Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাজনীতিতে স্বেচ্ছাসেবা— বঙ্গবন্ধুকন্যার রাষ্ট্রচিন্তার ফসল

সুমন জাহিদ
২৭ জুলাই ২০২৩ ১৫:৩৪

মানুষ সামাজিক জীব। অন্য প্রাণিদের আমরা সামাজিক জীব বলি না কেন? মানুষের সঙ্গে প্রাণির পার্থক্য কী? জন্ম, মৃত্যু, ক্ষুধা, নিদ্রা, প্রেম, যৌনতা, বংশবিস্তার, রোগ-শোক, নিরাপত্তা ভাবনা, এসব কিছু সকল প্রাণির মধ্যেই আছে।

কিন্তু প্রধান পার্থক্য হচ্ছে মানুষ রাজনৈতিক জীব। মানুষের জ্ঞান আছে, সে ভাবতে পারে, সে স্বপ্ন দেখে, সে ন্যায়-অন্যায়ের প্রভেদ বুঝে। এই ভালো ও মন্দ বিচার করার সক্ষমতাই রাজনীতি। তাই অ্যারিস্টেটল বলেছেন ‘ম্যান ইজ অ্যা পলিটিক্যাল অ্যানিমেল’।

বিজ্ঞাপন

এককভাবে কোনো মানুষই তার সমস্ত চাহিদা পূরণ করতে পারে না। বিভিন্নমুখী চাহিদার জন্য সে অপরের উপর নির্ভর করে। পারস্পারিক নির্ভরতা ও মানুষের কল্যাণ থেকেই স্বেচ্ছাসেবার ধারণার উৎপত্তি যা সভ্যতা বিকাশের প্রধানতম মাধ্যম বা অনুষঙ্গ। ফলে স্বেচ্ছাসেবাই হচ্ছে রাজনীতির প্রথম, প্রধান ও মৌলিক প্লাটফর্ম যার প্রধান উদ্দেশ্য বৃহত্তর মানব মঙ্গল।

পটভূমি

সভ্যতা বিকাশের ধারায়, সামাজিক শৃঙ্খলা, ন্যায়-নীতি প্রতিষ্ঠা ও প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের অসহায়ত্বের শেষ আশ্রয় হিসেবে আদিম ধর্মবিশ্বাসের উৎপত্তি। ফলশ্রুতিতে স্বেচ্ছাসেবার প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ শুরু হয় ধর্ম চেতনার উপর ভিত্তি করে। ১৮৫১ সালে ব্রিটেনে দি স্যালভ্যাশন আর্মি (টিএসএ), ১৮৫৫ সালে YWCA মূলত খ্রিষ্ট ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। তবে ‘ভলেন্টিয়ার’ শব্দের ব্যবহার ১৭ শতকে একটি সামরিক টার্ম হিসেবে। যারা বাধ্যতামূলকভাবে নয় বরং স্বেচ্ছায় সামরিক বাহিনীতে চাকরিতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাদেরই স্বেচ্ছাসেবক বা ভলেন্টিয়ার বলা হতো। এ ধরনের স্বেচ্ছাসেবীরা ‘বিনা মূল্যে’ কাজ করেন না এবং তাদের নিয়মিত বেতন দেওয়া হয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানবিক বিপর্যয়ের ভিত্তিভূমিতে ভলেন্টারিজমের প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ শুরু হয়। ১৮৫৯ সালে ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার যুদ্ধের মর্মান্তিক দৃশ্যে সমব্যথী হয়ে সুইস যুবক হেনরি ডুনান্টের আহ্বানে ১৮৬৩ সালে জেনেভা সম্মেলনের ১৬টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে গঠিত হয় রেডক্রস। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯৭ মিলিয়ন স্বেচ্ছাসেবী রয়েছে। যা আজ রেডক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল নামে বিশ্বের বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। ১৯০৭ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ব্রাউন-সি দ্বীপে লর্ড ব্যাডেন পাওয়েল ২০ জন বালক নিয়ে বিশ্বব্যাপী স্কাউট আন্দোলন শুরু করেন। এর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবার উদ্দেশ্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বৃহৎচিত্তের বিত্তবানদের অনুদানের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন, ট্রাস্ট ফাউন্ডেশন, প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে যারা বিভিন্ন আঙ্গিকে চ্যারিটি, সোশ্যালওয়ার্ক করে চলছে।

বিজ্ঞাপন

আবহমানকাল থেকেই বাংলার মানুষ স্বেচ্ছাসেবায় সম্পৃক্ত ছিল। দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরু থেকেই আরব বণিকদের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলিম সুফি দরবেশগণ আসতে শুরু করে বঙ্গদেশে। ধর্ম প্রচারের পাশাপাশি লঙ্গরখানা, পানির কূপ ও দিঘী খনন ও খানকা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করেন। ক্রুসেড পরবর্তী সময় ঐতিহাসিক সিল্করোট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৬ শতকে ইউরোপীয় বণিকরা সমুদ্রপথে এদেশে আসে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। ১৭ শতকে ইউরোপীয় বণিকদের পাশাপাশি খ্রিষ্টান ধর্মপ্রচারকগণ আমাদের দেশে আসা শুরু করে। শ্রীরামপুরে ব্যাপ্টিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সারা দেশে মিশনারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। ১৯ শতক থেকে স্বেচ্ছাসেবার প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ শুরু হয়। বাংলায় প্রথম ও বৃহত্তম স্বেচ্ছাসেবার মাইলস্টোন নির্মিত হয় হাজী মোহম্মদ মহসিন ও তার বোন মুন্নুজানের সম্পত্তি দিয়ে, ১৮০৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গঠিত হয় ‘মহসিন ফান্ড’। অবিভক্ত বাংলায় যে কয়টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল তার একটি বড় অংশ নির্মিত হয়েছে মহসীন ফান্ডের টাকায়।

গোটা বিশ্বেই দেশপ্রেম ও রাজনীতির প্রাথমিক উন্মেষ ছিল ধর্মাশ্রয়ী। উপমহাদেশে সুলতানি ও মোগল আমলে অর্থ, বিত্ত ও সামাজিক প্রতিপত্তিতে মুসলমানগণ ছিল অগ্রগামী। তখন রাজ্য শাসনের অফিশিয়াল ভাষা ছিল ফার্সি ও উর্দু। ইংরেজ শাসন শুরু হলে প্রথমেই তারা ডিভাইড অ্যান্ড রুল থিওরি দিয়ে হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদের বীজ বপন করে। ১৮৩৫ সালে ‘ইন্ডিয়ান এডুকেশন অ্যাক্ট’-এ ইংরেজি ভাষা বাধ্যতামূলক করা হয়। মুসলমানরা তা প্রত্যাখ্যান করে। বিশেষত ওহাবি ভাবধারার মওলানারা ‘মুসলমানের জন্য ইংরেজি শিক্ষা হারাম’ বলে ফতোয়া দিলেন। ফলশ্রুতিতে রাজ্য শাসনে মুসলিম রাজকর্মচারীদের স্থান ক্রমান্বয়ে দখলে নেয় হিন্দুরা, সেই থেকে বাঙালি মুসলমানদের পশ্চাৎপদতা শুরু।

১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মসমাজ, ডি রোজারিওর ইয়ং বেঙ্গল সোসাইটি, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কার আন্দোলন বাংলায় নবজাগরণ তথা বেঙ্গল রেনেসাঁর জন্ম দেয়। ১৯ শতকের বাংলার মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত ও সমাজসেবক, ফরিদপুরের কৃতি সন্তান নওয়াব আবদুল লতিফ ১৮৬৩ সালে মোহামেডান লিটারেরি সোসাইটি যা বাংলার প্রথম মুসলিম সামাজিক সংগঠন। মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী করতে সৈয়দ আমীর আলীর সেন্ট্রাল মোহামেডান অ্যাসোসিয়েশন (১৮৭৭)সহ অসংখ্য উদ্যোগ নেন। ১৮৮৫ সালে ইংরেজদের পৃষ্ঠপোষকতায় উপমহাদেশের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের জন্ম হয়। কিন্তু কংগ্রেস মুসলমানদের বিশ্বস্ততা অর্জন করতে পারেনি। ব্রিটিশ সরকার ও নেটিভ বিত্তবানদের উদ্যোগে এসময়ে প্রচুর স্কুল কলেজ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হলো। স্যার সৈয়দ আহমেদ মুসলিমদের কংগ্রেসে যোগদানে অনুৎসাহিত করেন এবং শুরু করেন আলীগড় আন্দোলন। ১৮৯৭ সালের ১মে রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৫ সালে কলকাতায় গঠিত হয় আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম। এগুলো রাজনীতির চেয়েও সামাজিক পুনর্জাগরণমূলক কাজে অধিকতর সক্রিয় ছিল।

ঢাকা শহরে স্বেচ্ছাসেবার জন্য অনন্য অবদান রেখেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগ, ইতিহাসে যার নাম প্রায় উপেক্ষিত। সুফিয়া কামাল বা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার এর মতো বিপ্লবীরা তার শিষ্য ছিলেন। তিনি নারী মুক্তির জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘দীপালী সংঘ’ নামে নারী সমিতি, ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘নারীশিক্ষা মন্দির’ পরে আরমানিটোলা বালিকা বিদ্যালয়, কামরুন্নেছা স্কুলসহ ১২টি প্রাইমারি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নারীদের আত্মরক্ষা, ভোটের অধিকার, কারুপণ্য প্রশিক্ষণ ও উদ্যোক্তা তৈরি সর্বোপরি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের গুপ্ত সংস্থা অনুশীলন ও যুগান্তরের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক লীলা নাগ। তার প্রতিষ্ঠিত নারী শিক্ষা মন্দিরই আজকের শেরেবাংলা বালিকা স্কুল, প্রধানমন্ত্রী নিজেও এই স্কুল থেকে ঢাকায় তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন। ২০ শতকের শুরু থেকে বঙ্গদেশে বেশ কিছু হিন্দু ও মুসলিম জমিদার মানবকল্যাণে নানা উদ্যোগ নেয়। পূর্ববাংলায় প্রধান ও প্রথমদিককার আরেকটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান দানবীর আরপি সাহার তৈরি কুমুদিনি ট্রাস্ট। দেশভাগের পরেও তিনি কলকাতা না গিয়ে এদেশেই তৈরি করলেন ভারতেশ্বরী হোমস, কুমুদিনি হাসপাতালসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান। মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি সপুত্রক শহিদ হলেন।

১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলিম মানসে নতুন উদ্যম আসে। ঢাকা বাংলার রাজধানী হয়। কিন্তু কংগ্রেস ও কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ শুরু করলে মুসলমানরা প্রথম রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ফলশ্রুতিতে নবাব স্যার খাজা সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯০৬ সালের ২৮-৩০ ডিসেম্বর ঢাকার শাহবাগে সারা ভারত থেকে আগত ৮ হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে জন্ম হয় নিখিল ভারত মুসলিম লীগের।

স্বেচ্ছাসেবক লীগের ইতিহাস

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলেও তার অসারতা বুঝতে সময় লাগেনি বাঙালি মুসলিমদের। ধর্মের নামে পূর্ব পাকিস্তানের উপর শাসন-শোষণ-নির্যাতন শুরু হলে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন টিকাটুলি কেএমদাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকালে প্রয়াত নেতা জিল্লুর রহমানের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠিত হয়। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনে সেই সময়ের প্রেক্ষাপট অনুধাবন করা জরুরি।

একদিকে মুসলিম লীগের মৌলবাদী শাসন, পূর্ব পাকিস্তানে যার নিয়ন্ত্রণ মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিনের হাতে। বিপরীতে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রোগ্রেসিভ (উদারপন্থী) নেতারা ছিলেন তাদের উপর দমনপীড়ন শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে ১৫০ মোগলটুলিতে মুসলিম লীগের কর্মিশিবির খোলা হয়। দায়িত্বে ছিলেন টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাহেব। বঙ্গবন্ধু কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে হাল ধরেন সেই কর্মিশিবিরের। বঙ্গবন্ধু ঢাকায় এসেই পরিস্থিতি আঁচ করেন। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন ছাত্রলীগ। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন সমর্থনের কারণে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার ও গ্রেফতার করা হয়। মুসলিম লীগের দমন পীড়নের মাত্রা চরমে ওঠে। টাঙ্গাইলের একটি আসনের উপনির্বাচনে একবার মাওলানা ভাসানী ও আরেকবার শামসুল হক জয়লাভ করেন। কঠিয়ার প্রভাবশালী জমিদার, মুসলিম লীগ নেতা খুররম খান পন্নী নিজ জমিদারি এলাকায় শামসুল হক সাহেবের কাছে বিপুল ভোটের হার। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার নির্বাচনি ফলাফল বাতিল করে।

একদিকে গোয়েন্দা সংস্থা অন্যদিকে মুসলিম লীগের পাণ্ডারা ভয় ভীতি দেখিয়ে চলছে। কেন্দ্রে বিচার দিয়েও লাভ হয় না। বঙ্গবন্ধু কারাগারে। সোহরাওযার্দী, ভাসানীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ কর্মীসভা করার কোথায়ও জায়গা পায় না। অবশেষে কেএমদাস লেনের বশির উদ্দিন সাহেবের রোজ গার্ডেনে সভা করতে সম্মতি দেন তখনকার মালিক হুমায়ুন সাহেব। ২৩ ও ২৪ জুন দুই দিনব্যাপী কর্মীসভা ডাকা হয়। ৩০০ প্রতিনিধি অংশ নেন। মুসলিম লীগের সন্ত্রাসীরা আতঙ্ক ছড়াচ্ছে ঢাকা শহরে। ফলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তখন জিল্লুর রহমানকে আহ্বায়ক করে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করা হয়।

এরপর আওয়ামী লীগের সকল সভা-সমাবেশ ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী শৃঙ্খলা রক্ষা ও সাংগঠনিক সেবায় ধারাবাহিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে উত্তাল রাজপথ। ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান শুরু হলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর দায়িত্ব দেওয়া হয় তৎকালীন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাককে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের আগুনঝরা দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের রসদ সরবরাহের দুঃসাহসী ভূমিকা ছিল এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর। যদিও সেই ইতিহাস অনেকটাই অনুচ্চারিত।

’৭৫ পরবর্তী দুঃসময়ে বাংলার মাটিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিনাশ করতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে স্বৈরশাসকদের নির্লজ্জ লম্ফঝম্ফ ইতিহাস দেখেছে। ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শেষেও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে ছিল না। এখানে আরেকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য। বাংলাদেশের রাজনীতিতে রাজনৈতিক নেতা তৈরির আঁতুড়ঘর বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। ছাত্রজীবন শেষ হওয়ার পর সাবেক ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের একটা বড় সময় রাজনীতিতে যুক্ত থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। এত বড় একটি রাজনৈতিক শক্তিকে ধারণ করার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নতুন প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।

এই প্রেক্ষাপটে ১৯৯৪ সালে সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিন ২৭ জুলাইয়ে ঐতিহ্যবাহী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে পুনর্গঠিত করার উদ্দেশ্যে একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের যাত্রা শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা স্বেচ্ছাসেবক লীগকে পূর্ণ সহযোগী সংগঠনের মর্যাদা দেন। হাজী মকবুল হোসেন ছিলেন প্রতিষ্ঠাকালীন আহ্বায়ক ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক। পরবর্তীতে ২০০৩ সালে আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমকে সভাপতি করে পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক কাঠামো করার পর সেবা-শান্তি-প্রগতির পতাকাবাহী সংগঠনটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় দেশ ও জাতির সকল দুর্যোগ-দুর্বিপাকে নিঃস্বার্থ স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে আসছে।

শেখ হাসিনার ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক দর্শন

দেশে এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন ধরে দক্ষতা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে মানবকল্যাণে নানা প্রকার স্বেচ্ছাসেবা দিয়ে আসছে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, দেশি-বিদেশি ডোনার এজেন্সি ও এনজিও ছাড়াও রেডক্রিসেন্ট, স্কাউট, রোটারি ক্লাব, লায়ন ক্লাবসহ অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম, আহসানিয়া মিশন, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, সন্ধানী, বাঁধনের মতো অসাধারণ সব প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে। এর বাইরে মানবতার সেবায় নানা ট্রাস্ট, ফাউন্ডেশন নিরলস কাজ করে চলছে। এরা প্রায় সবাই অরাজনৈতিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

রাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বেচ্ছাসেবক লীগই প্রথম ও সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান এবং বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি রাজনীতিতে স্বেচ্ছাশ্রমের ধারণাটির প্রাতিষ্ঠানিকিকরণ করলেন, স্বেচ্ছাসেবার এই রাজনৈতিক মডেলটি তারই জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতা প্রসূত।

শুরুতেই বলা হয়েছে মানুষ মাত্রই রাজনৈতিক জীব। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে আলাদা একটি সহযোগী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হতে পারে, এই ধারণাটি শুধু বাংলাদেশেই নয় বিশ্ব রাজনীতিতেই প্রথম। তিনিই প্রথম সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের সংগঠিত করে ‘স্বেচ্ছাসেবক লীগ’ গঠনের নির্দেশনা দিলেন এবং আওয়ামী লীগের পূর্ণ সহযোগী সংগঠন হিসেবে স্বীকৃতি দিলেন ।

এর পাশাপাশি আরেকটি বড় বিষয় প্রণিধানযোগ্য, তা হচ্ছে তহবিল। পর্যাপ্ত তহবিল ছাড়া মানবতার সেবা খুবই দুরূহ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যত স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান রয়েছে সকলেরই নির্দিষ্ট ফান্ড রাইজিং প্রোগ্রাম বা অর্থের উৎস রয়েছে। এখানেও স্বেচ্ছাসেবক লীগ অনন্য। কোনো প্রকার ফান্ড বা তহবিল ছাড়া শুধুমাত্র রাজনৈতিক কমিটমেন্ট ও মানবিক উৎসাহ দিয়েই সকল দুর্যোগ, দুর্বিপাকে মানুষের পাশে দাঁড়ায় স্বেচ্ছাসেবক লীগ। অনেকরই ধারণা নেই এই সংগঠনটি কত বড় স্কেলে কাজ করে। এক করোনার সময় লাক লাখ মানুষকে ত্রাণ, ফ্রি স্বাস্থ্য সেবা, দাফন-কাফনসহ সকল প্রকার মানবিক সাহায্য নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগ মানুষের পাশে ছিল। কৃষকের মাঠের ফসল কেটে, প্রসেস করে একদম গোলায় তুলে দিয়েছে স্বেচ্ছাসেবক লীগের প্রতিটি ইউনিট। কিন্তু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে স্বেচ্ছাসেবক লীগের স্বেচ্ছাসেবা ধারণাটির কোনো স্বীকৃতি নেই।

জাতীয় স্বেচ্ছাসেবা নীতিমালা ২০২২

শেখ হাসিনার আরেকটি রাষ্ট্রনায়কোচিত উদ্যোগ জাতীয় স্বেচ্ছাসেবা নীতিমালা ২০২২। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বেচ্ছাসেবার প্রয়োজন অনুভব করে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর ১৯৭৩ সালে স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়ে সরকারিভাবে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটি (সিপিপি) প্রতিষ্ঠা করেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সিপিপি বা সাইক্লোন প্রিপারনেস প্রোগ্রামের অধীনে ৪৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এই অনন্য উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় দুর্যোগ মোকাবিলায় স্বেচ্ছাসেবার রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এর কোনো সংগঠিত রূপ নেই। জাতীয় স্বেচ্ছাসেবা নীতিমালা প্রণয়নের ফলে স্বেচ্ছাসেবা একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে। ফলে এখন থেকে দেশীয় স্বেচ্ছাসেবীরা প্রয়োজনে বিদেশেও কাজ করতে পারবেন। আবার বিদেশি স্বেচ্ছাসেবীরা বাংলাদেশে তাদের সেবামূলক কাজ করতে পারবেন।

বর্তমানে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৭৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবক এবং সমাজকল্যাণ অধিদফতরের অধীনে ৬৮ হাজার স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত আছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দুর্যোগে বেসরকারিভাবে কয়েক হাজার স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান কাজ করে। ৫ ডিসেম্বর সোমবার বিশ্ব স্বেচ্ছাসেবক দিবস। স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহ এটা উপস্থাপন করে। আমরাও সরকারি এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হব কিনা সেটা আমাদের ভাবতে হবে।

আজ ২৭ জুলাই স্বেচ্ছাসেবক লীগের ২৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিবার প্রধানমন্ত্রী নিজে উপস্থিত থেকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের তিনি উৎসাহিত করেন। গত দুই বছর করোনা মহামারির কারণে তিনি ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন। ২০২১ সালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধানমন্ত্রীর একটি কথা আমি উদ্ধৃত করতে চাই, তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহ বিশেষত স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ যেভাবে যে কোনো দুর্যোগে সরাসরি মানুষের পাশে দাঁড়ায়, সারা পৃথিবীর সকল রাজনৈতিক দলগুলোর তা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।’

আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর