একুশ আগস্টের গ্রেনেড কোন গণতান্ত্রিক রাজনীতির নমুনা?
২১ আগস্ট ২০২৩ ১৪:১৮
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট এক ভয়ংকর বিকেল দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। সেদিন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ছিল আওয়ামী লীগের একটি সমাবেশ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে একটি ট্রাকের ওপর স্থাপিত হয়েছিল বক্তৃতামঞ্চ। আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত ছিলেন সেই মঞ্চে। যথারীতি হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে শুরু হয়েছিল সভার কাজ। সভা যখন প্রায় শেষের দিকে, পশ্চিম আকাশে সূর্য হেলে পড়লেও আঁধার নামেনি, শেখ হাসিনা বক্তৃতা করছিলেন, তখন আকস্মিকভাবে বিকট বিস্ফোরণের শব্দে চমকে ওঠেন সবাই। সভাস্থলে গ্রেনেড ছুড়ে মারা হয়। লক্ষ্য অবশ্যই ছিলেন শেখ হাসিনা। তাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই ওই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। মোহাম্মদ হানিফ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ আওয়ামী লীগ নেতারা মানববর্ম রচনা করে শেখ হাসিনার প্রাণ রক্ষা করেন। তবে নিহত হন ২৩ জন, যার মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভী রহমান। তিন শতাধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হন। সেই ভয়ংকর বিকেলে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে রচিত হয়েছিল এক কলংকিত অধ্যায়। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কলংকিত ধারার সূচনা হয়েছিল, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট যেন সেই ধারারই আরেক প্রকাশ। হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন কিংবা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মুলের এই ধারা দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির সামনে খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। দেশে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে প্রাথমিকভাবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সরকারের দায়িত্ব। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো এতবড় অপরাধ যারা করেছিল তাদের চিহ্নিত করা, গ্রেফতার করা এবং আইনের হাতে সোপর্দ করার জরুরি কর্তব্যটি তৎকালীন সরকার সম্পাদনে কেবল চরমভাবে ব্যর্থতারই পরিচয় দেয়নি, বরং ঘটনা প্রবাহ অন্যখাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টাই চালানো হয়েছে। অপরাধীরা যাতে নিরাপদে থাকতে পারে কৌশলে সেই চেষ্টাই করা হয়েছে। নিরপরাধ নিরীহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে নিষ্ঠুর নির্যাতন চালানো হয়েছিল। সাধারণ মানুষের চোখে ধূলা দেওয়ার জন্য যে নানা অপচেষ্টা-অপপ্রয়াস বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার নিয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিএনপি নামক রাজনৈতিক দলটি ছিল না। তাই ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের দায় সরাসরি বিএনপির ওপর চাপানো যায় না। তবে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আওয়ামী লীগ করে থাকে। খুনিরদের সঙ্গে জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠতা এবং পরস্পর নির্ভরতার বিষয়টি এক কথায় নাকচও করা যায় না । স্বঘোঘিত খুনিদের বক্তব্য থেকেও জানা যায় জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুকে হত্যার বিষয়টি আগে জানতেন এবং খুনিদের বিরত করার চেষ্টা তিনি করেননি। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে জিয়ার পক্ষে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ দখল সম্ভব হতো না। খুনিদের প্রতি ছিল তাঁর দুর্বলতা ছিল। বিদেশে কূটনৈতিক মিশনে চাকরি দিয়ে জিয়া তাদের রক্ষা করেছেন।
এটাও ঠিক যে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর পরই ক্ষমতা দখল করেছিলেন খোন্দকার মোশতাক আহমেদ। তিনি আওয়ামী লীগ করতেন বলে এটা বলা হয়ে থাকে যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তার দলের লোকেরাই। মোশতাকের মন্ত্রিসভায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার ৬ জন বাদে আর সব সদস্যই যোগ দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায় থেকে আওয়ামী লীগকে একেবারে মুক্তি দেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগের কেউ কেউ জেনেবুঝে ঘাতকদের সহযোগী হয়েছে, কেউ আবার পরিস্থিতির আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পক্ষ বদল করেছে।
তারপর জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা এবং আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়েই চলেছেন ।মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুনামকে পুঁজি করে জিয়া দেশের রাজনীতিকে পাকিস্তানি ধারায় নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন। তিনি সংবিধান সংশোধন করে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাতিল করেছেন। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে দিয়েছেন। গোলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন। রাজনীতিতে নীতিহীনতা দ্বার উন্মুক্ত করেছেন। নিজের ক্ষমতার ভিত্তি মজবুত করার জন্য দল ছুট, সুবিধাবাদীদের দিয়ে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। সামগ্রিক বিবেচনায় তাই জিয়াকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রধান উপকারভোগী বলেই মনে করা হয়।
হত্যার রাজনীতির পথ ধরেই জিয়ার উত্থান এবং নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরেও অসংখ্য হত্যাকাণ্ড জিয়ার আমলে সংঘটিত হয়েছে । নিজের জীবন রক্ষাকারী কর্নেল তাহেরও জিয়ার কাছ থেকে অনুকম্পা পাননি। প্রহসনের বিচারে তাহেরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে। জিয়ার হাতে গড়া দল বিএনপিও হত্যা-খুনের রাজনীতির ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনা তার বড় প্রমাণ । ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলের সমাবেশে নিরাপত্তা দিতে সরকার শুধু ব্যর্থ হয়নি, ঘটনার পরবর্তী সময়ে আক্রমণকারীদের রক্ষা করার সব ধরনের চেষ্টা সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল।
২২ আগস্ট বিচারপতি জয়নুল আবেদীনকে চেয়ারম্যান করে এক সদস্যের বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল, যে কমিশনের উদ্দেশ্যই ছিল সম্ভবত পুরো বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়া অথবা মানুষের নজর অন্যদিকে ফেরানো। এক মাস দশ দিন পর বিচারপতি জয়নুল আবেদীন ১৬২ পৃষ্টার এক প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার পেছনে একটি শক্তশালী বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিল। যদিও বিদেশি সেই শক্তিশালী গোয়েন্দা সংস্থার নাম বলা হয়নি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছিল, অভিযানটি পরিচালনা করা হয়েছিল ভাড়া করা দুর্বৃত্তদের মাধ্যমে। এসব লোক প্রধানত একটি সংগঠনের সশস্ত্র ক্যাডারদের মধ্য থেকে নেওয়া হয়। যাদের সমাবেশে ভিড়ের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো ভালো জ্ঞান ছিল।
বিচারপতি জয়নুল আবেদীনের তদন্ত প্রতিবেদনটি যে তার মনগড়া ছিল এবং বিএনপি সরকারও হয়তো এই প্রতিবেদনের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হতে পারেনি বলেই এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করেনি। তবে বিএনপি সরকার আত্মরক্ষার বর্ম খু্ঁজতে গিয়ে হাস্যকর সব পদক্ষেপ নিয়ে এটা স্পষ্ট করেছে যে, গ্রেনেড হামলার রহস্য উন্মোচনে তারা আগ্রহী নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং তদন্ত সংস্থাগুলোকে প্রভাবিত করে কালক্ষেপনের নীতি নেওয়া হয়। ২০০৫ সালের ৯ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়া নামক এক ছিছকে অপরাধীকে ধরে তার কাছ থেকে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। পরে জানা যায়, এটা ছিল পুলিশের সাজানো নাটক।
অন্যদিকে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলতে থাকেন যে আওয়ামী লীগই নিজেদের জনসমাবেশে গ্রেগেড হামলা চালিয়েছে মানুষের সহানুভূতি আদায়ের জন্য এবং বিএনপি সরকারকে বিব্রত করার জন্য। শেখ হাসিনা নিজেই তার ব্যাগে গ্রেনেড বহন করেছেন – এমন হাস্যকর বক্তব্যও বিএনপির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছে। গ্রেনেড হামলা মামলা তদন্ত বাধাগ্রস্ত করার জন্য বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। নানা নাটকীয়তা শেষে ৬ বার তদন্ত কর্মকর্তা বদলে চাঞ্চল্যকর গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার কাজ শেষ হয়েছে। বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে যে এই মামলার বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হতো তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিএনপি নেতারা মুখে আইনের শাসনের কথা বললেও কার্যত তাদের অবস্থান সব সময় ন্যায় বিচার ও আইনের শাসনের পরিপন্থি। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের ক্ষেত্রে যেমন সেটা সত্য ছিল, গ্রেনেড হামলা মামলার বেলায়ও তাই।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার এক নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক শাহেদ নূরউদ্দিন গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ মোট ৫২ জন আসামির মধ্যে বাবর, পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। তারেক রহমান এবং হারিছ চৌধুরীসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরীসহ মোট ১৬ জন আসামী এখন পলাতক আছেন। কয়েক জন কারাগারে আছেন। ডিজিএফআই, এনএসআই এবং পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তাও দণ্ডিত হয়েছেন। বিচারকার্যক্রম চলার সময় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা আদালতকে জানান যে, হামলার আগে ঢাকায় কমপক্ষে ১০ টি বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে তারেক রহমান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বাবর, পিন্টু, হারিছ চৌধুরী (তখন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব ছিলেন), জামায়াত নেতা আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ এবং হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান উপস্থিত থাকতেন। গ্রনেড হামলা মামলার মূল আসামি মুফতি হান্নান। কিন্তু সিলেটে বোমা হামলার ঘটনায় ২০১৭ সালে তার ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। অন্যদিকে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এই মামলা থেকে রেহাই পান।
একুশ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় রায়ে তারেক রহমানকে যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়ায় এবং বিএনপির আরো কয়েকজন নেতা মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন সাজা পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বিএনপি এই রায়ে নাখোশ হয়েছে। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রায় প্রকাশের পর প্রতিক্রিয়ায় একে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, বিলম্বিত হলেও এই রায়ে আমরা অখুশি নই। কিন্তু আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্টও নই। কারণ এই রায়ে প্ল্যানার এবং মাস্টারমাইণ্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত ছিল ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট (মৃত্যুদণ্ড)।
রাষ্ট্র পক্ষ উচ্চ আদালতে তারেক রহমানের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করবে কিনা এবং করলে রায় পরিবর্তন হবে কিনা, তা নিয়ে মন্তব্য করা যাবে না। তবে একুশ আগস্টের সেই ভয়ঙ্কর বিকেলে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় দেশের রাজনীতিতে যে কালো অধ্যায় যুক্ত হয়েছিল, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে বিএনপিকে সত্য স্বীকার করতে হবে। একুশ আগস্টের ঘটনা কোনো গালগল্প নয়। ঘটনাটি ঘটেছিল এবং এমন একটি হিংসাশ্রয়ী ঘটনার সঙ্গে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা ছিল। বিএনপি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করেছে। তবে এত বছর পরে তাদের উচিত সত্যের মুখোমুখি হওয়া। বিএনপি না বদলালে যে দেশের রাজনীতি বদলাবে না, এটা বিএনপি নেতৃত্বকে বুঝতে হবে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
একুশ আগস্টের গ্রেনেড কোন গণতান্ত্রিক রাজনীতির নমুনা? বিভুরঞ্জন সরকার মত-দ্বিমত