Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ব্রিকসের সদস্য হতে বাংলাদেশের আরও অপেক্ষা

বিভুরঞ্জন সরকার
২৯ আগস্ট ২০২৩ ১৪:২০

২২ থেকে ২৪ আগস্ট দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এবারের ব্রিকস সম্মেলনটি আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল। তবে এবারের সম্মেলন নিয়ে আলোচনা ছিল, আগ্রহও ছিল। কেন এই আলোচনা ও আগ্রহ? কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। পশ্চিমা বিশ্ব তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এতে করে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত বিশ্বের অনেক দেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে। এর প্রেক্ষাপটে ডলার আধিপত্য হ্রাস এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রভাব কমানোর লক্ষ্যে ব্রিকস নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বস্তুত ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে পৃথিবী মোটামুটি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। পশ্চিমা জগত রাশিয়ার ভূমিকা নিন্দা করে ইউক্রেনের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে রাশিয়ার অবস্থানকে সমর্থন করে ইরান, বেলারুশ, উত্তর কোরিয়া, নিকায়ারাগুয়ার মতো দেশগুলো পশ্চিমাদের ভূমিকাকে নিন্দা করছে। এর পাশাপাশি চীন-ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা-ব্রাজিলসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের অনেক দেশ এক্ষেত্রে পশ্চিমা জগৎ ও রাশিয়া থেকে সম-দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে এ সম্মেলন ঘিরে আশাবাদ ছিল সংস্থাটির সদস্য হওয়ার ব্যাপারে। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সদস্য হতে পারেনি।

ব্রিকস ২০০৬ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন—এই চারটি দেশ নিয়ে ব্রিক নামে গঠিত হয়েছিল। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার অন্তর্ভুক্তির ফলে এটি ব্রিকস নাম ধারণ করে।

পরবর্তী সময়ে সৌদি আরব, ইরান, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাংলাদেশ, আলজেরিয়া, মিসর, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, সিরিয়াসহ ২২টি দেশ সদস্য হওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানায়। কিন্তু এত দিনে সংগঠনটির কোনো সম্প্রসারণ ঘটেনি। শেখ হাসিনা এ বছরের জুন মাসে জেনেভায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বৈঠকে যোগ দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার সঙ্গে বৈঠককালে শেখ হাসিনা এই গ্রুপে যোগ দিতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা জানান। ওই বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ১৯ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসে যোগদানের জন্য আবেদন করে।

২৪ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭০টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে ফ্রেন্ডস অব ব্রিকস লিডারস ডায়ালগে (ব্রিকস—আফ্রিকা আউটরিচ ও ব্রিকস প্লাস ডায়ালগ) ব্রিকসের ‘নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক’-এর সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্য দেন। তিনি ব্রিকসকে বিশ্বের একটি বহুমুখী বাতিঘর হিসেবে দেখার আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া তথাকথিত পছন্দ ও বিভাজনকে ‘না’ বলা উচিত। সর্বজনীন নিয়ম ও মূল্যবোধকে অস্ত্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা আমাদের অবশ্যই প্রত্যাখ্যান করতে হবে। আমাদের নিষেধাজ্ঞা-পাল্টা নিষেধাজ্ঞার চক্র বন্ধ করতে হবে এবং সব ধরনের হুমকি, উসকানি ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে।‘ তিনি অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে এসে বিশ্বে জনগণের প্রয়োজনীয় পণ্যের প্রতি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বিশ্বশান্তি, ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, সবাইকে একসঙ্গে অবশ্যই আন্তর্জাতিক অর্থায়ন ও প্রযুক্তির জন্য প্রত্যেকের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে এবং জলবায়ু, ন্যায়বিচার, অভিবাসীদের অধিকার, ডিজিটাল ইক্যুইটি ও ঋণ স্থায়িত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

বিজ্ঞাপন

এই সফরের সময় শেখ হাসিনা ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ বাণিজ্য ও ব্যাবসায়িক সভায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বক্তব্য দেন, যেখানে তিনি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আফ্রিকান ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। ওই দিন তিনি আফ্রিকার দেশগুলোতে নিযুক্ত বাংলাদেশ মিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রের পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বাণিজ্য, ব্যবসা ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করার নির্দেশ দেন। শেখ হাসিনা দক্ষিণ আফ্রিকায় বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিয়ে আয়োজিত সভায়ও যোগ দেন, যেখানে তিনি তাদের সমস্যার কথা শোনেন এবং দেশের স্বার্থে কাজ করার পরামর্শ দেন।

১৫তম ব্রিকস সম্মেলন মূলত দুটি বিষয়কে সামনে রেখে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তার একটি হলো, পশ্চিমা বিশ্ব তথা ডলারের প্রভাব কমিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি বিকল্প কাঠামো তৈরি করা এবং সে সঙ্গে ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে বিশ্ব রাজনীতির কাঠামোতে একটি নতুন মেরুর সঞ্চার করা।

ব্রিকসের এ প্রচেষ্টা অর্থনীতি এবং রাজনীতিতে বিকল্পধারা তৈরি করার চীনা প্রচেষ্টার সঙ্গে অনেকটাই সাজুস্যপূর্ণ বলে অনেকে মনে করেন। ফলাফলের দিক থেকে বিবেচনা করলে এবারের ব্রিকস সম্মেলনকে সফল সম্মেলন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। ব্রিকসের নেতৃবৃন্দ ছয়টি নতুন দেশকে এ সংস্থার সদস্য হিসেবে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে।

এ ছয়টি দেশের মধ্যে আফ্রিকা থেকে দুটি দেশ- মিশর এবং ইথিওপিয়া, মধ্যপ্রাচ্য থেকে তিনটি দেশ- ইরান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ল্যাটিন আমেরিকা থেকে একটি দেশ- আজেন্টিনা এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

এলডিসি সদস্যভুক্ত দেশ ইথিওপিয়ার অন্তর্ভুক্তি খানিকটা প্রশ্নের উদ্রেক করলেও অনেক বিশ্লেষক আফ্রিকার একাত্মতা এবং ব্রিকসের এবারের সম্মেলনের মূল বক্তব্য- ব্রিকস এবং আফ্রিকার মধ্যে পার্টনারশিপের অনুপ্রেরণাতেই তেমনটা ঘটেছে বলে মনে করেন। অপরদিকে আর্জেন্টিনা বাদে অপর দেশগুলো তেল উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে ভূ-কৌশলগত সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তিতে কাজ করে থাকবে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। ল্যাটিন আমেরিকার ভৌগোলিক বিবেচনায় আজের্ন্টিনার অন্তর্ভুক্তি হতে পারে বলে অনেকের ধারণা।

এই জোটের নেতৃবৃন্দ বলেছেন যে, তারা পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে নয়; কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের অবস্থান এ বক্তব্যের অনেক ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কাজেই পশ্চিমাদের কেউ যদি মনে করেন যে, ব্রিকসের বক্তব্য চীন ও রাশিয়ার অবস্থানের কাছাকাছি তাহলে খুব বেশি ভুল বলা হবে না। তবে এখানে ভারত আছে। ভারতের সঙ্গে চীনের সম্পর্কটি ভূ-রাজনীতির কারণে খুব সহজ নয়। চীন ও ভারত ছাড়া অন্য যে দেশগুলো ব্রিকসে আছে তাদের অর্থনীতি যে খুব বেশি শক্তিশালী বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা মনে হয় না। যদিও বলা হচ্ছে, ব্রিকস সদস্য রাষ্ট্রগুলো বৈশ্বিক জিডিপির ২৫ শতাংশের মতো তাদের আওতায় রেখেছে এবং তাদের ব্যাপক জনসংখ্যাও আছে। কিন্তু বর্তমান বৈশ্বিক যে কাঠামো আছে তাতে তারা খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারবে কিনা সে প্রশ্ন এখনো অজানা।

ব্রিকসে নতুন করে যেসব দেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার মধ্যে ইথিওপিয়া ছাড়া বাকি সবাই এলডিসির ওপরে উন্নয়নশীল দেশ। সে বিবেচনায় হয়তো তারা বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে বিবেচনা করেনি। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, সদস্যপদ লাভের ব্যাপারে আমরা আমাদের আগ্রহ দেখিয়েছি কিন্তু সেটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যে কূটনৈতিক উদ্যোগের প্রয়োজন তা যথাযথ হয়েছে কিনা, সে প্রশ্নটি সামনে এসেছে। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির বিবেচনায় বাংলাদেশের ব্রিকসের সদস্য হওয়া না হওয়ায় বাস্তব অর্থে আমাদের জন্য খুব একটা পরিবর্তন আনবে বলে অনেকে মনে করেন না। কারণ হলো, ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্রিকসের দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য চীন এবং ভারতের সঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। সৌদি আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক মোটামুটি ভালো। তবে যেহেতু ব্রিকসের অন্যান্য দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের জোরালো কোনো অর্থনৈতিক যোগাযোগ নেই সে কারণে ব্রিকসের সদস্যপদ এ মুহূর্তে না পেলেও বাংলাদেশের ক্ষতির তেমন কারণ আছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন না।

বলা হচ্ছে, ভারতের অনাগ্রহের কারণেই এবার বাংলাদেশের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি। যারা এসব বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন তারা মনে করেন, দ্রুতই এমন সময় আসবে, যখন ভারতের অবস্থান পরিবর্তন হবে। ভূরাজনীতির নানা হিসাবনিকাশ ও সমীকরণ বাংলাদেশের অনুকূলে আসবেই।

প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হলে পশ্চিমাদের দিক থেকে তার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা দিত কিনা। এ ব্যাপারে কূটনীতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই গ্রুপের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ চীন। চীন চাইবে সেখানে তার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে। তবে ভারত সেটা নিশ্চয় পছন্দ করবে না। সে জন্য ব্রিকসে এই টানাপোড়েন থেকেই যাবে। বাংলাদেশ তো এখনও সদস্য হয়নি। যদি হতোও, তাহলে এমন হতো না যে, শুধু বাংলাদেশই ব্রিকসের সদস্য হচ্ছে, অন্য কেউ না। বাস্তবতা হলো, ব্রিকসে যোগ দেওয়ার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানিয়েছে ২২টি দেশ। সে জন্য আমরা একেবারে এক দিকে ঝুঁকে গেছি– এমন কোনো পরিবেশ সৃষ্টি হতো না। ফলে এটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হলেও এর কারণে এমন কোনো পরিবেশ-পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে না যে, যুক্তরাষ্ট্র আমাদের জন্য যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য যেসব সম্পর্ক রয়েছে, তাতে সমস্যা হবে। কারণ ব্রিকস এমন কোনো সংগঠন এখনও হয়ে উঠতে পারেনি, যা পশ্চিমের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। হয়তো ব্রিকসের সদস্য হলে সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কে আমাদের কিছু সুবিধা হতে পারে। তবে অর্থনৈতিকভাবে আমাদের বেশি স্বার্থ থাকবে পশ্চিমের সঙ্গেই।

সব মিলিয়ে এটা বলা যায় যে ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশকে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবে এটা ঠিক যে বাংলাদেশকে দীর্ঘ দিন এই সংস্থার বাইরে রাখা সম্ভব হবে না।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

বিভুরঞ্জন সরকার ব্রিকসের সদস্য হতে বাংলাদেশের আরও অপেক্ষা মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর