শান্তির জন্য চাই জরুরি বৈঠক
১০ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৪৪
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি বড় রাজনৈতিক দলের এক দফার কর্মসূচি ঘিরে ফের উত্তপ্ত রাজপথ। শুরু হয়েছে জ্বালাও পোড়াও। হামলা আর পাল্টা হামলার মধ্যে সবাই নিজেদের রণ কৌশল নির্ধারণে ব্যস্ত সময় পার করছে। বিরোধী রাজনৈতিক জোট আর সরকারি দলের মাঝখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারাও পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৌশল নির্ধারণে কাজ করছে। যদিও সমস্যা সমাধানের জন্য তাদের হাতে করণীয় কিছু নেই। রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবেই মোকাবেলা করতে হয়। এটাই নিয়ম, ইতিহাস।
প্রশ্ন হলো বৈঠক কি শুধু গোপাল ভাঁড়ের মন্ত্রী মশাইয়ের মতো প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করার জন্যই করতে হবে? কিভাবে রাজপথ ও রাজনীতির মাঠে একে অপরকে ঘায়েল করা যায়। কথার ম্যারপ্যাচ দিয়ে আঘাত করা যায়। একে অপরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ আর পাল্টা অভিযোগ তুলে বিষোদগার করা যায়। ঘরে বিজয়ের ফল তোলা যায়। সমাধানের জন্য কি নিজেদের মধ্যে আলোচনা হতে পারে না? গোপাল ভাঁড়ের মন্ত্রী মশাইয়ের ষড়যন্ত্রের বুদ্ধি তো কম নয়। তাকে কী সব সময় লাভ হয়? পর্যায়ক্রমে নিজেকেই গর্তে পড়তে হয়, শিকার হতে হয় অপমান, লাঞ্চনা আর ভৎসনার।
ইউক্রেন আর রাশিয়া যুদ্ধ যখন তৃতীয় বিশ^ যুদ্ধের বার্তা দিচ্ছে তখনও কিন্তু পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্রই চায় এখনই এই যুদ্ধ থেমে যাক। সবাই আলোচনার টেবিলে আসুক। আর শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো সব সময় অশান্তির বিরুদ্ধে। দুনিয়া জুড়ে শিশুরা স্লোগান দিচ্ছে, ‘যুদ্ধ চাই না, আমরা ধ্বংস চাই না। আমরা পৃথিবীতে শান্তির পতাকা ওড়াই। পারমানবিক অ¯্রগুলো সাগড় জলে ডুবিয়ে ফেল…’। যদিও নীতি নির্ধারকদের কানে এসব পৌঁছানোর কথা নয়। তবুও দুনিয়ার একটা বড় অংশ যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তি, কল্যাণ আর সমাঝোতার পক্ষে।
তবে আমরা কেন নই? নামেমাত্র সুশিল সমাজ আর গোটা কয়েক মানুষ ছাড়া রাজনৈতিক প্ল্যাট ফরম থেকে সমাধানে সামাজিক চাপ বা পরামর্শ কোনটাই আসছে না। বড় দুই দল ও নেতাদের মধ্যে আস্থা ও বিশ^াসের সংকট চরমে গেছে। ক্ষমতার প্রয়োজনে কেউ কাউকে এখন আর বিশ^াস করতে চায় না, তেমনি ছাড় দিতেও নারাজ। আরো বড় কথা হলো শান্তির পক্ষে কথা বললে অনেকেই হয়ত নিজেদের পরাজয় মনে করে। খাট ভাবে। এরকম মানসিকতার মধ্যে তো শান্তি, উন্নত, সমৃদ্ধির মধ্য দিয়ে অগ্রগতি আসবে না। বরং সংকটের ডালপালা আরো বেশি ছড়াবে।
সামনে পরিস্থিতি যতি আরো খারাপের দিকে যায় তাহলে বাংলাদেশের ভাগ্যে কি আছে? এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভাবনাই বা কতোটুকু? তাদের কার্মকা- দেখে তো এরকম কিছু মনে হয় না।
করোনার অভিঘাত ও যুদ্ধ পরিস্থিতির শিকার বাংলাদেশ। অন্যান্য দেশের মতো আমরাও অর্থনৈতিক মহামন্দা মোকাবেলা করে চলছি। গার্মেন্টস সেক্টরে অর্ডার কমছে। রেমিটেন্স প্রবাহ মাঝে মধ্যেই গতি হারাচ্ছে। ডলারের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি নির্ভর পণ্যের স্বাভাবিক সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে। এই সুযোগে নানা পণ্যের লাফিয়ে দাম বাড়ে। মুনাফাখোররা বেপরোয়া হয়ে ওঠছে বারবার। সর্বোপরী সব পণ্যের এখন লাগামছাড়া দামে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। কথা হলো এর বাইরে কী রাজনীতি বা রাজনৈতিক কর্মীরা?
সবচেয়ে বড় সংকট হলো খাদ্য। চাল উৎপাদন বাড়লেও অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। নিয়মিত চাল আমদানি করতে হচ্ছে। সংকটের কারণ দেখিয়ে অনেক দেশ চাল আমদানি বন্ধ করে দেয়। বিপদ আচ করতে পেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাম্প্রতিক সময়ে সবকটি বক্তব্যে একখ- জমিও পতিত না রেখে চাষাবাদের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন। রাজনৈতিক সংকট বাড়লে এসব সমস্যা আরো ঘনিভূত হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে শত অন্ধকার পথ কাটিয়ে দেশ যখন আবারো একটু সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় তখন নির্বাচন এসে দরজায় কড়া নাড়ছে। অর্থাৎ আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত অনিশ্চিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি। কি হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
কথা হলো ক্ষমতার লড়াই আজ নতুন কিছু নয়। হাজার বছর আগের ইতিহাসেও এরকম লড়াইয়ের কথা আছে। সময়ের কারণে শুধু ধরণ পাল্টেছে। এটা মনে রাখা দরকার, যে লড়াই সবাইকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে তা শুরুর আগে সমাধানের পথে যাওয়া উচিত। আমরা তো এখন আদিম যুগে নেই। বর্বরতার যুগ ছাপিয়ে সভ্যতার সর্বাধুনিক বাস্তবতায় আছি। ক্ষমতা, রাজনীতি, চিন্তা ও মনন এসব প্রশ্নে এত সংকীর্ণতা কেন?
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলগুলো ফের বিদেশীদের সাহায্য চেয়েছে। যার প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসানীতি করেছে। শক্তিশালী দেশগুলো হয়ত আস্তে আস্তে আরো সেংশন আনবে। ইউরোপিয় ইউনিয়ন সহ অনেক দেশ তথা আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নির্বাচন নিয়ে ফের তৎপর। তারা দলে দলে আসছে। ধারাবাহিক বৈঠক করছে। নির্বাচন নিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছে। এখানেই কি শেষ?
রাজপথে রাজনৈতিক সহিংসতা যতো বাড়বে বিদেশীরা ততো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে নাক গলাবে। সামনে কূটনৈতিক তৎপরতা হয়ত আরো বেশি দেখা যাবে। যদিও একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে এমন নাক গলানোর ইতিহাস বিশে^ বিরল। তাহলে এটা বোঝা কঠিন কোন বিষয় নয়, এজন্য দায়ি রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতারাই। নিজেরা নিজেদের ক্ষতি করছি। বিপদ ডেকে আনছি। খাল কেটে কুমির আনার মতোই অবস্থা।
সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হলো বাংলাদেশ জন্মের ৫০ বছর পরও নির্বাচন নিয়ে একটি স্থায়ী সাংবিধানিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। এই ব্যর্থতার দায় কিন্তু সবাইকে নিতে হবে। যার ফলে প্রতি পাঁচ বছর পর-পর নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মুখে জাতিকে পড়তে হয়। বিশ্বে ক্ষুন্ন হয় দেশের ভাবমূর্তি। এগিয়ে চলার বাংলাদেশ বারবার হোঁচট খায়। ক্ষমতার জন্য গোটা জাতিকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর এই তামাশা বন্ধ হওয়া জরুরি।
অনেকটাই পরিকল্পিতভাবে নির্যাতন করে মিয়ারমার বাংলাদেশে রোহিঙ্গা পাঠিয়ে দিয়েছে। একটি ছোট্ট দেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ কী করতে পেরেছে। সেদেশে আমাদের কূটনীতিকরা কি সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলোকে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনে চোখ রাঙানি দিতে পেরেছে। বরং শত বিনয়ি হওয়ার পাশাপাশি বিশ্ব নেতাদের সহযোগিতা নিয়েও সংকটের সমাধান মিলছে না। প্রভাবশালী দেশগুলোতে তাদের নির্বাচন বা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট সমাধানে আমাদের দেশের কূটনীতিকদের কথা বলার কি কোন সুযোগ আছে?
রাজনীতিতে মেধাবী মানুষের সংকট আছে তা বলা যাবে না। কোন নেতাই দেশকে নিয়ে ভাবেন না তাও বলা যাবে না। অনেকের ভাবনা থাকলেও হয়ত করনীয় কিছু নেই। নির্দেশ অনুযায়ি কথা বলেন। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করেন। কারণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বড় দলগুলোর প্রধানদের কাছে। সামাজিক নানা বাস্তবাতায় এখন সুশিল সমাজের বেশিরভাগ মানুষ নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। তারা তৃতীয় পক্ষ হিসেবে সমাধানের কোন বার্তা দিচ্ছে না। মান সম্মানের ভয়ে পরিকল্পনা নিয়ে দেশের স্বার্থে এগিয়ে আসছেন না। অন্যান্য সকল পেশাজীবী তো রাজনীতির রোগে আক্রান্ত। তাই তাদের থেকে সংকট সমাধানের কোন প্রস্তাব আসবে না এটাই স্বাভাবিক।
গত ২৩ বছরে দেশের নির্বাচনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বহুবার সংকট এসেছে। সংলাপ হয়েছে। বিদেশী কূটনীতিকরা এসে দূতিয়ালি করেছে। পারদ নেমেছে উত্তাপের। সমাধানের দিকে গেছে সবকিছু। আবার রাজনৈতিক কারণেই ১/১১ এসেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বরণীয় ১/১১ তো রাজনীতিবীদদের খুব বেশি পরিবর্তন করাতে পেরেছে মনে হয় না। যদি তাই হতো তাহলে দ্বাদশ নির্বাচন ঘিরে আবারো সহিংস অবস্থা তৈরী হতো না।
প্রশ্ন হলো তাহলে কি চলমান পরিস্থিতির কোন সমাধান নেই? রাজপথের সহিংসতা কি আরো বাড়বে? হয়ত বাড়বে। কিন্তু এরমধ্য দিয়ে সমাধানও আসবে। এমনও হতে পারে একটি অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা নেবে। আসতে পারে সেনাবাহিনীও। আবার এমনও হতে পারে প্রভাবশালী দেশগুলোর চাপে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের মধ্য দিয়ে নির্বাচনের পথ তৈরী হবে। অনির্বাচিত সরকার আসলে লস উভয় দলের। আর সমাধানের পথে নির্বাচনে গেলে লাভ দল-দেশ ও জাতির। এই লাভ সত্যিই বহুমাত্রিক। মানুষ আশা করে আমাদের সমস্যা আমরাই সমাধান করবো।
রাজনৈতিকভাবে সমাধানের উদ্যোগ কোথা থেকে আসতে পারে? এ প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বিএনপির পক্ষে থেকে সমঝোতার প্রস্তাব না আসাই স্বাভাবিক। জাতির পিতার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজনৈতিক ঐতিহ্যের মধ্য দিয়ে তার বেড়ে ওঠা। চারবারের প্রধানমন্ত্রী তিনি। তার সবচেয়ে বড় অহংকার মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের প্রধান তিনি। তার বাবার নেতৃত্বে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। তার চাওয়া পাওয়ার আর কী থাকতে পারে। বড় মনের মানুষ অনেক কিছুতেই আরো বেশি মহানূভবতার পরিচয় দিতে পারেন, এটাই স্বাভাবিক। যা শেখ হাসিনার পক্ষে সম্ভব। তিনি চাইলে সবাইকে ডেকে সংলাপের মধ্য দিয়ে দেশকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যেতে পারেন।
পাশাপাশি সকল রাজনৈতিক দলের জরুরি বৈঠক হোক শান্তি আর সমঝোতার জন্য। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল আর কোনঠাসা করার সিরিজ বৈঠক দেশের জন্য শুধু বিপদ ডেকে আনবে। অনিশ্চয়তা দিকে ঠেলে দিবে জাতিকে। তাই নিজেদের সুরক্ষার জন্য নিজেদের ভাবনাটা বেশি জরুরি। অন্তত এই ক্রান্তিকালে দেশপ্রেম দেখানো প্রতিটি নাগরিক তথা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মহান দায়িত্ব।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই