দেশ মাতৃকার সেবায় রেমিট্যান্স যোদ্ধারা
২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:৩০
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্স বলতে বোঝায় বিদেশে কর্মরত কোনো নাগরিক যখন দেশে অর্থ পাঠায়। অধিক বেতন, উন্নত কর্মপরিবেশ ও উন্নত জীবনযাপনের আশায় মানুষ নিজ দেশ ছেড়ে অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায়। এসব প্রবাসীর পাঠানো রেমিট্যান্স একটা দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের মাথাপিছু আয় এবং মোট জিডিপিও বৃদ্ধি পায়। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রবাসী আয়ের অর্থ দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিশুর পুষ্টি ও শিক্ষার ক্ষেত্রেও অবদান রাখছে। দেশমাতৃকার সেবায় রেমিট্যান্স যোদ্ধারা সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বনির্ভর বাংলাদেশ হওয়ার পিছনে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম জড়িয়ে আছে তারা আমাদের কাছে সুপারহিরো। প্রবাসে বসবাসকারী বাংলাদেশী জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের দৃশ্যমান উন্নয়নের রূপকথার নায়ক। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার পিছনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করার প্রয়াসে প্রবাসীরা নিয়মিত রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। স্বপ্নের পদ্মাসেতু আমাদের আবেগ ও অনুপ্রেরণার জায়গা। আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মাসেতু করেছি যার পিছনে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেছে প্রবাসী আয়। আমরা স্বল্প সময়ে ঢাকার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে পারছি মেট্রোরেলে, যা তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে রেমিট্যান্স। আমরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে দ্রুততম সময়ে যাতায়াত করতে পারছি, যেখানে রেমিট্যান্সের ভূমিকা রয়েছে।
করোনা কালীন সময়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন টালমাটাল তখনও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ভাবে ভালো অবস্থানে ছিল কারণ রেমিট্যান্স প্রবাহ তখনও সচল ছিল। প্রবাসী-প্রেরিত অর্থ বা রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশী অভিবাসীদের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, ফলে দেশের বার্ষিক রেমিটেন্সের পরিমাণও উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে চলেছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, জুন ২০১৫ সাল মোতাবেক বাংলাদেশ রেমিট্যান্সের দিক দিয়ে বৃহত্তম প্রাপক দেশসমূহের একটি যেখানে প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স প্রেরণ করা হয়। সর্বশেষ ২০২১ ও ২০২২ এ দুই অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৫.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ১৯৭৪ সালে, অনাবাসী বাংলাদেশীদের প্রেরিত অর্থ বৈধ মাধ্যমে দেশে নিয়ে আসার জন্য মজুরী উপার্জনকারীর প্রকল্প শুরু করা হয়েছিল। বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশিদের মধ্যে শীঘ্রই এই প্রকল্পটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে প্রায় ১১.৮ মিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স প্রদান করা হয়েছিল। ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫০ মিলিয়ন ডলার এবং ১৯৯০-৯১ অর্থবছরে যা ৭৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। সৌদি আরব থেকে আগত অর্থ বাংলাদেশে বিদেশী অর্থ প্রেরণের সবচেয়ে বড় উৎস। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ওমান, বাহরাইন, কুয়েত, লিবিয়া, ইরাক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের বিদেশি রেমিট্যান্স বৈদেশিক অর্থ প্রেরণের অন্যতম প্রধান উৎস।[৪বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতি বছর সর্বোচ্চ রেমিটেন্স প্রেরণকারী এবং অর্থ প্রেরণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ শীর্ষ ১০ প্রবাসী বাংলাদেশীর নাম ঘোষণা করে। চলতি বছরে প্রবাসীরা দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়েছেন ২১ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের মোট প্রবাসী আয়ের ২ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার বড় দেশ ভারত প্রবাসী আয়েও এগিয়ে।
প্রবাসী আয় অর্জনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। ২০২২ সালের প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেশটি ২০২২ সালে প্রবাসী আয় পেয়েছে ১০০ বিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বের মোট প্রবাসী আয়ের ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ। আর দ্বিতীয় পাকিস্তান প্রবাসী আয় পেয়েছে ২৯ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের প্রবাসী আয় বিশ্বের মোট প্রবাসী আয়ের ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।
প্রবাসী আয়ে এগিয়ে থাকা দুটি দেশই তুলনামূলক প্রশিক্ষিত কর্মী বিদেশে পাঠায়। এ কারণে কম লোক পাঠিয়েও তারা বেশি প্রবাসী আয় নিয়ে আসে। অন্য দিকে বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত জনবল বেশি না হওয়ার কারণে বেশি লোক পাঠিয়েও কম প্রবাসী আয় নিয়ে আসে। বাংলাদেশের প্রবাসী আয় দেশের মোট জিডিপিতে অবদান রাখছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশিরা ২০২১ সালে ২ হাজার ২০৭ কোটি মার্কিন ডলার দেশে পাঠিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। টালমটাল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রভাব সামলাতে এই প্রবাসী আয় সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। এ জন্য প্রবাসীদের সম্মাননা, প্রবাসী আয়ের বিপরীতে প্রণোদনা, প্রবাসীদের বিশেষ মর্যাদাসহ বিভিন্ন রকম সুবিধা দিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। প্রচেষ্টা চালাচ্ছে প্রশিক্ষিত লোক পাঠানোরও। প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশের পরই আছে নেপাল। সে হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ায় চতুর্থ প্রবাসী আয় আহরণকারী দেশ হলো নেপাল। নেপালের জিডিপির ২১ দশমিক ৮ শতাংশ অবদান প্রবাসী আয়ের। দেশটি ২০২২ সালে প্রবাসী আয় আহরণ করেছ সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার; যা বিশ্বের মোট রেমিট্যান্সের ১ দশমিক ০৭ শতাংশ।
আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৫৯ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। তার আগের মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯৭ কোটি ডলার এবং তার আগের মাস জুনে এসেছিল ২১৭ কোটি ডলার। আগস্ট মাসের মতোই একই ধারা লক্ষ করা যাচ্ছে চলতি মাস সেপ্টেম্বরেও। চলতি মাসের প্রথম সাত দিনে মোট ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ ৭০ হাজার ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। বাংলাদেশি মুদ্রার এর পরিমাণ (এক ডলার সমান ১০৯.৫০ টাকা ধরে) ৪ হাজার ৩৮ কোটি টাকার বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি সেপ্টেম্বরের প্রথম সাত দিনে মোট ৩৬ কোটি ৮৮ লাখ ৭০ হাজার ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। এসময়ে রাষ্ট্র মালিকানাধীন ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩ কোটি ২০ লাখ ৮০ হাজার ডলার, বিশেষায়িত দুই ব্যাংকের মধ্যে এক ব্যাংকে এসেছে ৫৯ লাখ ১০ হাজার ডলার। বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ৩২ কোটি ৯১ লাখ ২০ হাজার ডলার এবং বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে এসেছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার ডলার। গত জুন মাসে রেকর্ড পরিমাণ ২১৯ কোটি ৯০ লাখ ডলার (২.১৯ বিলিয়ন ডলার) প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে। একক মাস হিসেবে যেটি ছিল প্রায় তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আসা প্রবাসী আয়। এর আগে ২০২০ সালের জুলাই মাসে ২৫৯ কোটি ৮২ লাখ ডলারের রেকর্ড প্রবাসী আয় এসেছিল। খাত সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০২০ সালে হুন্ডি বন্ধ থাকায় ব্যাংকিং চ্যানেলে সর্বোচ্চ সংখ্যক রেমিট্যান্স এসেছিল।
বিদায়ী ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা পাঠিয়েছেন ২ হাজার ১৬১ কোটি মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স। এটি এ যাবৎকালের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে করোনাকালীন ২০২০-২০২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল দেশে।
লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া দেশ মাতৃকার সেবায় রেমিট্যান্স যোদ্ধারা মত-দ্বিমত