Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রকল্প নির্মাণে প্রকৃতির প্রতিশোধ চাই না

রাজন ভট্টাচার্য
১৭ জুলাই ২০২৩ ২০:৪১

প্রকৃতিকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেয়া উচিত। প্রকৃতি যদি কোথাও বাঁধাগ্রস্ত হয় তবে সে দমে থাকে না। এর বিরুপ প্রভাব সময়ে স্পষ্ট হয়। অর্থাৎ প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয়। তা কম, বেশি হতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাবে গোটা পৃথিবী আক্রান্ত।

ভারতের কোন কোন অঞ্চলে রেকর্ড বন্যা হচ্ছে। একারণে জানমালের ক্ষতি হচ্ছে। উজানের বানের পানিতে বাংলাদেশের অনেক নদী-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে নিম্নাঞ্চলে অকাল বন্যা দেখা দিয়েছে। গতবারের মতো এবারও কমবেশি বন্যায় ভাটিসহ বিভিন্ন এলাকার জনপদ আক্রান্ত হলেও দেশে মধ্যবর্ষাতেও আশানুরূপ বৃষ্টির দেখা নেই।

বিজ্ঞাপন

সাম্প্রতিক সময়ে ভাটি অঞ্চলে নির্মাণ করা হয়েছে ‘অল ওয়েদার সড়ক’। এ নিয়ে উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনার শেষ নেই। শোনা যায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোন রকম সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে কিন্তু সংশ্লিষ্ট এলাকায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। গত বছর ভাটিতে বন্যার সময় ঢালুতে পানি নামতে সমস্যা হচ্ছিল মূলত এই সড়কের কারণে। স্থানীয় লোকজন কয়েক বছরের মধ্যে উন্নয়নের নেতিবাচক প্রভাব উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। এই সড়কের কারণে ভাটির হাওরের একাংশের জমিতে পলি পরতে শুরু করেছে, এতে ফসল উৎপাদন কমছে। উঁচু হয়ে যাচ্ছে অনেক জমি।

এমনিতেই নানা কারণে ভাটির হাওরগুলোতে এখন আর বছরজুড়ে পানি থাকে না। খননের অভাবে নাব্যতা হারিয়েছে নদ নদীগুলো। খাল, নদী থেকে শুরু করে জলাশয় ভরাট, দখলের থাবা চলছেই, বদলে যাচ্ছে অনেক নদীর গতিপথও।

এরমধ্যে ‘অল ওয়েদার সড়ক’ নির্মাণের পর প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর বিরুপ প্রভাব সরকারের কানেও গেছে। সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নানকে বলতে শুনেছি, হাওর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন আর কোন প্রকল্প হবে না। সেখানে উড়াল সড়ক হবে। সরকারের এই উপলব্দি হাওরের রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করবে, এটা শুধু হাওরের লোকজনই ভালো বুঝেন।

বিজ্ঞাপন

২০০৯ সাল থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলে আসছেন, কৃষি জমি ও মিঠাপানি ভরাট ও নষ্ট না করা। অর্থাৎ প্রকৃতিকে সুরক্ষিত রাখার পাশাপাশি খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে মিঠা পানির মাছ রক্ষার পরিস্কার বার্তা দিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতি আর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষিতে খাদ্য সংকটের শঙ্কা থেকে পতিত সকল জমি চাষাবাদের আওতায় আনার বারবার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের কারণে উন্নয়ন জরুরি। তা আটকানো যাবে না। কিন্তু উন্নয়ন মানেই হলো পরিকল্পিত ব্যবস্থা। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে উন্নয়ন করা মানেই এর খেসারত দিতে হবে। তাই উন্নয়নের নামে এমন কিছু নষ্ট বা ক্ষতি করা উচিত- যার বিপরীত কোন প্রভাব নেই।

প্রধানমন্ত্রীর কৃষি জমি আর জলাশয় ভরাট না করার বার্তা কী মাঠ পর্যায়ে কেউ শুনেছে? প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রীর নামেই প্রকল্প স্থাপন হয়েছে এমন নজিরও আছে। নেত্রকোনায় ‘শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়’র নামে প্রায় ৫০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এটি একটি বড় বিল। সাত মাসের বেশি সময় ধরে হাজারো মানুষ বিল থেকে মিঠা পানির মাছ খেতে পারত। বিলের জলের শাপলা, শালুক থেকে শুরু করে প্রাকৃতিক নানা সম্পদ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত অনেকেই। সেইসঙ্গে ধান উৎপাদন হতো পুরো মাঠজুড়ে। তদারকি ছাড়া এক প্রকল্পের কারণে ধান, মাছ থেকে শুরু করে জীববৈচিত্র সবই গেল। যখন খাদ্য সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ প্রতিদিন চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন উর্বর ৫০০ একর জমি রাতারাতি বালু ফেলে ভরাট হয়েছে। এটা সরাসরি প্রকৃতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা। যার নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।

এটাই কি শেষ? সারাদেশে এমন হয়ত অসংখ্য প্রকল্প করা হয়েছে- যা নীতিনির্ধারকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। এতে ক্ষতি হয়েছে প্রকৃতি আর স্থানীয় মানুষের। প্রকল্প হবে কিন্তু কোন নজরদারি ছাড়াই এটা সত্যিই মেনে নেয়া যায় না। যদি সত্যিকারের নজরদারি থাকত তাহলে একে একে এতবড় সর্বনাশ হতো না। উদ্যোক্তারা এককভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে হয়ত তাকিয়েছেন। অন্যদিকে নজর দেয়ার সময়, সুযোগ ছিল না। কিন্তু তারাও তো সচেতন মানুষ, শিক্ষিত। ভালো মন্দ বোঝার কথা। কারও মধ্যে কী সর্বনাশের যন্ত্রণা হৃদযন্ত্রে একবারের জন্যও উপলব্দি হয়নি? একথা ভাবতেও অবাক লাগে।

সবশেষে হাওড় এলাকার বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখে সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি অধিগ্রহণ এবং অধিকৃত জমিতে জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণের আহ্বান জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। অর্থাৎ হাওরবাসী আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় পাচ্ছে।

গত ১৭ জুলাই ইউজিসিতে সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের লক্ষ্যে একটি সমীক্ষা প্রকল্প প্রস্তাবনার ওপর অনুষ্ঠিত পর্যালোচনা সভায় এ আহ্বান জানানো হয়। সভায় ইউজিসির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর এ আহ্বান জানান।

তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ‘পরিবেশ ধ্বংস করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প করা যাবে না। অপরিকল্পিত অবকাঠামো নির্মাণের ফলে হাওড় ও উপকূলে বন্যা ও জলাবদ্ধতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাওড় এলাকায় জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবেশ ও প্রকৃতির গতি প্রকৃতিকে সবসময় মাথায় রাখতে হবে। জমি অধিগ্রহণ করতে হবে আর্থ-সামাজিক প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে। এছাড়া জলাধার ভরাট না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।’

প্রশ্ন হলো এই প্রকল্প নির্মাণে ইউজিসির আহ্বান কতটুকু কার্যকর হবে? এ নিয়ে প্রশ্ন থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যেখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানের কেউ তোয়াক্কা করেন না, সেখানে ইউজিসি তো প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে ক্ষমতাধর নন।

এটা বিশ্বাস করি প্রধানমন্ত্রী যদি খবর পেতেন তাহলে জলাশয় আর ধানের জমি ভরাটের পাশাপাশি মাছ আর জীববৈচিত্র ধ্বংস করে তার নামে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণে কোন অবস্থাতেই সম্মত হতেন না। এমনকি এমন সর্বনাশ করা কোন প্রকল্পই বাস্তবায়নে তিনি মত দিতেন না। যা হয়েছে, তা মেনে নেয়া ছাড়া – কোন সমাধান আর হাতে নেই।

তাই শেষ কথা হলো; এ ধরণের প্রকল্প নির্মাণে কেন্দ্র থেকে তদারকি দরকার। প্রকল্পের জায়গা চূড়ান্ত হওয়ার পর উচ্চ পর্যায়ে (প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়) পরিদর্শন শেষে অনুমতি সাপেক্ষে নির্মাণ কাজ শুরু হলে প্রকৃতি সুরক্ষিত থাকবে। সবচেয়ে ভালো হয় পরিবেশ ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্র ছাড়া কোন অবস্থাতেই এ ধরণের উন্নয়ন প্রকল্প করা যাবে না। কয়েকস্তরের নজরদারির পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেও এর মধ্যদিয়ে সরাসরি জবাবদিহিতার আওতায় আনা সম্ভব। এতে কৃষি জমি ও মিঠা পানির মাছ আর জলাশয় নষ্ট হবে না। দেশে খাদ্য খাটতি নিয়ে দুঃশ্চিন্তা কম হবে। প্রকৃতির প্রতিশোধও কমবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

প্রকল্প নির্মাণে প্রকৃতির প্রতিশোধ চাই না মত-দ্বিমত রাজন ভট্টাচার্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর