Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিএনপির মাথায় পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক ভূত

তাপস হালদার
২০ জুলাই ২০২৩ ১৪:৫৮

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে রাজনৈতিক উত্তাপ ততই বাড়ছে। বিএনপি বরাবরের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গো ধরেছে। দশ দফা, সাতাশ দফা, একত্রিশ দফার পর এখন এক দফা দিয়েছে। সেটা হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। যদিও বিগত দশ বছর ধরে তারা একই দাবি করে আসছে। এর মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই। বিএনপি প্রধান বেগম খালেদা ২০১৩ সালেই এক দফা দিয়েছিল। সেটা তো এখন বলবৎ আছে। এরপর বিগত দুইটি নির্বাচন হয়ে গেছে, একটি নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও অন্যটিতে অংশগ্রহণ করেছে। তারপরও কিন্তু তারা দাবি থেকে সরে আসেনি। আসলে তাদের একদফা মানে ক্ষমতায় যাওয়ার নিশ্চিত গ্যারান্টি। কিন্তু নির্বাচনী ট্রেন তো আর বন্ধ থাকবে না কেউ যদি উঠতে ব্যর্থ হয় তাহলেও ট্রেন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।

বিজ্ঞাপন

বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে গলা ফাটাচ্ছে, কিন্তু এই ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য তো তারাই শতভাগ দায়ী। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর সংবিধান সংশোধন করে সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের বয়স পঁয়ষট্টি থেকে সাতষট্টি করেছিল। এটা কোনো শুভ উদ্দেশ্য করা হয়নি। এর পিছনে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। তখন ছিল সংবিধান অনুযায়ী সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রধান হবেন। বিএনপি তাদের পছন্দ মতো কে এম হাসানকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করার জন্য এই আয়োজন করেছিল। কে এম হাসানকে ২০০৩ সালের জুন মাসে জ্যেষ্ঠতা লংঘন করে দুই জনকে ডিঙ্গিয়ে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এতকিছু করা হয়েছে শুধুমাত্র তাদের একান্ত বাধ্যগত লোককে তত্ত্বাবধায়ক সরকার করবে বলে।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগের তীব্র আন্দোলনের মুখে ২০০৬ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে দায়িত্ব নিতেকে এম হাসান অপারগতা প্রকাশ করেন। সংবিধান অনুযায়ী সদ্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি দায়িত্ব না নিলে তার আগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা। এভাবে চারটি বিকল্প ব্যবস্থা সংবিধানে ছিল।কিন্তু মাঝখানের বিকল্প গুলো অনুসরণ না করে সর্বশেষ বিকল্প নিজেদের পছন্দের রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার করে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন বেগম খালেদা জিয়া। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ক্ষমতা গ্রহণ করে এমন পক্ষপাতমূলক আচরণ শুরু করলো যে,তিনি জনগণের কাছে বেগম খালেদা জিয়ার ‘ইয়েস ম্যানে’ পরিনত হলো। এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের অভিযোগ নয়, তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের চারজন সদস্য অনাস্থা জানিয়ে পদত্যাগ করলে, শুরু হয় নতুন সংকট।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটের তীব্র আপত্তির মুখেও ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল ইয়াজউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সরকার ও জনগণের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ভেঙ্গে দেয়। ক্ষমতা দখল করে সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

তিন মাসের জন্য ১/১১ সরকার দায়িত্ব নিয়ে দুই বছর পর্যন্ত ছিল। বিরাজনীতিকরণ করার প্রকৃয়া হিসেবে দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার ষড়যন্ত্র শুরু করে। মিথ্যা দুর্নীতির মামলা দিয়ে প্রথমে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এবং পরবর্তীতে বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। এছাড়া খালেদা জিয়ার দুই পূত্রকেও গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়। আজ যে তারেক রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করছে তাকেই তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাজনীতি ছাড়ার মুচলেকা দিয়ে বিদেশে যেতে বাধ্য করেছে। বেগম খালেদা জিয়া যে মামলায় সাজা ভোগ করছেন সেটাও তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দেয়া মামলা।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত চারটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে। কোনো নির্বাচনই ত্রুটি মুক্ত ছিল না। পরাজিত দল স্থুল বা সুক্ষ্ম কারচুপির অভিযোগ করেছে। সর্বশেষ যে ২০০৭ সালে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়ে তিন মাসের সরকার দুই বছর ছিল। এই সময়ে তারা শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তি নয়, ব্যবসায়িক ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ, প্রশাসন, বিচারবিভাগ এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তারা হস্তক্ষেপ করে নি। বাংলাদেশকে একটি বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছিলো। সর্বশেষে তারাও জনতার চাপে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। এমন পরিস্থিতিতে কেউ যেতে চায়। গত ব্যবসায়ী সম্মেলনে ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে সে কথাটিই বলেছেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ বাতিল করেনি। এটি করেছে মহামান্য আদালত। ২০১১ সালের মে মাসে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রীম কোর্ট সংবিধানের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় প্রদান করে। অনির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হওয়ার সুযোগ সংবিধানে রাখা সাংঘর্ষিক এই বিষয় গুলো আদালত বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছে। তবে আদালত এ বলেছিল যদি সংসদ চায় তাহলে পরবর্তী দুইটি নির্বাচন অনির্বাচিত সরকারের অধীনে হতে পারে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যদি সংসদ চায় এটা বলা হয়েছে। তবে সংসদ সদস্যরা একবাক্যে বলেছে তারা আর নির্বাচিত সরকারে ফিরে যেতে চায়না। তাহলে বিষয়টি এখানে শেষ। এটা নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই। বরং সংসদে ২০১১ সালের ৩০ জুন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ও নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিল সংসদে উত্থাপিত হয় এবং এটি সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নামে গৃহীত হয়।

পৃথিবীর এক মাত্র দেশ পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু আছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতার সম্মতিতে এক অনির্বাচিত ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হওয়ার বিধান আছে। যদি তারা ঐক্যমতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়, তাহলে দুই দলের চারজন করে সংসদ সদস্য মিলে সংসদীয় বোর্ড সিন্ধান্ত নিবে। তারাও যদি তিন দিনের মধ্যে ঐক্যমতে পৌঁছাতে না পারলে তাহলে সর্বশেষ নির্বাচন কমিশনের উপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগের দায়িত্ব অর্পিত হয়। এরপর কমিশন দুই দিনের মধ্যে নতুন নাম ঘোষণা করবে। এটাই সংবিধানের বিধান।

আধুনিক গণতন্ত্রের সূতিকাগার যুক্তরাজ্য ও বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ ভারতসহ পৃথিবীর প্রতিটি দেশে নির্বাচনের সময় নির্বাচিত সরকারই ক্ষমতায় থাকে। নির্বাচন পরিচালনা করে নির্বাচন কমিশন। সেসব দেশে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার পরই বর্তমান সরকারই আপনাআপনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। এই সরকার কোনো নীতি নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কেবলমাত্র দৈনন্দিন কাজই পরিচালনা করে থাকে। মন্ত্রীরা কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে যেতে পারবেনা। কোনো প্রকার প্রতিশ্রুতি জনগণকে দিতে পারবেনা। সংসদ বিলুপ্ত থাকবে। বর্তমানে বাংলাদেশেও তাই হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে নির্বাচন করে নির্বাচন কমিশন। একটি ভালো নির্বাচন করার জন্য তারাই যথেষ্ট। কারণ তারা সাংবিধানিক ভাবে দায়িত্ব ও ক্ষমতা প্রাপ্ত। তারা কারো অধীনে কাজ করেনা। বরং নির্বাচনের সময় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের অধীনে কাজ করে থাকে। নির্বাচন কমিশনের আদেশ নির্দেশ মানতে তারা বাধ্য থাকে।

এখন প্রশ্ন হলো আমরা কি বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে শিখবো নাকি পাকিস্তানের মতো একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র থেকে শিখবো। নিশ্চয়ই আমরা উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলো থেকে শিখবো। আর যাদের পাকিস্তানি তত্ত্বাবধায়ক ভূত মাথায় চেপেছে, তাদের কাছে বাংলাদেশের জনগণ মাথা নত করবে না। এটাই বাস্তবতা।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এসবিডিই

তাপস হালদার বিএনপির মাথায় পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক ভূত মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর