মানবাধিকার লঙ্ঘন: আয়নায় মুখ দেখুক যুক্তরাষ্ট্র
৩০ জুলাই ২০২৩ ১৪:৩০
যুক্তরাষ্ট্র সারাবিশ্বে মানবাধিকার নিয়ে সবক দিয়ে থাকে। অথচ তাদের দেশেই সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো হইচই নাই। গত ২৪ জুলাই পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এক টুইটে জানিয়েছেন, ‘গত পাঁচ দিনে যুযক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনায় আমরা আতঙ্কিত।’ অর্থ্যাৎ ১৮ তারিখ থেকে ২৩ তারিখের মধ্যে বাংলাদেশের দুইজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
সেখানে পুলিশ বা সন্ত্রাসীদের হাতে বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। গণমাধ্যমের কল্যাণে এ ধরণের ঘটনা অহরহ শোনা যায়। কিন্তু তারপরে তদন্ত কিংবা বিচারের কোনো খবর পাওয়া যায় না।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে।সেখানে বলা হয়েছে, যারা সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে তারা ভিসা নীতির আওতায় পড়বে। এছাড়া স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেছে,২০২২ সালে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের ঘটনাও ঘটেছে। স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা, সভা সমাবেশে বল প্রয়োগ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রভৃতি অব্যাহত ছিল। অথচ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন হওয়ার পরও তাদেরকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না। এখন সময় এসেছে তারা জ্ঞান দেওয়ার আগে আয়নায় নিজের মুখটা দেখে নিতে হবে। নতুবা একসময় এসব নিষেধাজ্ঞা বুমেরাং হয়ে যাবে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াস এক প্রতিবেদনে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কঠোর সমালোচনা করে বলা হয়েছে, আমেরিকায় প্রায় ২৩ লক্ষ ৭ হাজার লোক কারাগারে আটক আছে। বিশ্বে আমেরিকায়ই বেশি লোককে আটক করা হয়।আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ উভয় বর্নের মানুষ সমপরিমাণে মাদকের অপরাধে দায়ী হলেও কৃষ্ণাঙ্গদের অধিক হারে আটক ও বিচার করা হয়। আমেরিকায় মোট ১২ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ হলেও আটক ব্যক্তিদের ২৯ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। প্রতিবেদনে বলা হয়,সাদাদের তুলনায় ছয় গুন বেশি কালো মানুষ আটকের ঘটনা ঘটে।
চীনের স্টেট কাউন্সিল ইনফরমেশন অফিস গত মার্চ মাসে ২০২২ সালের যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার একটি প্রতিবেদন পেশ করে। সেখানে বলা হয়,বিশ্বে বন্দুকের মালিকানা,বন্দুককেন্দ্রিক হত্যাকাণ্ড এবং এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যার ঘটনার দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র শীর্ষে। ২০২২ সালে এসব ঘটনায় ৮০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। এই একবছরে ৬০০টির বেশি ‘ম্যাস শুটিং’য়ের ঘটনা ঘটেছে। যা বন্দুক কেন্দ্রিক সংহিতা মহামারিতে পরিনত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ৮১ শতাংশ আমেরিকান মনে করে,এশীয় সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতা ক্রমেই বেড়েই চলছে। শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গদের নিহত হওয়ার আশংকা ২ দশমিক ৭৮ গুন বেশি। ১৮ বছরের কম বয়সি ৫৮০০ টির বেশি শিশুকে গুলি করে হত্যা কিংবা আহত করা হয়েছে। স্কুলে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে ৩০২ টি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, একুশ শতকের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাস বিরোধিতার নামে ৮৫ টি দেশে সামরিক অভিযান চালিয়েছে তাতে কমপক্ষে ৯ লক্ষ ২৯ হাজার বেসামরিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।৩৮ মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুৎ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দ মতো না চললে তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করে।বর্তমানে ২০ টিরও দেশে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। সেসব দেশের জনগণ মৌলিক খাদ্য এবং ওষুধ সরবরাহ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিবেদনে চীন আরো বলেছে,যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে মানবাধিকার রক্ষার উদ্ধারকর্তা নিজেকে দাবি করে অথচ তাদের আর্থিক দুর্নীতি, বর্ণবৈষম্য, অস্ত্র এবং পুলিশি সহিংসতা অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের কথা বলে অথচ বিগত দুটি নির্বাচনে তারা তো নিজেরাই একদল আরেক দলের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ করেছে। ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর বলা হলো, রাশিয়া ভোট হ্যাকিং করে ট্রাম্পকে জিতিয়েছে।২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নির্বাচনে ব্যালট কারচুপি এবং মৃত ব্যক্তির ভোট দেওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। ভোটের পর তো অনেক সহিংসতা হয়েছে।এছাড়া রয়েছে মারাত্মক বর্ণ বৈষম্য। এর কারণে অনেককে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে।গত মার্চে টেনেসিতে দুই জন কৃষ্ণাঙ্গ আইন প্রনেতাকে বহিষ্কারের ঘটনা উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের স্বরূপ উন্মোচন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য প্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। বন্দুক আইনের বিরোধিতা করে তিনজন আইন প্রনেতা বিক্ষোভ করলে সেখানে যে দুজন আইন প্রনেতা কৃষ্ণাঙ্গ তাদেরকেই বহিষ্কার করা হয়েছে। এঘটনায় সজীব ওয়াজেদ জয়, মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরকে ‘ভন্ডদের আখড়া’ বলে মন্তব্য করেছেন।
দ্য অ্যাসোসিয়েটসড প্রেস (এপি) ও এনওআরসি সেন্টার ফর পাবলিক অ্যাফেয়ার্স রিসার্চ যৌথ ভাবে গত ২২-২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র নিয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে বলা হয়, ৪৯ শতাংশ জণগণ মনে করে যুক্তরাষ্ট্রে ঠিক মতো গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে না। সঠিক গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছে মনে করে মাত্র ১০ শতাংশ।মোটামুটি হচ্ছে মনে করে ৪০ শতাংশ জণগণ। আর ৫৩ শতাংশ জনগণ মনে করে কংগ্রেস সদস্যরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে কাজ করছে না। মাত্র ১৬ শতাংশ মনে করে সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করছে। আর কিছুটা দায়িত্ব পালন করছে মনে করে ৩৫ শতাংশ।বর্তমানে বিশ্বের ৮০ টির মতো দেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে,এসবের অর্ধেকের বেশি দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা নেই। তারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের কথা বলে অথচ তাদের দেশের অন্তত ৩৬ টি রাজ্যে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারকে সীমিত করে ৮০ টিরও বেশি খসড়া আইন প্রবর্তন করা হয়েছে। তাদের মুখে গণতন্ত্রের বুলি মানায় না।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে মানবাধিকার বিষয়ে শুরু থেকেই বিমাতা সুলভ আচরণ করে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ব বাংলার মানুষের উপর হত্যা কান্ড চালিয়ে ত্রিশ লক্ষ মানুষকে হত্যা ও দু-লক্ষ মা-বোনদের সম্ভ্রম হানি ঘটিয়েছে। সেসময় পাকিস্তানকে অকুণ্ঠ সমর্থন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পাকিস্তানিদের অস্ত্র সরবরাহ,সপ্তম নৌবহর পাঠানো সহ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে তারা সকল ধরণের সহযোগিতা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যে এখনও মৃত্যুদন্ড বহাল আছে।তারপরও বঙ্গবন্ধুর খুনিকে তারা ফেরত দিচ্ছে না। খুনি রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছে।এবং তাকে ফেরত দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার থেকে বারবার অনুরোধ করা স্বত্তেও যুক্তরাষ্ট্র উপেক্ষা করেছে।
বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ভু-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে খুবেই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য এখানে পাকিস্তানের মতো একটি নতজানু একটা সরকার চাচ্ছে।কিন্তু চাইলেই তো সব আশা পূর্ণ হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেছিল,কিন্তু বাংলাদেশ স্বল্প সময়ের মধ্যেই স্বাধীনতা অর্জন করেছে।যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকরে চেষ্টা করেছিল,বাংলার মাটিতে খুনিদের রায় কার্যকর হয়েছে।পদ্মাসেতু নির্মাণেও বিরোধিতা করেছিল, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন সারা বিশ্বে প্রশংসিত। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন, লিঙ্গ বৈষম্য ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে অনেকে ভালো ভাবে নিতে পারে না। তারাই নির্বাচন আসলেই অতি উৎসাহী হয়ে ওঠে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন করেনি তারা এখন নানা ভাবে দেশকে নিয়ে খেলতে চায়। তো এই খেলোয়াড়দের খেলতে দেয়া হবে না।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থের বিপরীতে গেলে কোনো দেশকে সন্ত্রাসী,আবার কোনো দেশকে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। এটা তাদের চিরাচরিত প্রথা।এবিষয়ে বাংলাদেশের জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। লাদেশের জনগণ বারবার এইসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করছে, ভবিষ্যতেও করবে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই
তাপস হালদার মত-দ্বিমত মানবাধিকার লঙ্ঘন আয়নায় মুখ দেখুন যুক্তরাষ্ট্র