নির্বাচনে যত ভয়; কী জানি কী হয়!
২৮ জুলাই ২০২৩ ১৬:৩৭
নির্বাচন নিরপেক্ষ হবেই। নির্বাচন নিরপেক্ষ না হওয়ার সুযোগও নাই। কারণ বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়; সরকার দল আওয়ামী লীগও বলছে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। বিদেশী প্রভু বন্ধু, দেশ, সংস্থা সবাই এক যোগে নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। তাহলে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না কেন? সবাই যখন নিরপেক্ষ নির্বাচন চায় তাহলে দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবেই।
সবসময়, সবাই নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়, দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন কি আদৌ হয়? বিএনপির সময়ে, জাতীয় পার্টির সময়ের নির্বাচনও আমরা দেখেছি। তখনো নির্বাচন অনেক প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েরও নির্বাচন নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। দিনের ভোট, রাতের ভোট, ভোট লুটের গল্প শুনেছি অনেক।
জন্মের পর থেকেই ভোট চুরির কথা শুনছি। তবে সাধারণ জনগণ মনে প্রাণে নিরপেক্ষ নির্বাচনেই প্রত্যাশা করে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এমন বিশ্বাস নিয়ে বসে আছে দেশের জনগণ। তবে নির্বাচন নিয়ে ভয় সবার মনে। নির্বাচন নিয়ে এত ভয় কেন? সবসময়ই নির্বাচনের ব্যাপারে সবার একই চাওয়া থাকে। কাজে কামে উল্টো দেখি মাঝে মাঝে। এখানেই যত ভয়; আগামী নির্বাচনে কী জানি কী হয়!
এবার নির্বাচনে কি হবে? সরকার দরের নেতারা বলছেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো ভিনদেশী রাষ্ট্রের প্রভুদের উপরে ভর করেছে, তারা ভাবছে তাদের চাপে নির্বাচন বুঝি অবাধ নিরপেক্ষ হরবে। ভাবছে হয়তো যার ভোট সেই দিতে পারবে এবার। এবার বুঝি ক্ষমত্যাচ্যুত হবে সরকার। বিগত (২০১৮) নির্বাচনের ব্যাপারেও কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপ প্রবল ছিল, তখনও নির্বাচন সুষ্ঠু না হওয়ার ব্যাপারে অভিযোগ ছিলো বিরোধীদলগুলোর। ২০১৮ সালে একাদশ নির্বাচনে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ এবং তার নির্বাচনী জোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয় লাভ করেছে। যেখানে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তার নির্বাচনী জোট জয়ী হয়েছে ৭টি আসনে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২৩৪টি আসনে জয়লাভ করে নিরাপদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করে। তবে বিরোধী জোট নির্বাচন বর্জন করায় এই নির্বাচনটি বেশ বিতর্কিত ছিল। দশম নির্বাচন বর্জনের ফলে ৩০০টি আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনের সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। সব মিলিয়ে আগত সংসদ নির্বাচনের নিরপেক্ষতার ব্যাপারে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
কথা বললে অনেক কি বলতে হবে। আমাদের দেখা মতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার শাহাবুদ্দিন সাহেবের অধীনে নির্বাচনটা মোটামুটি নিরপেক্ষ হয়েছে। এর আগে পরে অনেক নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগে এবং ওয়ান এলেভেনের আগে বিএনপি কোন ধরনের নির্বাচন করেছিল সেটা দেশবাসী জানে।
নিজেদের গদি আকড়ে রাখতে অনেক চেষ্টা করেছে দলটি। অতিরিক্ত ক্ষমতায় থাকার পর জাতীয় পার্টির প্রেসিডেন্ট হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ নিজের মসনদ টিকিয়ে রাখতে সাধারণ মানুষের বুকে গুলি চালিয়েও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। জোর করে ক্ষমতায় থাকা যায় কিন্তু যুগযুগ ধরে নয়; এটাই তার জলন্ত প্রমাণ।
লিভিয়ার গাদ্দাফি, ইরাকের সাদ্দাম কেউ টিকেনি শেষতক। যত ভালো কাজই করুক একসময় আওয়ামী লীগকেও হয়তো সরে যেতে হবে এটাই বাস্তবতা। এই সরকারও একসময় ক্ষমতাচ্যুত হবে, অন্য কোন সরকার দেশ চালাবে এটাই হয়তো স্বাভাবিক। তবে শেখ হাসিনার সরকারের সময় কিছু দৃশ্যমান উন্নয়নের কথা না বললে এ লেখার নিরপেক্ষতা হারাবে হয়তো। দীর্ঘ ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। এই কয়েকটা বছরে বাংলাদেশের মানুষ যেটা প্রত্যাশা করেনি এমন কিছু উন্নয়ন হয়েছে দেশে। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ালে পদ্মা সেতু আমাদের কাছে স্বপ্ন হয়েই দেখা দেয়। কিন্তু এই প্রধানমন্ত্রীর সাহসিকতায় বাস্তবে রূপ নিয়েছে স্বপ্নের সেই পদ্মা সেতু। সেতুর ওপারের জেলাগুলোর মানুষ আজ এ সেতুর কল্যাণে চরম সুফল ভোগ করছেন। বাণিজ্যিক গতিও বাড়িয়ে দিয়েছে এই সেতু। খুলনা, যশোর, বরিশাল, ফরিদপুর কিংবা অন্য কোন জেলাগুলোতে যেতে শুধুমাত্র ফেরির জন্য ৮/১০ ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে মানুষকে। এখন সেখানে রাজধানী ঢাকা থেকে দুই থেকে তিন ঘন্টায় পৌঁছে যাচ্ছে নিজ গন্তব্যে। যশোর কিংবা আশেপাশের জেলা থেকে অনেকেই সকালে রওনা দিয়ে মন্ত্রণালয় কিংবা অফিসের কাজ সেরে আবার ফিরে যাচ্ছেন নিজ জেলায় এই সেতুর কল্যাণেই। এ সরকারের সময় দেশে কাঠামোগত উন্নয়নও হয়েছে প্রচুর। বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল, অফিস-আদালতের ভৌতিক উন্নয়ন লক্ষ্য করছি আমরা। ভাবা কি যায়, আকাশে আমাদের নিজস্ব স্যাটেলাইট, যানজটের শহরে মেট্রোরেল তাও আবার জাপানীজ মানের। উত্তরা থেকে যেখানে মতিঝিল দিলকুশা আসতে যেতে দিন পার হয়ে যায় সেখানে কয়েক মিনিটেই মানুষ তার গন্তব্যে পৌঁছতে পারবে। এটার সুফল শুরু হয়েছেও। আধুনিক রানওয়েতে সমুদ্রের পানি ছুঁয়ে বিমান উঠানামা করবে এই বাংলাদেশে। এটা বোধ করি বিশ্বে একটাই। আর কক্সবাজারে এমন একটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি করা হয়েছে যেটা সহসাই উদ্বোধন হবে। কক্সবাজারে যাবে রেল, তা আধুনিক।
ঢাকায়, ঢাকার বাহিরে রাস্তায় অসংখ্য দ্বিতল, ত্রিতল ফ্লাইওভার, অনেকটা সিঙ্গাপুরের আদলে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, দুবাইয়ের আদলে পূর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়ক, মাওয়া সড়ক, প্রমত্তা সাগর মোহনায় টানেল, পানির নিচে দিয়ে যাবে গাড়ি। দূরত্ব কমিয়ে দেবে অনেকটা এমন আরও কত কী! এসব এ সরকারের সফলতা বলতে হবে।
বিশ্ব মন্দার কারণে সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক একটা সংকট চলছে। বাংলাদেশে তা দৃশ্যমান বটে। তবে বাংলাদেশের সংকটা একটু বেশি। রিজার্র্ভ কমে যাওয়াটা মোটেও ভালো কোন লক্ষণ নয়। এ ব্যাপারে বহু ভুল ত্রুটিও রয়েছে এমন আলোচনা সমালোচনা আছে বহু। দেশ থেকে অর্থ প্রচারের অভিযোগ বহুদিন ধরে চলছে। একটা গোষ্ঠীর হাতে অর্থ চলে যাচ্ছে এমন অভিযোগ আছে। মানুষের নিত্যপণ্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। মানুষের আয় কমেছে, ব্যয় অনেক বেড়েছে এসব কথা অসত্য বলার জো নেই। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে রাজনীতিবিদদের হাতে অর্থ কড়ি চলে যায় এটা পুরানো রেওয়াজ। পাড়া মহল্লার ছিঁচকে নেতারাও গাড়ি হাকে, লাখ লাখ টাকা উপার্জন করে বৈধ এবং অবৈধ পথে। কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষ নেতাকর্মীদের হাতে জিম্মি আছে চরম ভাবে। এমন তথ্য বোধ করি দেশের প্রধানমন্ত্রী কাছেও আছে। আগামী নির্বাচনে অনেক এমপি নমিনেশন নাও পেতে পারেন। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন চ্যানেলে। যারা জনবিচ্ছিন্ন এবং লুটপাট কমিশনখোড়, জুলুমবাজ তাদের ব্যাপারে দলের উচ্চমহলের রিপোর্ট রয়েছে। তারা হয়তো আগত সংসদ নির্বাচনে নমিনেশন পাবেন না এমনটাই বলা হয়েছে সে খবর। এ খবর যদি বাস্তবে রূপ পায় তাহলে সুখবরই বলব দেশের জন্য। অনেক নেতা, এমপি, মন্ত্রী আছেন যাদের কারণে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। মানুষ তাদের মোটেও সহ্য করতে পারছে না। যারা সরকার দল করেন তারাও তাদের কারনে সরকারের সমালোচনা করছে এখন। তারা হয়তো আগামী নির্বাচনে নিজের দলেরই বিরোধ করতে পারে। সন্ত্রাসী লালন করা, মাদক নিয়ন্ত্রণ, খুনখারাবিই তাদের মুখ্য কাজ। সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে তারা ক্ষমতায় থাকে, অবৈধ অর্থ উপার্জন করে। এসব নেতাদের নমিনেশন না দেওয়াই খুব বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। এসব সংসদীয় এলাকাগুলোকে যদি এজাতীয় অসৎ নেতাদের নমিনেশন না দিয়ে সৎ এবং ত্যাগীদের নমিনেশন দেওয়া হয় তাহলে সরকারের ভোট বাক্সে ভোট কিছুটা বেশি পড়বে এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। এটাও সত্য দীর্ঘদিন ক্ষতির ক্ষমতায় থাকার পর জনগণ কিন্তু কিছুটা পরিবর্তন চায়।
বিশেষ করে পরিবর্তন চায় নেতাকর্মীদের হাতে নিভৃতে হওয়ার কারণে, অসহায় বোধ করার কারণে। জনগণকে অসহায়ত্বের জায়গা থেকে তাদেরকে যদি সরিয়ে আনা যায় জনগণ উন্নয়নের কারনে হয়তো এই সরকারকে আবারও ভোট দিতে পারে। এজন্য নমিনেশনটা নিরপেক্ষ এবং সঠিক লোককে দেওয়া জরুরি হয়ে পরেছে।
লেখক: মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এজেডএস