প্রভিডেন্ট ফান্ডে বৈষম্যমূলক করারোপ
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:২২
‘প্রভিডেন্ট ফান্ড’ বা ‘ভবিষ্য তহবিল’ এই বিষয়টার সাথে কমবেশী আমরা চাকরিজীবীরা সবাই পরিচিত। আগে কেবল সরকারি চাকুরেদের ক্ষেত্রে এই সুবিধা প্রচলিত থাকলেও পর্যাক্রমে বেসরকারী চাকুরেদের জন্যও কর্মজীবনের নিশ্চয়তার অংশ হিসেবে এই প্রথা চালু আছে। আসুন জানি প্রভিডেন্ট ফান্ড বিষয়টা কী: প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ভবিষ্যত নিধি বা ভবিষ্যতের তহবিল। একজন নিয়মিত উপার্জিত ব্যক্তি তার সমগ্র কর্মজীবনের পুরোটা সময় ধরে কিছু অংশ বাধ্যতামূলকভাবে সঞ্চিত রাখে এই তহবিলে। গুগলে গেলেও এটাই পাবেন সবাই।
এখন এই ফান্ড বা তহবিল কি নিজে নিজে চলে? নাহ! এই ফান্ডের টাকার উপর একান্তই সেই কর্মিটির অধিকার আছে যে তহবিলের একজন সদস্য। অর্থাৎ, এই তহবিলটি গঠিত হয় একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা দ্বারা যা বাংলাদেশ শ্রম আইনের সপ্তদশ অধ্যায়ে “ভবিষ্য তহবিল” বিষয়ে পরিষ্কার বলা আছে। চাকরির একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর একজন নিয়মিত ও স্থায়ী কর্মী চাইলে সদস্যত্ব নিতে পারে এবং প্রতিমাসে তহবিলের নির্ধারিত হিসেবে মাসিক বেতন থেকে জমা হতে থাকে। আইন অনুযায়ী ঠিক সম পরিমাণ টাকা কোম্পানীর মালিকরাও দিতে বাধ্য। এর পরিমাণ কী হবে বা কীভাবে এই ফান্ড চলবে তার সবকিছুই পরিচালিত হয় শ্রম আইন, প্রভিডেন্ট ফান্ড আইন ও ট্রাস্টি ডিডে উল্লেখিত নিয়ম অনুযায়ী। এই ফান্ড আবার দুইভাবেই চলতে পারে। এনবিআর কর্তৃক অনুমোদিত বা অনুমোদন ছাড়া। তবে আজকের এই লেখা অনুমোদিত ফান্ডের বিষয়েই কারণ সরকার যে নতুন নিয়ম করেছে সেটা অনুমোদিত ফান্ডের বিষয়েই।
সরকারের নতুন নিয়মটা কী? নতুন নিয়ম হচ্ছে অনুমোদিত প্রভিডেন্ট ফান্ডের জমাকৃত অর্থের উপর যে বাড়তি পরিমাণ সুদ বা আয় আসে (বিনিয়োগের মাধ্যমে) সেই আয়ের ২৭.৫% হারে কর দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
আগে কী হতো? আগে তহবিলের মালিকানা সম্পূর্ণ তহবিলের সদস্যদের উপর থাকতো। এখানে থেকে একটা পয়সাও কোম্পানী বা মালিক পক্ষ নিতে পারতনা। তাহলে লাভের অংশ কী হতো? লাভের পুরো অংশটাই অন্তর্ভুক্ত সদস্যদের মধ্যে অডিটের মাধ্যমে ভাগ করে দেয়া হতো। যেহেতু প্রভিডেন্ট ফান্ড কর্মীর অবসর বা চাকরি ছেড়ে দেয়াকালীন সুবিধা তাই এই ফান্ডে সব অর্থই জমা হতো। এটা পুরোপুরি কর্মীদের একটি সুরক্ষা হিসেবে কাজ করে। কেউ একজন কোন কোম্পানীতে যতবছর কাজ করবে ঠিক তত বছরের হিসেব বরাবর দিতে হতো। নিয়ম মাফিক তহবিলে গড়মিলের কোন সুযোগই থাকেনা।
এখন সেই অর্থের উপর ভাগ বসালো সরকার। যেই অর্থের উপর কোম্পানীর কোন হাত থাকতে পারেনা বলে আইনে বলা আছে সেই অর্থের উপর সরকার নিজের ক্ষমতাবলে অধিকার বসানোর ব্যবস্থা করেছে। অথচ এই আয় কোন ফাও আয় নয়। প্রভিডেন্ট ফান্ডের সকল হিসেব একজন ব্যক্তির ট্যাক্স ফাইলে পরিষ্কার দেয়া থাকে। তারই জমাকৃত অর্থ থেকেই কিন্তু বাড়তি আয়টুকু আসে। বিষয়টা অনেকটা এমন যে আমি ব্যাংকে সেভিংস একাউন্ট খুললাম। নিজের টাকা জমা রাখলাম। সেই হিসাব সরকারকে দিচ্ছি কিন্তু সেভিংস থেকে ব্যাংক আমাকে যে নির্ধারিত লাভ দিচ্ছে সেখানেও এখন সরকার ট্যাক্স নিতে চাইছে।
