বিএনপির আন্দোলনে জামায়াতের লুকোচুরি ও রাজনৈতিক কৌশল
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:১০
নীতি-আদর্শ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রায় একই হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে জনসমক্ষে বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্কে এক ধরনের টানাপোড়েন-এর দৃশ্যমানতা কি দল দুটির মধ্যকার প্রকৃত সম্পর্ক নির্ধারক? প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্তমানে এটি দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি জনপ্রিয় আলোচ্য বিষয়। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যে নির্মম পরিহাস এই যে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী জামায়াতের লুকোচুরি ও রাজনৈতিক কৌশল অন্যতম একটি বয়ানে পরিণত হয়েছে! প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে শান্তি ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের কারণে হিটলারের নাজি পার্টি জার্মানিতে নিষিদ্ধ! মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের কারণে বাংলাদেশেও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার কথা! ‘জামায়াত-ই-ইসলামী বাংলাদেশের জন্মে বাধা দিয়েছে। অতএব তাদের এদেশে রাজনীতি করার অধিকার নেই।’ ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে দুই দিনের ঢাকা সফরে এসে অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি একথাগুলোও বলেছিলেন জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবুল আলা মওদুদীর পুত্র সৈয়দ ফারুক মওদুদী। স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-ই-ইসলাম এবং ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর দেশের প্রথম সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান জামায়াত-ই-ইসলাম তথা ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি চালু করেন। তৎকালীন জামায়াত প্রধান গোলাম আযমকে ফিরিয়ে এনে তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। একারণেও জামায়াত বিএনপি-র প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে, এটিই স্বাভাবিক!
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াতে ইসলামী ভিন্ন ‘কৌশলে’ এগোচ্ছে। সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ দশ দফা দাবি ও জনসম্পৃক্ত নানা ইস্যুতে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে শক্তি দেখাতে চাইছে। একই সঙ্গেজামায়াতের নির্বাচনেরও প্রস্তুতি রয়েছে। যেসব আসনে সাংগঠনিক শক্তি বেশি, সেসব আসনে তারা প্রার্থীও ঠিক করেছে। তবে আপাতত দাবি আদায়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনেই থাকতে চায়। এজন্য তারা নানা কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকছে।
২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট যে নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল, সেখানে জামায়াতের অংশীদারিত্ব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিবন্ধনহীন জামায়াতে ইসলামী স্বনামে নির্বাচন করতে পারেনি। জামায়াতের ২২ জন প্রার্থী বিএনপির নির্বাচনী প্রতীক ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করলেও কোনো আসন পাননি। এ দলটি ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ১০টি, ১৯৯১ সালে ১৮টি, ১৯৯৬ সালে ৩টি, ২০০১ সালে ১৭টি এবং ২০০৮ সালে ২টি আসন পেয়েছিল। তাই নির্বাচনী জোট কিংবা আন্দোলনের জোটভুক্ত দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর চাহিদা এখনও ফুরিয়ে যায়নি বলে মনে হয়।
জামায়াত সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় পড়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হলে। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে শীর্ষ নেতাদের শান্তি হলে দলটি বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এরই মাঝে দলটির নিবন্ধনও বাতিল করা হয়েছে। তারপর থেকেই দলটি আড়ালে চলে গিয়েছিল। সম্প্রতি আড়াল ভেঙে রাজপথে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়া কি নতুন কোনো ইঙ্গিত?
প্রসঙ্গত, জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হলেও নিষিদ্ধ হয়ে যায়নি। জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে এখনও কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায়নি। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলিরা বলছেন, যুদ্ধাপরাধের জন্য দলটির বিচার করতে হলে আইন সংশোধন করতে হবে। এর আগে ২০০৯ সালের এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করেন। রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালে আপিল বিভাগের সংশ্নিষ্ট শাখায় লিভ টু আপিল ও আপিল করেছিল দলটি। এত দিনেও তার নিষ্পত্তি হয়নি। আবার বিদ্যমান আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইনে সংগঠনের বিচার ও শাস্তির বিধান নেই। তাই দলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে হলে আইন সংশোধন করতে হবে।
গত ১০ জুন ২০২৩ ঢাকায় জামায়াতের সমাবেশ নিয়ে সরকারের সঙ্গে জামায়াতের আঁতাতের অভিযোগ ওঠালে বিএনপির সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি হয়। পরে ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বিএনপি তখনকার মতো পরিস্থিতি সামাল দেয়। তবে দল দুটির মধ্যে মৌলিক বিষয়ে নৈকট্য এখনো সমানভাবে বিদ্যমান।
৩ আগস্ট ২০২৩ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং তাঁর স্ত্রী জুবাইদা রহমানের সাজা দেওয়ার ঘটনায় আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে জামায়াত। এ বিষয়টি উল্লেখ করে দুই দলের নেতারা বলছেন, এই বিবৃতি দুই দলের মধ্যে যোগাযোগ ও দূরত্ব কমার ইঙ্গিত দেয়। আবার দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুতে দলীয়ভাবে শোক প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিএনপির সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর মতাদর্শগত সাদৃশ্যের বহি:প্রকাশ ঘটেছে। হয়তো চিরদিনই তা-ই বজায় থাকবে। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিএনপি এবং জামায়াতের গৃহীত ও অনুসৃত কৌশল তাদের দৃশ্যত কিছুটা দূরবর্তী অবস্থান নিতে বাধ্য করেছে। দায়িত্বশীল নেতারা এড়িয়ে গেলেও চলমান যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির ও জামায়াত যে গোপন আলোচনা করেই কর্মসূচি দিয়ে মাঠে থাকছে তার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে ২৪ ডিসেম্বর (২০২২) দেশব্যাপী বিএনপির গণমিছিল কর্মসূচিতে।
দৈনিক কালের কন্ঠে ৮ আগস্ট ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিএনপির একটি সূত্র উধৃত করে বলা হয়, বিএনপি এখন আর জামায়াতের বিষয়ে খুব বেশি কৌশলী থাকতে চাইছে না। দলের নেতাদের কারো কারো মনোভাব হলো, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো জামায়াতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠক করছে, সেখানে বিএনপির কৌশলী থাকতে হবে কেন?
দৈনিক প্রথম আলো ২২ আগস্ট ২০২৩ তারিখে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, জামায়াতে ইসলামীর উচ্চপর্যায়ের নেতাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ‘কার্যত ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে জামায়াতকে এড়িয়ে চলার যে কৌশল নিয়েছে বিএনপি, মূলত একটি দেশকে সন্তুষ্ট রাখার ইচ্ছা থেকে দলটির নেতৃত্ব এই কৌশল নিয়েছে। জোট ভেঙে দেওয়া, জামায়াতের সঙ্গে স্বাভাবিক যোগাযোগ ছিন্ন করা ওই কৌশলেরই অংশ। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি এই কৌশল নিয়েছে, তা এখন পর্যন্ত সফল হয়নি।’
প্রথম আলোর এই প্রতিবেদনে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের-এর উধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘জামায়াত এটিকে দুর্ভাগ্যজনক হিসাবে গণ্য করছে যে, প্রতিবেশী দেশ অন্যায় এবং অজ্ঞতাপ্রসূত ভুল ধারণার ভিত্তিতে বসে আছে। তাদের আধিপত্যবাদী চিন্তা, হস্তক্ষেপ এবং একটি দলকে অন্ধভাবে সমর্থন করার বিষয়টি আঞ্চলিক নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করবে বলে মনে করি।’
‘বরং শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের কূটনৈতিক বার্তা সম্পর্কে ভারতের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর বিএনপিতে চরম অস্বস্তি তৈরি করেছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে বিএনপি-জামায়াতসহ সব মহলের মধ্যে যখন একটা ঐক্যপ্রক্রিয়া কাছাকাছি আসছিল, ঠিক তখন সেটাকে নস্যাৎ করা এবং বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে সংবেদনশীলতা সৃষ্টির জন্য ভারতের গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর প্রকাশ হয়েছে।’
২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে দৈনিক যুগান্তরে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতে ইসলামীর একজন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্যের উধৃতি দিয়ে বলা হয়, ২০১৬ সাল থেকে জামায়াত সমাজকল্যাণ ও সংগঠন গোছানোর কাজ করছে। এ সময়ে কয়েক লাখ কর্মী, ১০ হাজার রুকন বৃদ্ধি পেয়েছে। যুগান্তরের এই প্রতিবেদনটি যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলেতো বিএনপি-র জন্য তা একটি অশনি সংকেতই বটে। কারণ আন্দোলনের নামে মাঠে যেসব কর্মসূচী বিএনপি দিচ্ছে তা’ তলে তলে জামায়াত দ্বারাই পরিচালিত হচ্ছে !?
সংবাদপত্রে প্রকাশ, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতে ইসলামীর একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, জামায়াতের সব সময়ই নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকে। পরবর্তী ১০ বছরে প্রার্থী কারা হবেন তা ঠিক করে ফেলা হয়েছে। দলের এ, বি ও সি ক্যাটাগরির এলাকা আছে। এ ও বি ক্যাটাগরি এলাকার প্রার্থী আগেই ঠিক করা হয়েছে। সি ক্যাটাগরির প্রার্থী এখন ঠিক করা হচ্ছে। সেটা নির্বাচনকে সামনে রেখে করা হচ্ছে বিষয়টি তা নয়। এটা দলের একটি প্রক্রিয়ার অংশ। জামায়াতের দুটি বিভাগ রয়েছে-অভ্যন্তরীণ নির্বাচন বিভাগ ও স্থানীয় জাতীয় নির্বাচন বিভাগ। এর দায়িত্বও আলাদা। তারা এসব কাজ করে থাকে।
দৈনিক যুগান্তরের সাংবাদিক খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছেন, ২০২২ এর ২ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ২০২৩-২০২৫ কার্যকালের জন্য পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়েছে। এরই মধ্যে ৮৬ সাংগঠনিক জেলা শাখা ও এর অধীনে থাকা উপজেলা, থানা, পৌর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যায়ের সব কমিটি গঠন করেছে।
জামায়াতের সঙ্গে বর্তমান নিবিড় যোগাযোগের কারণ হিসেবে বিএনপির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আন্দোলনের এ পর্যায়ে এসে জোটে বিভক্তি তৈরি করতে চান না তাঁরা। যদিও জামায়াতের ব্যাপারে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক কয়েকটি দলের আপত্তি আছে। তাই সব কূল রক্ষা করে কিভাবে জামায়াতকে যুক্ত করা যায়, সে বিষয়টি প্রাধান্য দিচ্ছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা।
লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা। সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
অরুণ কুমার গোস্বামী বিএনপির আন্দোলনে জামায়াতের লুকোচুরি ও রাজনৈতিক কৌশল মত-দ্বিমত