খালেদা জিয়ার অসুস্থতা, বিএনপির ইস্যু তৈরির অপচেষ্টা
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:৪৯
বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করার চেষ্টা করছে। বেগম জিয়ার অসুস্থতাকে পুঁজি করে সুপরিকল্পিত ভাবে মাঠ গরমের চেষ্টা করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বেগম খালেদা জিয়া জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে, তাকে বিদেশে নিতে হবে। শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। বাংলাদেশে আর চিকিৎসা নেই, তাকে বিদেশে না নেয়া গেলে বাঁচানো দুস্কর হবে। বিএনপি নেতারা এই গঁৎবাধা কথা সেই ২০১৮ সাল থেকেই বলে আসছেন। এখন মানুষ আর এসব কথা বিশ্বাস করে না। মানুষের মৃত্যু কবে হবে তা একমাত্র জানেন মহান সৃষ্টিকর্তা।
বেগম জিয়া চিকিৎসা নিচ্ছেন এভারকেয়ার হাসপাতালে (সাবেক অ্যাপোলো)। এটি বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে বাংলাদেশের সেরা। এর আগে কারাগারে থাকার সময়ও দেশের সেরা সরকারি হাসপাতাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, তিনি সেরা চিকিৎসাটাই পাচ্ছেন। এরপরও বেগম জিয়াকে বিদেশে নেয়া না গেলেও বিদেশ থেকে ভালো ডাক্তার আনতে তো কোনো বাধা নেই। কিন্তু এমন উদ্যোগ বিগত সাড়ে তিন বছরে বিএনপিকে একবারও নিতে দেখা যায়নি। তারা যদি বেগম জিয়ার সুচিকিৎসার বিষয়টি প্রাধান্য দিতেন তাহলে নিঃসন্দেহে তারা এতদিনে বিদেশের সেরা সেরা ডাক্তার নিয়ে এসে চিকিৎসা করাতেন। বেগম জিয়া তো সরকারের হেফাজতে নেই, আছে পরিবারের কাছে। তাকে সুচিকিৎসা দেওয়ার একমাত্র দায়িত্ব পরিবার ও বিএনপির। তারাও জানেন একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামীর বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ নেই। এখন বিএনপি খালেদা জিয়ার অসুস্থতাকে রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করে সরকার পতনের দুঃস্বপ্ন দেখছে।
খালেদা জিয়ার শারিরীক অবস্থা নিয়ে সব সময়ই বিএনপি ধোঁয়াশা তৈরি করে এসেছে। এখন পর্যন্ত যেসকল ডাক্তারগণ বেগম জিয়ার চিকিৎসা করছেন, তারা আনুষ্ঠানিকভাবে তার স্বাস্থ্য নিয়ে কোনও ব্রিফিং করেননি। বিএনপি নেতাদের রাজনৈতিক বক্তব্য থেকেই জানা যাচ্ছে তিনি গুরুতর অসুস্থ, জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণে। বেগম জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই। তিনি ৭৮ বছর বয়স্ক এক মহিলা। দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, উচ্চরক্তচাপ, লিভার, কিডনি, ফুসফুসসহ নানা রোগে ভুগছেন। দুবার হাঁটুতে অপারেশন হয়েছে। এছাড়া কোভিডেও আক্রান্ত হয়েছেন। এতকিছুর পর তার অসুস্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
বিএনপির দাবি খালেদা জিয়া রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার। তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগই মিথ্যা। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলা তো আওয়ামী লীগ সরকার করেনি, করেছিল ১/১১ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দশ বছর ধরে মামলার শুনানি হয়েছে। এই সময়ে তিনি আইনের সকল সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছেন। তারপর আদালতে তিনি অভিযোগ প্রমানিত এবং সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন। বেগম জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজা ভোগ করছেন। ২০০৮ সালের ৩ জুলাই জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। রায় ঘোষণার পরই ওইদিনই তাকে পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কারাগারে নেয়া হয়। একই বছরের ৩০ অক্টোবর ওই রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়া হাইকোর্টে আপিল করলে তা খারিজ হয়ে যায়। একই সঙ্গে দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাজার পরিমাণ বাড়িয়ে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয় হাইকোর্ট। এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আরো সাত বছরের কারাদণ্ড দেয় আদালত। দুর্নীতির এই দুই মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বন্দি ছিলেন। এখন সরকারের নির্বাহী আদেশে দুইটি শর্তে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে রয়েছেন। শর্ত (এক) বেগম জিয়া বাসায় বসে চিকিৎসা নিবেন। (দুই) তিনি এই সময়ে বিদেশে যেতে পারবেন না।
বিএনপি নেতারা যারা এখন তর্জন-গর্জন দিচ্ছেন তাদের আন্দোলনে কিন্তু বেগম জিয়ার মুক্তি হয় নাই। মুক্তির বিষয়ে পুরো কাজটি করেছেন তার ভাই শামীম ইস্কান্দার। তিনি ২০২০ সালে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বেগম জিয়াকে জেল থেকে বাড়িতে নেওয়ার অনুরোধ করেন। মানবিক প্রধানমন্ত্রী সহানুভূতিশীল হয়ে নির্বাহী আদেশে খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে জামিন দেন। মানবিক প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যার বদান্যতায় সরকারের নির্বাহী আদেশে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ তিনি বাসায় ফিরেন। এরপর সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে গুলশানের বাসায় অবস্থান করছেন। প্রতি ছয় মাস অন্তর অন্তর পরিবারের আবেদনের প্রেক্ষিতে দন্ড স্থগিত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রতিবারই খালেদা জিয়া নিজ বাসায় চিকিৎসা নিবেন এবং দেশের বাইরে যেতে পারবেন না এই দু’টি শর্তে স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হয়। এবার নিয়ে অষ্টমবারের মতো তার জামিনের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অবস্থান অনেক বারই স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া আমাকে হত্যা করতে চেয়েছেন। তারা আমার মা, বাবা, ভাইসহ সবাইকে হত্যা করেছে। তবুও কিন্তু আমি মানবিকতা দেখিয়েছি। আমার পক্ষে যতটা সম্ভব করেছি। আমি তো অমানুষ না। তাই বাসার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। আর কত মানবিকতা দেখাব, আমার যা করার করেছি, বাকিটা আইন করবে।’ পৃথিবীর ইতিহাসে এমন নজির দ্বিতীয়টি খুঁজে পাবেন না। হত্যাকারীর উপর এমন মানবিক আচরণ কেউ করেননি। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেই হয়তো তিনি এমন মানবিক কাজগুলো করতে পারেন।
এক শ্রেণীর ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীরা আছেন, তারা বিভিন্ন ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমালোচনায় সর্বদা মত্ত থাকেন, তারাও খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে ইনিয়ে বিনিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে মানবিক হতে বলেন। তাদের কি স্মৃতিভ্রম হয়েছে? খুব বেশি দূরের কথা নয়, ২০০৪ সালে শেখ হাসিনাসহ পুরো আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল তারেক জিয়া গংয়েরা। সেদিন খালেদা জিয়া কতটা মানবিক ছিল? ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জনকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ বধ্যভূমিতে পরিনত হয়। মানুষের ছিন্নভিন্ন অঙ্গ এদিক ওদিক পড়েছিল। আহতরা যাতে চিকিৎসা নিতে পারে সেজন্য আগে থেকে ডাক্তারশূন্য করে রাখা হয় হাসপাতালগুলো। একটা মামলা পর্যন্তও করতে পারেনি আওয়ামী লীগ। খুনিদের বিদেশে যেতে সাহায্য করে খালেদা জিয়া। এখনও অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন। আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রক্তমাখা পাঞ্জাবি পরে সংসদে গিয়েছিলেন। কথা বলতে চাইলেও স্পীকার ফ্লোর দেননি। খালেদা জিয়া বরং মশকরা করে বলেছিলেন, শেখ হাসিনা ভ্যানিটি ব্যাগে করে বোমা নিয়ে গিয়েছিল। সেদিনের আচরণ কতটা মানবিক ছিল? শেখ হাসিনাকে যারা মানবিকতা শেখান, তারা নিজেরা একবার আয়নায় একটু মুখটা দেখেন।
বেগম জিয়া একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামী। তাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য অনুমতি দিতে পারে একমাত্র আদালত। কিন্তু বিএনপি কিংবা তার পরিবারের পক্ষ থেকে সে ধরনের কোনো উদ্যোগ কখনও নিতে দেখা যায়নি। খালেদা জিয়ার জন্য যারা মায়া কান্না করছেন, তাদের কিন্তু একবার তার মুক্তির জন্য তেমন কোনো জোরালো আন্দোলন কখনও করতে দেখা যায়নি। বেগম জিয়া একজন দন্ডপ্রাপ্ত আসামি হয়েও নিজ বাসায় বসবাস করেছেন এবং নিজের পছন্দ মতো হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারছেন একমাত্র মানবতার জননী শেখ হাসিনার মহানুভবতায়।
বিএনপি কি আদৌ কখনো খালেদা জিয়ার মুক্তি নিয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? মুক্তি ইস্যু নিয়ে শুধু রাজনীতি করতে চেয়েছে। পরিবার পদক্ষেপ না নিলে হয়তো এখনও বেগম জিয়াকে কারাগারেই থাকতে হতো। আর এখন খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার দাবিকে রাজনৈতিক ইস্যু তৈরির অপচেষ্টা করছে।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা- বিএনপির ইস্যু তৈরির অপচেষ্টা তাপস হালদার মত-দ্বিমত