এটা অযৌক্তিক এবং এটা অনধিকার চর্চা। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, এই নীতি কেবলই বেসরকারি সেক্টরের জন্য প্রযোজ্য। সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীরা এই আওতার বাইরে। কেন? দেশ এক, ভাষা এক, সংবিধান এক, সরকার এক অথচ আইন দুইরকম। এটাতো সরাসরি বৈষম্য হয়ে গেলো। আমাদের সংবিধানের বলা আছে রাষ্ট্রের সকল মানুষ সমান আইনে পরিচালিত হবে। সমান সুবিধাপ্রাপ্ত হবে। অথচ ট্যাক্স দেয়ার সময় সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের না আছে চাকরীর নিশ্চয়তা, না আছে সুযোগ সুবিধার নিশ্চয়তা। এই প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটি কিছুই কিন্তু ১০০ ভাগ কোম্পানী মেনে চলেনা। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা দীর্ঘমেয়াদী সুবিধা দিতে নারাজ। কর্মীরা যখন চাকরি ছেড়ে যায় তখন একদম খালি হাতে ফিরে যায়। আবার যদি কোন কারণে কোম্পানী কর্মীদের ছাঁটাই করে তখনও তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকে। সরকারী চাকরিতে কিন্তু এর কোনটাই সম্ভব নয়।
সরকারী চাকরিজীবীদের সবাই নানা ধরণের প্রণোদনা পায়, বৈশাখী বোনাস পায়, ভাতা পায় অথচ বেসরকারী ক্ষেত্রে কেউ কেউ দিলেও বেশীরভাগই দিচ্ছে না। সামান্য মাতৃত্বকালীন ছুটিটাকেইতো বাধ্যতামূলক করা যায়নি, সেক্সুয়াল হ্যারাজমেন্ট বিরোধি পলিসি করা যায়নি। তখন আমরা কিন্তু কোনও সরকারী বিধি দেখিনা। সরকারের কোনও তোড়জোড় দেখিনা সেইসব বিধি মানতে বাধ্য করতে। অথচ গুটিকয়েক কোম্পানী যখন এখনও কর্মীবান্ধব আচরণ ধরে রেখছে তাদেরকেও নিরুতসাহিত করা হচ্ছে কর্মীদের দেওয়া সুবিধার উপর হাত দিয়ে।
কীভাবে নিরুতসাহিত করছে এই আইন? শতভাগ কমপ্লায়েন্ট কোম্পানীর জন্যও কিন্তু এই ধরনের বাড়তি হিসেব রাখা বাড়তি চিন্তার বিষয়। এমনিতেই সরকারের ভ্যাট, ট্যাক্স বা নানা ধরনের রেগুলেটরি ইস্যু নিয়ে সবাই ব্যস্ত থাকে। এখন যখন নির্ভেজাল ফান্ডেও বাড়তি ক্যালকুলেশন যুক্ত করা হবে তখন মালিকপক্ষ প্রথমেই বলবে এইসব ফান্ড টান্ড বাদ হয়ে যাবে। এতো বাড়তি ঝামেলা তারা কর্মীদের জন্য কেন নিতে চাইবে? তার চেয়ে ফান্ড না থাকলে সরকারের হস্তক্ষেপও আসবেনা।
আমাদের মত দেশে শতভাগ চাকরির নিশ্চয়তা আমরা দিতে পারছিনা, সেটা সম্ভবও নয়। মালিকপক্ষকে কর্মী বান্ধব করা যাচ্ছেন বরং সুযোগ পেলেই কর্মীদের উপর খড়গ নেমে আসে। এমন একটি অসম সংস্কৃতির দেশে কর্মীদের জমাকৃত অর্থে থেকে আয়করা সামান্য কয়টা টাকার ভাগও যদি সরকারকে দিতে হয় তাহলে দিনশেষে ঘরে যাবে কী?
সরকারী ও বেসরকারী চাকরির নিয়ম আগে থেকেই বৈষম্যমূলক। বেতন ভাতা, সুযোগ সুবিধা কিছুই মিলেনা। বেসরকারী খাতে নিয়ম কানুনও নাই, নিশ্চয়তাও নাই। আছে কেবল পরিশ্রমের বিনিময়ে আয় করা কয়টা টাকা। সেটাতেও যদি সরকার নিয়ে নিতে চায় তাহলে এতো বিশাল একটি গোষ্ঠীকে নিপীড়ন করা হবে বলেই ধরা যায়। আর বেসরকারী খাতকে অবহেলায় রেখে দিনশেষে সরকার নিজের পক্ষে কতটা জনমত অর্জন করতে পারবে সেটা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
প্রভিডেন্ট ফান্ডের উপর করারোপ: বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত কেন? মত-দ্বিমত লীনা পারভীন