শেখ কামাল ছিলেন নানামুখী প্রতিভার অধিকারী
৫ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৪৭
শেখ কামালের জন্মদিন ৫ আগস্ট। ১৯৪৯ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন, মাত্র ২৬ বছর বয়সের এক টগবগে যুবক যখন তিনি তখনই তাকে বর্বর হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে হয়। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দ্বিতীয় সন্তান, প্রথম পুত্র সন্তান। দুই কন্যা এবং তিন পুত্র সন্তানের জনক শেখ মুজিব ছিলেন জাতির পিতা। জাতির পিতা, তার স্ত্রী ফজিলাতুননেসা মুজিবসহ তিন পুত্র ও দুই পুত্রবধূকে এক সঙ্গে হত্যা করছিল জাতিবিরোধী একটি সশস্ত্র ঘাতক দল। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নজির আর নেই।
বেঁচে থাকলে তিনি এবার ৭৪ বছরে পা দিতেন। তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। তাকে ঘাতকরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে, যে বাড়িটি এক সময় পরিণত হয়েছিল বাঙালির আশা-ভরসার ঠিকানায়, সেই বাড়িতেই রাতের অন্ধকারে হত্যা করা হয় । হত্যা করা হয় পরিবারের সব সদস্যকেই।
রাজনীতিক পিতার সন্তান হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ছাত্র অবস্থাতেই শেখ কামাল রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। পাকিস্তানের অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী অপশাসন এবং শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে লড়াই করে পিতা শেখ মুজিবের জীবন কেমন ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ ছিল সেটা শেখ কামাল একেবারে জন্মের পর থেকেই দেখেছেন। স্ত্রী-কন্যা-পুত্র-সংসার-পরিবার নয়, শেখ মুজিবের জীবন নিবেদিত ছিল দেশের সব মানুষের কল্যাণের জন্য। পিতার আদর্শকে বুকে ধারণ করে মানুষের কল্যাণ চিন্তায় শেখ কামালও উজ্জীবিত হয়েছিলেন। তিনি পিতার মতোই সাহসী ও নির্ভীক হয়ে উঠেছিলেন। ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে শুরু করেছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায্যতার পক্ষে সংগ্রাম।
শেখ কামাল ছিলেন নানামুখী প্রতিভার অধিকারী একজন উদ্যমী সংগঠক। মিছিল-মিটিং ছাড়াও খেলার মাঠে ছিলেন অতি সক্রিয়। আবার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তার উৎসাহে কমতি ছিল না। নাটকে অভিনয় করেছেন, ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যচক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের সেতার বাদন বিভাগের ছাত্র ছিলেন। গীটার বাজাতে দক্ষ ছিলেন। ছাত্র লীগের একজন একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন। সত্তরের নির্বাচনের সময় ছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষের একজন প্রচারকর্মী। প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের সময় একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ছুটে গেছেন অসহায় মানুষের কাছে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন শেখ কামাল। অস্ত্র চালনায় প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি যুদ্ধকালে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর এডিসির দায়িত্বও পালন করেছেন।
স্বাধীনতার পর সদ্য স্বাধীন দেশে খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক কাজে তিনি বেশি সময় দিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন ক্রীড়া সংগঠন ‘আবাহনী’ এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘স্পন্দন’। শেখ কামাল ছিলেন একজন প্রাণবন্ত উচ্ছ্বল তরুণ। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধানের সন্তান হিসেবে তাঁর মধ্যে কোনো অহংকার ছিল না। তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করতেন না। সবার সঙ্গে সহজভাবে মিশতেন, চুটিয়ে আড্ডা দিতেন, গল্প, হাসি-তামাশায় আসর মাতিয়ে রাখতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে যারা শেখ কামালকে ক্যাম্পাসে দেখেছেন তারা জানেন তার মধ্যে কোনো দম্ভ ছিল না। চোখের সামনে কোনো অন্যায় হতে দেখলে প্রতিবাদ করা ছিল তার সহজাত প্রবণতা। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত ক্যাম্পাসে আমি নানাভাবে শেখ কামালকে দেখেছি। তিনি করতেন ছাত্রলীগ, আমি ছাত্র ইউনিয়ন – তারপরও তার ব্যক্তিত্ব আমাকে আকর্ষণ করতো।
স্বাধীনতার পর দেশে একটি বিশেষ পরিবেশ-পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। একদিকে অস্ত্র হাতে যারা যুদ্ধ করেছেন, অন্যদিকে যারা দেশ ছাড়তে পারেননি। আবার মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীর দল। সব মিলিয়ে একটি মনস্তাত্ত্বিক সংকট। বিভিন্ন কারণে সামাজিক স্থিতি কি কিছুটা নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল।
দেশ ছিল যুদ্ধ বিদ্ধস্ত। সম্পদের সীমাবদ্ধতা ছিল। আবার ছিল পুনর্গঠনের জরুরি ও কঠিন কাজ। আওয়ামী লীগের সব স্তরের সব নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে আত্মত্যাগ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার কাজে নেমেছিলেন – তাও নয়। কেউ কেউ আপন ভাগ্য গড়ার প্রতিযোগিতায় নেমে বাড়াবাড়ি করে মানুষের মন বিষিয়ে দেওয়ার কাজেও লিপ্ত হয়েছিল। চাটার দল, চোরের দল সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু সব দিক সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। আক্ষেপ করে বলেছেন, পাকিস্তানিরা সব নিয়ে রেখে গেছে একদল চোর।
মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষবিরোধিতাকারী পরাজিত সাম্প্রদায়িক শক্তি তৎপর হয়ে উঠতে থাকে। তাদের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে বঙ্গবন্ধুর এক সময়ের অনুসারী বলে পরিচিত আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ থেকে বেরিয়ে গিয়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদ যারা গড়লেন সেই নেতাকর্মীরা। মজলুম জননেতা হিসেবে পরিচিত মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ চীনপন্থি গ্রুপগুলোও মুজিববিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে সশস্ত্র নাশকতা চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে অজনপ্রিয় করে তোলার জন্য চলতে থাকে নানা ধরনের অপপ্রচার। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের নিয়েও নানা কল্পগল্প প্রচার করে মুজিববিরোধী তথা বাংলাদেশবিরোধী একটি আবহাওয়া তৈরি করা হয়।
শেখ কামালকেও তখন উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারের টার্গেট করা হয়েছিল । নানা ধরনের অপকর্মের সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে চালানো হয়েছিল মিথ্যাচার। শেখ কামাল অবিনয়ী, উদ্ধত, তিনি সন্ত্রাসীদের মদদদাতা, নারীদের প্রতি শিষ্টাচার দেখান না, এমনকি তার বিরুদ্ধে ব্যাংক ডাকাতির অভিযোগও প্রচার করা হয়। এসব প্রচারণার বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয় মওলানা ভাসানীর ‘হককথা’ নামের সাপ্তাহিক পত্রিকা, এনায়েতুল্লাহ খানের ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘হলিডে’, জাসদের দৈনিক মুখপত্র ‘গণকণ্ঠ’ এবং শত শত রাজাকার কণ্ঠসহ স্বাধীনতাবিরোধী সব অপশক্তির সমবেত কণ্ঠধ্বনি। এরসঙ্গে গোপনে যুক্ত ছিল আওয়ামী লীগের ঘর শত্রু বিভীষণেরা-খন্দকার মোশতাক-শাহ মোয়াজ্জেম-ওবায়দুর রহমান-তাহের ঠাকুর গং।
এগুলো যে একটি বিরাট পরিকল্পনা এবং লক্ষ্যকে সামনে রেখেই করা হচ্ছিল তা এখন অনেকের কাছেই স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ক্ষেত্র তৈরির সুদূরপ্রসারী উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই দেশের ভেতরের এবং দেশের বাইরের একাত্তরে বিজয় ঠেকাতে ব্যর্থ গোষ্ঠীগুলো একাট্টা হয়ে অপপ্রচার, মিথ্যাচার, গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে নীলনকশা তৈরি করে কাজ করেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘটানো যে কিছু মাঝারি সামরিক কর্মকর্তার তাৎক্ষণিক হঠকারি সিদ্ধান্ত ছিল না, এত বছর পর অনেকের কাছেই সেটা পরিষ্কার হয়েছে। ১৫ আগস্টের নেপথ্য কুশীলবদের সবার মুখোশ এখনও উন্মোচিত না হলেও, একদিন নিশ্চয়ই তা হবে।
শেখ কামাল সম্পর্কে অধ্যাপক আবুল ফজলের স্মতিচারণমূলক একটি ছোট লেখা আছে। সেখান থেকে সামান্য উদ্ধৃত করছি। আবুল ফজল লিখছেন : খুব সম্ভব, ১৯৬৬-৬৭ হবে। ঢাকার সুবিখ্যাত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানটের বার্ষিক অনুষ্ঠান ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট হলে। আমাকে করতে হয়েছিল সভাপতিত্ব। ভাষণ ইত্যাদি প্রাথমিক পর্ব শেষ হলে শুরু হলো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অর্থাৎ গানবাজনা, নৃত্য ইত্যাদি। মঞ্চ থেকে নেমে আমরা আসন নিয়েছি দর্শকদের চেয়ারে। আমার পাশে বেগম সুফিয়া কামাল। তিনি তখন ছায়ানটের সভানেত্রী। সমবেত ঐকতানের প্রস্তুতি নিয়ে শিল্পীরা বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র হাতে মঞ্চে আসন নিয়েছে অর্ধবৃত্তাকারে। শিল্পীদের মাঝখানে দীর্ঘকায় হ্যাংলাদেহ এক ছেলে সেতার হাতে ঋজুু হয়ে আসন নিয়ে সংকেতের অপেক্ষায় বসে আছে আসন গেড়ে। সে বয়সেও গোঁফের রেখা স্পষ্ট। অঙ্গুলি নির্দেশ করে সুফিয়া কামাল বললেন – ওইটি মুজিবের ছেলে।
: কোন মুজিবের?
তখনো একনামে চিহ্নিত হয়নি। শেখ সাহেব।
: শেখ মুজিবের। ছায়ানটের ছাত্র।
শেখ মুজিব তখন জেলে। ভোগ করছেন দীর্ঘ কারাবাস।
এরপর আবুল ফজল লিখছেন : ১৭ মার্চ শেখ সাহেবের জন্মদিন। স্বাধীনতার পর ছাত্রলীগ প্রতিবছর এ দিনটি পালন করে থাকে। ১৯৭৪-এর অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হওয়ার জন্য ঢাকার ছাত্রলীগ আমাকে অনুরোধ জানায়। আমি রাজি হলাম, তবে দিনে দিনে ফিরে আসতে চাই – এ শর্তে। তারা সেভাবে বিমানের টিকেট পাঠিয়ে দিয়েছিল। ১৭ তারিখ ডাকা বিমানবন্দরে নেমে আমি চিন্তা করতে লাগলাম, ওরা আমাকে নিতে আসবে কিনস, এলেও আমি চিনতে পারবো কিনা। ওদের কারো সঙ্গে তো আমার দেখা নেই। এ যাবৎ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে ওদের প্রতিষ্ঠানের চট্টগ্রাম শাখার কেউ কেউ। তাদের কেউ আবার সহযাত্রীও হয়নি। নিজের হ্যান্ডব্যাগটি হাতে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায় মেয়ের বাসায় কী করে যাওয়া যায় সেকথা ভাবতে ভাবতে নির্গমনপথে নেমে এলাম। একধারে দেখলাম একটা ছিপছিপে গোঁফওয়ালা ছেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বেশ লম্বা বলে সহজে চোখে পড়ে। ছেলেটাকে আমি চিনতে পারলাম না। লাউঞ্জের প্রবেশপথে ছেলেটি এগিয়ে এসে বলে -আপনাকে নিতে এসেছি। বলেই আমার হাত থেকে ব্যাগটি আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে নিজের হাতে নিয়ে নিল। নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম – তুমি ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে এসেছ?
: জি হাঁ। নম্রকণ্ঠে জবাব দিলো ছেলেটি। ওর পেছনে হেঁটে এসে একটা গাড়িতে উঠে বসলাম। ড্রাইভারের সিটে গিয়ে বসোও নিজে। এবং শুরু করলো ড্রাইভ করতে। তার আগে ও জেনে নিয়েছে আমি কোথায় উঠবো। গাড়িতে তৃতীয় ব্যক্তি নেই। কিছুদূর যাওয়ার পর আমার মনে হঠাৎ কৌতূহল হলো, জিজ্ঞাসা করলাম- তুমি কি করো।
বলল – অনার্স পরীক্ষা দিয়েছি সোসিওোলজিতে।
: ঢাকা থেকে?
: জি হাঁ।
শেখ সাহেবের সঙ্গে ছেলেটির দৈহিক সাদৃশ্য আমার মনে ধীরে ধীরে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছিল। জিজ্ঞাসা করলাম – তোমার নাম?
: শেখ কামাল।
: ও তুমি আমাদের শেখ সাহেবের ছেলে?
: জি হাঁ।
বললাম – এত সব মন্ত্রীরা থাকতে আজকের অনুষ্ঠানে আমাকে কেন তোমরা নিয়ে এলে প্রধান অতিথি হতে?
তেমনি আবেগহীন কণ্ঠে ও বললো – আপনার এক কথা ওদের হাজার কথার সমান।
এমনই ছিলেন শেখ কামাল। বিনয় এবং সৌজন্যবোধের সীমা লংঘন করেননি কখনো। বেঁচে থাকলে তিনি কী হতে পারতেন, সে আলোচনা এখন অর্থহীন। তাঁর বিরুদ্ধে যারা অপবাদ ছড়িয়েছিল তারা হারিয়ে গেলেও শেখ কামালের নাম অনেক বাঙালির মনে উজ্জ্বল হয়েই আছে এবং থাকবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
বিভুরঞ্জন সরকার মত-দ্বিমত শেখ কামাল ছিলেন নানামুখী প্রতিভার অধিকারী