ডেঙ্গু প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ জরুরী
২৪ জুলাই ২০২৩ ১৩:৪৫
দেশে মশাবাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি সেই সঙ্গে প্রাণহানির সংখ্যাও বাড়ছে। প্রতি বছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। অথচ বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে বা পরে কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে সাধারণত কোনো পদক্ষেপ নেয় না। আমাদের দেশে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন রয়েছে। তাদের কাজ হচ্ছে মানুষের ইউটিলিটি সেবা নিশ্চিত করা। এসব স্থানীয় প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। তারা জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করে শপথ নেন। দায়িত্ব নেয়ার পর তারা তাদের সেই অঙ্গীকার রক্ষা করার মতো সাফল্য অনেক ক্ষেত্রে অর্জন করতে পারেন না। আর সে কারণেই মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। কাজের সমন্বয় করার লক্ষ্যে বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাকে দুটি সিটি করপোরেশনে ভাগ করা হয়েছে। অথচ দিনে-রাতে মশার কামড় থেকে নগরবাসী রক্ষা পাচ্ছেন না। শুধু রাজধানীতেই নয়। সারাদেশের নগর ও শহর এলাকায় বর্তমানে মশার দাপট পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সামাজিক সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে পাশাপাশি ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
গত মাসের শেষ থেকে দেশে ডেঙ্গু শনাক্তের হার দ্রুত বাড়ছে এবং তা শহর ও গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। সে কারণে দ্রুত ডেঙ্গু শনাক্ত করতে রাজধানীসহ অন্যান্য শহরের বিভিন্ন স্থানে ডেঙ্গু পরীক্ষার বুথ স্থাপন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলে ঘরে বসে না থেকে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ এবং প্রয়োজনে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। প্রচলিত পদ্ধতিতে মশাবাহিত এ রোগের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা কঠিন। সেই সঙ্গে এ রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এডিস মশার সম্ভাব্য প্রজনন উৎস ধ্বংসে বছরব্যাপী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতে সারা বছর পরিস্থিতি নজরে রাখেন, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ হিসেবে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণে এডিস মশার প্রজনন উৎস ধ্বংস করতে হবে।
মানুষের মধ্যে সচেতনা গড়ে তোলার পাশাপাশি ঘরে-বাইরের চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে কোনো ধরনের অবহেলা করা যাবে না। সর্বোপরি ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে সরকার করোনা পরিস্থিতি যেভাবে মোকাবিলা করেছে, একইভাবে ডেঙ্গু পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হবে। করোনা পরিস্থিতি ছিল একটি বৈশ্বিক সমস্য। অথচ ডেঙ্গু হচ্ছে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশ যেখানে বেসামাল হয়ে পড়েছে, সেখানে বাংলাদেশ শক্ত হাতে হাল ধরে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছে। করোনা এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। করোনায় আক্রান্ত ও মারা যাওয়ার সংখ্যা এখন খুবই সীমিত। করোনার মতো অতিমারি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যখন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে, তখন আমাদের প্রত্যাশা থাকবে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসবে। করেনার প্রাদুর্ভাব পৃথিবীতে থেকে চিরদিনের জন্য বিদায় দেয়া সম্ভব না হলেও ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে বিদায় জানানো সম্ভব। কেননা শুধু মশা নিধনের মাধ্যমে ডেঙ্গু রোগকে বিদায় দেয়া যাবে। তবে এ জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার স্থানীয় প্রশাসনের কার্যকর উদ্যোগ ও স্বাস্থ্য খাতে কর্মীদের আন্তরিকতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা।
রাজধানীতে মশার উপদ্রব অতি মাত্রায় বাড়ছে। মশার উৎপাতে অতিষ্ঠ জনজীবন। কিন্তু বিপুল পরিমাণ বরাদ্দ থাকলেও সেই অনুযায়ী মশক নিধনে দুই সিটি করপোরেশেনের তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। তাই মশা নিয়ে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। নগরবাসী বলছেন অন্য সময়ের চেয়ে এখন মশার উপদ্রব খুব বেড়েছে। দিনেও মশার হাত থেকে রেহাই নেই। অন্যদিকে সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দরজা-জানালা সব বন্ধ করে বদ্ধভাবে থাকতে হচ্ছে, তাতেও মশার উপদ্রব কমছে না। মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে সাধারণ মানুষ বিষাক্ত মশার কয়েল ব্যবহার করছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যে ফরমালিন ও পানিতে আর্সেনিকের প্রভাব যেমন দীর্ঘমেয়াদি, তেমনি কয়েলের বিষাক্ত উপাদানও মানুষের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ সৃষ্টি করে। কয়েলে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান থাকায় ক্যান্সার, বিকলাঙ্গতা ও লিভারের রোগী বাড়ছে বাংলাদেশে। এছাড়া এসব কয়েল ব্যবহারে শ্বাসনালিতে প্রদাহ, গর্ভের শিশুর ক্ষতি, লিভার-কিডনি বিকল হওয়া, ত্বকে চুলকানি, অ্যালার্জিসহ নানা চর্মরোগ হতে পারে। আবার এদিকে দেশে যেসব মশার কয়েল উৎপাদিত হচ্ছে সেগুলোর কোনোটিতে কোন উপাদান কত মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে, তাও হচ্ছে না তদারকি। তাহলে সহজেই অনুমান করা যায় আমরা কতটা স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে আছি। অথচ মশক নিধনে দুই সিটি করপোরেশনের নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা। এ সংক্রান্ত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, মশা নিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কার্যকরী পদক্ষেপ কম। প্রতিদিন সকাল-বিকাল দুবেলা মশা নিধনে বিষাক্ত কীটনাশক ছিটানোর কথা থাকলেও সব জায়গায় তা সম্ভব হচ্ছে না। মশক নিধনকারী কর্মীদের এলাকায় দেখা পাওয়া যায় না।
সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে সংবাদ মাধ্যমে নানা সময় মশক নিধনের নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না। আবার সংবাদ মাধ্যমে মশক নিধনে তাদের সীমাবদ্ধতারও কথা শুনি। মশক নিধনে বৃহৎ পরিসরে কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না। অথচ এ জন্য সিটি করপোরেশনের বাজেট রয়েছে। সিটি করপোরেশনের রয়েছে দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকবল। মশক নিধন নিয়ে কোনো ধরনের অবহেলা মেনে নেয়া যায় না। তাই নগরবাসীর শঙ্কা এখনই মশার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভয়াবহ পরিস্থিতি ফিরে আসতে পারে। তাদের এই শঙ্কা মিথ্যাও নয়, কেননা আগের বছরে আমরা দেখেছি পর্যাপ্ত ওষুধ থাকার পরও মশা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়নি। এমনকি পরে জানা গেছে, সেই ওষুধগুলো ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ। সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি আর হবে না- সেটাই সবার চাওয়া। সবচেয়ে বড় কথা হলো, শুধু ওষুধ মজুত করলেই হবে না; তা ছিটানোর ব্যবস্থাও করতে হবে। তবেই না মশার বিরুদ্ধে এগিয়ে থাকা যাবে। পাশাপাশি মানুষকেও তাদের বাসা-বাড়ি, ফুলের টব, ছাদের বাগান, পানির ট্যাংক, এসি-ফ্রিজে জমা পানি পরিষ্কার করতে হবে। শুধু সরকার বা সিটি করপোরেশনের দিকে চেয়ে থাকলে চলবে না; নিজেদেরও এগিয়ে আসতে হবে। আমরা মনে করি মশার বিরুদ্ধে মাঠে নেমে যাওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। নাহলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। কেননা কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া মশার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। মশা শুধু দুর্ভোগই সৃষ্টি করে না। ডেঙ্গু, জিকা ভাইরাসসহ বিভিন্ন মরণঘাতী রোগের জীবাণুও বহন করে। এ জন্য মশার উপদ্রব দ্রুত বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে এডিস মশার সংখ্যা যাতে বৃদ্ধি না পায় এ লক্ষ্যে সিটি করপোরেশন, সরকার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, গণমাধ্যমসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে একসঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। অপরিকল্পিত ও দ্রুত নগরায়ণ, ঘনবসতি, গ্রাম ও শহরে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের কারণে ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত বিভিন্ন রোগ বাড়ছে। ২০২২ ও ২০২৩ সালের মধ্যে ডেঙ্গু সংক্রমণের কোনো বিরতি ছিল না। এখন সারাবছর ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হচ্ছে। ডেঙ্গু ছাড়াও চিকুনগুনিয়া, ম্যালেরিয়াসহ বিভিন্ন ধরণের রোগ বাড়ছে। এসব রোগ থেকে বাঁচতে সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি। পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সমস্যা মোকাবেলায় সাধারণ জনগণকেও সম্পৃক্ত করতে হবে ।
লেখক: ফিল্যান্স সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই