মানবাধিকার লঙ্ঘনের মহিরুহ: বিএনপি-জামায়াত শাসনকাল
২২ জুলাই ২০২৩ ১৯:৩১
গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি অপরিহার্য বিষয়। নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের সামনে তাদের ভবিষ্যত কর্মসূচী উপস্থাপন করে। ভবিষ্যত কর্মসূচীর পাশাপাশি অতীতে যেসব কর্মসূচী দেয়া হয়েছিল তা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে বা কতটা বাস্তবায়িত হয় নাই, বা আদৌ হবে কি না (?), সে সম্পর্কে জনগণের কাছে কৈফিয়তের সুরে অনেক কথা বলা/লেখা হয়ে থাকে। আবার অতীতে, সরকার পরিচালনার দায়িত্বে থাকাকালে কোন অপরাধমূলক কাজ যদি শাসক দল করে থাকে সে সম্পর্কেও ভোটারদের কাছে কৈফিয়ত বা ক্ষমা চাওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু বিশেষত ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বা তারও আগে ১৯৭৫-এর পরে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল, সামরিক শাসন জারি, অবৈধভাবে সংবিধানে সংশোধন এনে সাম্প্রদায়িকতার বিষ বপন করা হলেও এ সম্পর্কে বিএনপি-জামায়াত জোট একেবারে নিশ্চুপ। দৃশ্যত, বিএনপি-জামায়াত জোট মনে করছে তাদের অতীত কর্মকান্ডের জন্য কোনদিনই ভোটারদের কাছে দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন নেই। তাদের এই মনোভাবের সাথে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারের নির্দেশে সেদেশের সেনাবাহিনী যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছিল এবং এর জন্য কোনদিনই সেদেশ বা বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হয় নাই। তারই পুনরাবৃত্তি মূলত আমরা বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতা কর্মীদের মনোভাবের মধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বিএনপি-জামায়াত জোটের শরীকদের এই মূহুর্তের দৌঁড়ঝাপ নির্বাচন কেন্দ্রিক, কিন্তু জবাবদিহিমূলক নয় কিছুতেই। তাদের আচরণ শুধু ভোট দানের মধ্যে সীমিত। কিন্তু গণতন্ত্র কি শুধু ভোট দানের বা তাদের ভাষা অনুযায়ী সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, অবাধ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ? বিএনপি-জামায়াত জোট চাচ্ছে জনগণের বা ভোটারদের মনের চাহিদা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারবে না। এটুকু চাওয়ার মধ্যেই তারা এদেশের মানুষের মনোভাব আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। আসলে কি তাই? আসলে তাই নয়। জবাব দেওয়ার জন্য অনেক প্রশ্নের উত্তর বিএনপি-জামায়াতের জন্য অপেক্ষা করে অছে বিশেষত ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে। এদেশের মানুষের মনে এমনসব ভুরি ভুরি প্রশ্ন জেগে আছে। নীচে এমন প্রশ্ন উদ্রেগকারী ঘটনার মধ্য থেকে “মানবাধিকার লঙ্ঘনের মহিরুহ: বিএনপি-জামায়াত শাসনকাল” শিরোনামে তার কিছু “তুচ্ছ” ঘটনা তুলে ধরছি।
‘ভ্যানিটি ব্যাগে করেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড নিয়ে এসেছিলেন গ্রেনেড হামলার প্রধান টার্গেট তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনা’, “আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে”, ‘পূর্নিমা রানী শীলের বয়স কম ছিল তাই তার মা ধর্ষকদের প্রতি অনুরোধ করেছিলেন তাকে নির্দয়ভাবে শ্লীলতাহানি না করার জন্য’, অথবা বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের দ্বারা নির্মমভাবে হত্যার শিকার প্রিন্সিপাল গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীর মস্তিস্কের ঘিলু বের করা ছবি এসবই বাংলাদেশের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সংখ্যালঘু নির্যাতনের নির্মম ইতিহাসের কিছু চিত্র যা যুগ যুগ ধরে মানুষ মনে রাখবে। শিবির ক্যাডার ও তার সহযোগীরা ২০০১ সালের নভেম্বর মাসে অধ্যাপক মুহুরীকে তার নিজ বাড়িতে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে এবং পরে বিএনপি-জামায়াত জোট কুখ্যাত অপরাধী ও চরমপন্থীদের সশস্ত্র করে। খালেদা জিয়ার নির্দেশে জোটের নেতারা বিএনপির পক্ষে কাজ করার বিনিময়ে খালাসের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসব সন্ত্রাসীদের সঙ্গে চুক্তি করেন। ঢাকার হাওয়া ভবন থেকে, তারেক রহমান রাজধানীর শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আশ্বস্ত করেছিলেন যে তারা দায়মুক্তির সাথে তাদের অপারেশন চালাতে পারে। এর ফলে নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ কর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা ও সহিংসতার ঢেউ শুরু হয়।
২০০১ সালের নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে বিএনপি-জামায়াত জোটের দ্বারা সংখ্যালঘু সম্প্র্রদায়ের উপর নিপীড়ন বেড়ে যায়। ২০০১ সালের অক্টোবরের নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে, এই সন্ত্রাসীরা যশোরের আট উপজেলায় লক্ষাধিক হিন্দু ভোটারদের বাড়িতে হামলা চালায়। ভোট দিলে তাদের পরিবারসহ প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়। এমনকি বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশে থাকতে দিতে তাদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করে। সংখ্যালঘু নারীদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়ার জন্য, তারা তাদের কোল থেকে শিশুদের ছিনিয়ে নেওয়া এবং উঠানে ফেলে দেওয়ার মতো জঘন্য কাজ করেছে। এই জামাত-শিবির গুন্ডারা মানিকগঞ্জে কালীমূর্তিসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় হিন্দু মন্দিরও ধ্বংস করেছে।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে, বিএনপি-জামায়াত সন্ত্রাসীরা চাঁদপুরের কচুয়ায় আটটি গ্রামে নৃশংস হামলা চালায়, হিন্দু নারীদের তাদের ঐতিহ্যবাহী বিন্দি ও সিন্দুর সরিয়ে ফেলতে বাধ্য করে এবং পুরুষদের তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করে। ১৪ এবং ১৫ সেপ্টেম্বর সংঘটিত হামলায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কার্যালয় এবং স্থানীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অন্তত ৬০টি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নারীরাও সহিংসতার শিকার হয়েছেন। ২০০১ এর ১৪ সেপ্টেম্বর কচুয়ায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সমাবেশের পর বিএনপি-র সন্ত্রাসীরা এই বর্বরতা চালিয়েছিল।
২০০১ সালে, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন জোট আওয়ামী লীগের পরিবর্তে সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে। এই পরিবর্তনটি ২০০১ সালের বাংলাদেশে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার দিকে পরিচালিত করে, যে সময়ে আওয়ামী লীগ সমর্থক এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সদস্যরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং বাংলাদেশ জামায়াত-ই-ইসলামির কর্মীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
২৫ মার্চ ২০০৮ তারিখে প্রকাশিত যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টারি রিপোর্টে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারীদের ওপর বিএনপি-জামায়াত জোটের দুষ্কৃতিকারীদের দ্বারা পরিচালিত সংঘবদ্ধ ধর্ষণের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছিল। এতে বলা হয়, ‘গণধর্ষণ হল পছন্দের অস্ত্র কারণ যখন একটি মেয়ে ধর্ষিত হয় তখন পরিবার তার পুনরাবৃত্তি এড়াতে ভারতে চলে যায়। ২০০১ সালের অক্টোবরে এক রাতে এক জায়গায় ২০০ হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। হিন্দু মা ও মেয়ে একসঙ্গে ধর্ষিত হয়েছিল যাতে তারা দেশে থাকতে সাহস না পায়। এমনকি এসময় প্রতিবন্ধী এবং ৭০ বছরের বৃদ্ধা নারীদেরও ধর্ষণ করা হয়।
সংখ্যালঘুরা জনসংখ্যার ১০শতাংশেরও কম প্রতিনিধিত্ব করে তবে ৯৮ দশমিক ৭ শতাংশ ধর্ষণের শিকার ছিল সংখ্যালঘু। ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোটের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের তাৎপর্যপূর্ণ উত্থান ঘটেছিল। বিএনপি ও জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডাররা অন্যান্য জঙ্গিদের সাথে মিলে দেশে বসবাসকারী ক্রমহ্রাসমান সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বর্বর নৃশংসতা চালাচ্ছিল।’
বিএনপি-জামায়াত জোটের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের নির্যাতনের নির্মম শিকার পূর্ণিমা রাণী শীল। পূর্ণিমাকে টার্গেট করা হয়েছিল কারণ তিনি আওয়ামী লীগের পোলিং এজেন্ট ছিলেন এবং তিনি নির্বাচনের সময় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কর্মীদের দ্বারা ব্যালট স্টাফিংয়ের প্রতিবাদ করেছিলেন।
সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার একটি ১২ বছর বয়সী মেয়ে পূর্ণিমা রাণী শীল যখন ২০০১ সালের ৮ অক্টোবর তার বাড়িতে ৩০-৪০ জন লোক আক্রমণ করে। তাকে গণধর্ষণ করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাথে যুক্ত চার জনকে গ্রেফতার করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়নি। তার বোন দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। তাদের পারিবারিক ব্যবসা, একটি সেলুন দুবার লুট হয়েছিল। তার পরিবার গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। এটি ছিল উগ্র ইসলামপন্থী এবং বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দ্বারা হিন্দু গ্রামগুলিতে তাদের বাংলাদেশ থেকে তাড়ানোর জন্য একটি নিয়মতান্ত্রিক আক্রমণের অংশ।
সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন ও নির্যাতন এবং তাদের মর্মবেদনা উপলব্ধি করে ‘উই মাস্ট উইন’ শিরোনামে তার লেখা একটি প্রবন্ধে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান বলছেন, ‘যারা এই দেশে জন্মেছে, যাদের পূর্বপুরুষের ভস্ম এই ভূমিকে উর্বর করে তুলেছে, যাদের মনের শান্তি খুঁজতে কোথাও যাওয়ার ছিল না, তারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছিল যে তারা অবাঞ্ছিত ছিল, তারা এই ভূমির ‘অন্তর্ভুক্ত’ ছিল না। বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় যে তারা এখানে বসবাস চালিয়ে যাচ্ছে তাদের মাথা নিচু করে তা করতে হয়েছে, মর্যাদাহানিকর পরিস্থিতির সাথে আপোস করা হয়েছে এবং স্বাধীনতা মারাত্মকভাবে হ্রাস করা হয়েছে। ‘বাঙালি’রা দেশে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা আরও নিচে নেমে যেত। ওটা ছিল পাকিস্তান।
এই ভূমি (পূর্ববঙ্গ) তার সন্তানদের এমন বৈষম্য হজম করতে পারেনি। তাই বাংলাদেশের জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আমরা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছি।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সাথে সাথে আমরা বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম যে বিদ্বেষ, বৈষম্য, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ব্যক্তির মর্যাদা নির্ধারণের দিন চলে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা বাতাসে বেজে উঠছিল, সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতি সামাজিক কাঠামোর শৈলীতে পরিণত হয়েছিল, জাতি, ধর্ম, বিশ্বাস, লিঙ্গ বা পেশা নির্বিশেষে সকলের দ্বারা রাষ্ট্রের মালিকানার বোধ সমস্ত নাগরিকের মনে তার বৈধ জায়গা করে নিয়েছে।’
সম্ভবত সবাই এই পবিত্র অনুভূতির সাথে একাত্ম হতে পারে নাই। কিংবা সাম্প্র্রদায়িক সম্প্র্রীতির উজ্জ্বল নিদর্শন বাংলাদেশ এমন ফলাফলে সবাই খুশি ছিল না। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যিনি চেয়েছিলেন সে আমাদের জাতির পিতাকে ১৯৭৫ সালে হত্যা ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি প্রতিশোধমূলক হত্যাকান্ড। পরে বিষয়টি আরও খারাপ দিকে মোড় নেয়-ইতিহাসের চাকা পেছনে টেনে নিয়ে যায়, ধর্মীয় গোঁড়ামি তখনকার রাজনৈতিক ফ্যাশনে পরিণত হয়, সাম্প্র্রদায়িক বিদ্বেষের হোতাদের রাজনীতি ও নির্বাচনের মাঠে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিশেষ করে ২০০১-২০০৬ মেয়াদে সংখ্যালঘুদের জন্য “স্বাধীনতা” আবার “শৃঙ্খলে বাঁধা”, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সরকারি জাতীয় জীবন থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেল। গণতন্ত্রের আবরণে বা নির্বাচনের মাঠে বিএনপি-জামায়াত জোটের এইসব “জবাবদিহিতার প্রয়োজনবিহীন” কর্মকান্ড উচ্চারণও এখন পাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে। সত্যিই কি তাই, বিচারের বাণী কী নীরবে নিভৃতে কাঁদতেই থাকবে? মানবাধিকার লঙ্ঘনের মহিরুহ বিএনপি-জামায়াত জোট এখন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলনের ষ্টিয়ারিং ধরা দেখে এই প্রশ্নটি উঠে আসছে।
লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ; সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এজেডএস