বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ ও ইতিহাসের গোলকধাঁধা
২৩ জুলাই ২০২৩ ১৪:৫৪
বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদের ৯৮তম জন্মদিন আজ। ১৯২৫ সালের এই দিনে (২৩ জুলাই) গাজীপুরের কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
আজীবন সংগ্রামী রাজনীতিবিদ ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। ছিলেন মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মহানায়ক। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করতেন তিনি। ১৯৪৩ সালে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হওয়ার পরের বছরই ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তাজউদ্দিন।
পূর্ব-পাকিস্তান যুবলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এ সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৫৩ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন। পরে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএ (সম্মান) ডিগ্রি লাভ করেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি ভাষা আন্দোলনকালে গ্রেফতার হন এবং নির্যাতন ভোগ করেন। ১৯৬৪ সালে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে কারাগারে থাকা অবস্থায় এলএলবি পাস করেন।
১৯৬৪ সালে তিনি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১৯৬৬ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে তৃতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ভারতে যান এবং প্রবাসী সরকার গঠনের চিন্তা করেন তাজউদ্দীন। ৪ এপ্রিল দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীনের আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। ১০ এপ্রিল তিনি আগরতলায় সরকার গঠন করার উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধকে সফল সমাপ্তির দিকে নিয়ে যেতে তার অসামান্য অবদান ছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু খুন হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় আরও তিন নেতা আবুল হাসনাত মোহাম্মদ (এএইচএম) কামরুজ্জামান, এম মনসুর আলী ও সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে তাজউদ্দীনকে হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে তখন যুদ্ধের পুরো সময়টাতেই তাজউদ্দীন আহমদ নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাজউদ্দীন আহমদের পরিকল্পনা, বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণ নেতৃত্বেই মাত্র নয় মাসেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যুদ্ধ পরবর্তীকালীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনেও বঙ্গতাজ অনন্য সব কর্মপরিকল্পনার কথা বলেছিলেন।
তাজউদ্দীনের সততা এতটাই আকাশছোঁয়া ছিল যে, দেশ স্বাধীনের পর কারামুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু যখন দেশে ফিরে আসলেন তখন সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গতাজ যুদ্ধ পরিচালনায় যত আয়-ব্যয় হয়েছে, এবং বাকি থাকা কানাকড়িটা পর্যন্তও বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দিলেন। তিনি চাইলে সেটা নাও করতে পারতেন। এমন সততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম বর্তমানে কয়জন রাজনীতিবিদ লালন করেন? অথচ আমরা দেখি, বর্তমানে রাজনীতিবিদরা সততা, নিষ্ঠা ও দেশপ্রেম বিসর্জন দিয়ে কি পরিমাণ দুর্নীতিগ্রস্ত আর অনিয়মে জর্জরিত। রাজনীতিবিদদের অভিধানে এখন এসব শব্দ পাওয়া যায় না। বর্তমানে রাজনীতিদদের অবস্থা দেখলেই মনে হয়, রাজনীতি মানেই ব্যবসা বা অনিময়-দুনীর্তির আখড়া। বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীনরা কেমন রাজনীতিবিদ ছিলেন আর বর্তমান রাজনীতিবিদদের চরিত্র কেমন—কোনভাবেই যেন কোন কিছুতে উত্তর মেলে না! বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ার পথে এখন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে অনিয়ম-দুনীর্তি আর দেশপ্রেমহীনতা।
যতদিন বাংলাদেশ টিকে থাকবে ততদিন তাজউদ্দীন ইতিহাসের আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবেন। অথচ বঙ্গতাজ যেভাবে সমাদৃত হওয়ার দাবি রাখেন এখানে এখন তাকে সেভাবে তুলে ধরা হয় না, প্রকাশ করা হয় না। এমনকি তার জন্মদিবস ও মৃত্যুদিবসটুকুও ওভাবে পালিত হয় না। প্রজন্ম জানে না জাতীয় এ বীরের বীরত্বগাঁথা। কেন ইতিহাস নিয়ে এমন বিধ্বংসী খেলা, কেন এমন গোলকধাঁধা! কে দিবে বা নিবে সে দায়? তবে ইতিহাসই একসময় অনিবার্যভাবে খুলে দেয় তার বন্ধদরজা। আর ইতিহাস কাউকে কখনও ক্ষমা করে না, অতীতেও করেনি আর ভবিষ্যতেও না।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইমরান ইমন বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমদ ও ইতিহাসের গোলকধাঁধা মত-দ্বিমত