতে পরিচিত ঘনিষ্ঠ বা আত্মীয় স্বজন অনেকেই মন্তব্য করেছেন। এই পোস্টের নীচে অধীর স্যারের ছোট ভাই মন্তব্য করেছেন, “আমাদের মেঝদা (অধীর স্যার) একাকি জীবন যাপন করছেন না, আমার মেজ বৌদি … কিছুদিন আগেই গত হয়েছেন… বর্তমানে অধীরদার ছেলে চন্দন, পুত্রবধু ও নাতনি আছে ওনার সঙ্গে… তাই ‘একাকি’ শব্দের প্রতি আমার ও আমাদের. . . পরিবারের প্রবল আপত্তি আছে! মার্জনা করবেন।” প্রশ্ন হচ্ছে এধরনের আপত্তি আমেরিকার ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে দেয়াটাও অপ্রাসঙ্গিক হবে কি? উল্লেখ্য, অধীর স্যারের ছোট ভাইও বাংলাদেশ ত্যাগ করে এখন পশ্চিম বঙ্গের বাসিন্দা, ভারতীয় নাগরিক। যারা এখান থেকে দেশত্যাগ করে চলে গিয়েছেন তাদের বেশীরভাগ নিজেদের প্রয়োজনে তা করেছেন এবং তারা ভালোই আছেন! তাই ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠির বিষয়বস্তু যে সঠিকতা বা বাস্তবতা থেকে বেশ খানিকটা দূরে তা বলাই বাহুল্য! তবে প্রশ্ন থেকে যায় ১৯৭১ পরবর্তী বাংলাদেশে কোন সরকার এই সমস্যা সমাধানের জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং কোন সরকার সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেছে? নি:সন্দেহে বলা যায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট নির্বাচিত বঙ্গবন্ধু সরকারকে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে প্রতিটি সামরিক সরকার রাজনীতিতে ধর্মেও ব্যবহারের জন্য সাম্প্রদায়িকতাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে লালন পালন করেছে।

বর্তমান আলোচনার শেষ পর্যায়ে ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক নীতি নায়ার-এর, ‘হার্ট সেন্টিমেন্টস: সেক্যুলারিজম অ্যান্ড বিলংগিং ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক বইয়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। অন্যান্য কিছুর পাশাপাশি লেখক এই বইটি শুরু করেছেন ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভায় সেদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি অমিত শাহের দেয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতার মধ্যে লিয়াকত-নেহেরু চুক্তির যে উধৃতি দেয়া হয়েছিল তা’ দিয়ে। ১৯৫০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুর মধ্যে ভারত, তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশ এবং সমগ্র পাকিস্তানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা, সদ্য বিভক্ত দেশগুলির মধ্যে তাদের স্থান নিশ্চিত করা এবং স্বাধীনতা ও দেশভাগের পরে সংঘটিত সহিংসতা ও বাস্তুচ্যুতির অবসান ঘটাতে লিয়াকত-নেহেরু চুক্তি বা দিল্লী চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। ‘হার্ট সেন্টিমেন্টস’ গবেষণা গ্রন্থে নীতি নায়ার সেই সময় থেকে অদ্যাবধি এবিষয়ের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেছেন। যেখানে আলোচনায় উঠে এসেছে বিভিন্ন রিপোর্ট এবং ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে। এই সমস্যা দীর্ঘকালের! দীর্ঘ দিনের এই সমস্যা সম্পর্কে হঠাৎ করে একটা চিঠির মাধ্যমে তুলে ধরার প্রেক্ষিতে যেবিষয়টি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হচ্ছে বর্তমান সরকারই একমাত্র বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সমস্যা সমাধানের বিষয়ে ইতিবাচক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর অতীতের সামরিক শাসকেরা সংবিধানে যে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ বপন করেছিল তাও দূর করার প্রয়োজনে ১৯৭২ সালের সংবিধানে দেশকে ফিরিয়ে নিয়েছেন। অর্পিত সম্পত্তি আইন বাতিল করা হয়েছে। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন ও সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। এগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু কন্যা সংখ্যালঘু নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা করছেন। এরপর আর যা যা করার তাও আওয়ামী লীগ সরকার করবেন বলে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণের অধিকাংশ বিশ্বাস করেন। যা অন্য কোন রাজনৈতিক দলের সরকার এপর্যন্ত করে নাই।

লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ। সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সারাবাংলা/এসবিডিই

অধীর স্যারের দেশত্যাগ এবং আমেরিকার উদ্বেগ অরুণ কুমার গোস্বামী মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর