Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

লবিস্ট অপরাজনীতি ও মার্কিন সিনেটর বব মেনেনডেজ

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
২ অক্টোবর ২০২৩ ১৬:৩৬

বিএনপি-জামায়াতের লবিস্ট হিসেবে কাজ করছে এমন অনেকগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূর্নীতিবাজ নেতার মধ্যে অন্যতম একজন লবিস্ট হলো বব মেনেনডেজ। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বৈদেশিক সম্পর্ক কমিটির সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশের কয়েকজন নাগরিকের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার নেপথ্যে মেনেনডেজ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক খাতে আর্থিক লেনদেনের তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওপেনসিক্রেটস এর ওয়েবসাইটে রাস্কি পার্টনাসের কাছ থেকে মেনেনডেজের ২৩,১৪৯ ডলার গ্রহণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মেনেনডেজ বিএনপি জামাতের নিযুক্ত লবিস্ট ফার্মের কাছ থেকে টাকা গ্রহণ করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্যাংশন আরোপের উদ্যোগ নিয়েছেন – এমন অভিযোগ কোনোভাবেই উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অনৈতিকভাবে ও অযৌক্তিক কারণ দেখিয়ে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তার পেছনে ঘুষ দুর্নীতি জড়িত আছে বলে দেখা গিয়েছে। যেমন বিএনপি-জামাতের লবিস্ট ফার্ম রাস্কি পার্টনার্সের কাছ থেকে মেনেনডেজের ২৩ হাজার ডলার গ্রহণের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। শুধুই তাই নই মার্কিন সিনেটের ‘ফরেন রিলেশন কমিটি’র ডেমোক্র্যাট দলীয় সদস্য এই মেনেনডেজ বাংলাদেশের র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে এই মেনেনডেজই ২০২০ সালে তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসনকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপে তিনি বেশ কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে তৎকালীন ট্রাম্প প্রশাসনকে প্রভাবিত করেন। রাজনীতিতে অর্থের ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশকারী মার্কিন ওয়েবসাইট ‘ওপেনসিক্রেট’ এর ‘মানি ট্রানজেকশন’ থেকে জানা যায়, ২০২০ সালে ‘রাস্কি পার্টনারস’ ও ‘ব্লু স্টার’ নামে আমেরিকার দুটি লবিস্ট ফার্মকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর পক্ষ থেকে ২৩ হাজার ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এই দুটি লবিস্ট ফার্মের মালিক দুই মার্কিন সিনেটর, যারা পরবর্তীতে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞায় ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। এর আগে ২০১৫-২০২০ এই ৫ বছরে বিএনপি ‘রাস্কি পার্টনারস’ এর মাধ্যমে কোটি কোটি ডলার ঢেলেছে সরকারকে চাপে রাখার জন্য।

গত শুক্রবার নিউ জার্সির ডেমোক্র্যাট সিনেটর এই রবার্ট বব মেনেনডেজকে ৮ বছরে দ্বিতীয়বারের মতো লাখ লাখ ডলার দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হয়েছে। শুধু মেনেনডেজ নন তার স্ত্রীর বিরুদ্ধেও একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এই বব মেনেনডেজই বাংলাদেশের প্যারামিলিটারি বাহিনী র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার দাবির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক খবর হলো, পাহাড়সম দুর্নীতির অভিযোগে রবার্ট মেনেনডেজের পদত্যাগের জোর দাবি উঠেছে। এরই মধ্যে তিনি সিনেটে আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটি থেকে সরে এসেছেন। ডেমোক্র্যাটিক সিনেটর বেন কার্ডিন ওই পদে তার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন। এবারই প্রথম নয়, ২০১৫ সালেও একই পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল তাকে। সে সময় এক দাঁতের ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত মার্কিন সিনেটর মেনেনডেজের ঘটনা সামনে আসায় ঢাকায় আমেরিকা পর্যবেক্ষকদের মনে নতুন প্রশ্ন উঠেছে। কেননা মার্কিন সিনেটের উচ্চকক্ষে বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যানের পদ ব্যবহার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেন মেনেনডেজ। ট্রাম্প সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেইয়ের কাছে বাংলাদেশে মানবাধিকার হরণে র্যাবের ভূমিকার জন্য বাহিনীর বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞার দাবি তুলেছিলেন তিনি।

রিপাবলিকান সিনেটর টড ইয়ং এবং সিনেটের আরও আটজন সদস্যকে নিয়ে বাংলাদেশের প্যারামিলিটারি বাহিনী র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার দাবিতে নেতৃত্ব দেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট র্যাব এবং এই বাহিনীর সাত বর্তমান ও প্রাক্তন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকারসংক্রান্ত অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। এসময় ২০১৫ সাল পর্যন্ত র্যাবের বিরুদ্ধে ৪০০ জনকে হত্যার অভিযোগ তোলেন তিনি। যদিও এসময় তিনি কোনো দালিলিক প্রমাণ দিতে পারেননি। শুধু বাংলাদেশ নই রবার্ট বব মেনেনডেজ মিসরে স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকেও ঘুষের বিনিময়ে সহায়তা করেছেন। তার বিরুদ্ধে ৩৯ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে সেসব গুরুতর অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাদেশে র্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আহ্বানের ক্ষেত্রেও তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। জানুয়ারির আসন্ন সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রশাসন ও রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বিরোধীদল থেকে গণমাধ্যম পর্যন্ত ভিসা নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসছে। পরিস্থিতি দেখে অনেকেই মন্তব্য করছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে ‘রক্ষা’র দায় যুক্তরাষ্ট্র নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তবে এমন রক্ষকের ভূমিকায় থাকা দেশটির একজন সিনেটরের এহেন আমলনামা নানা প্রশ্নের উদ্রেক করছে।

পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূর্নীতিবাজ নেতাদের বিএনপি-জামায়াতের লবিং হিসেবে কাজ করাটা আন্তর্জাতিক আইনের এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক আদর্শের পরিপন্থী। গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে সাড়া বিশ্বে সুপরিচিত একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ মূলত বাংলাদেশে তাঁদের কোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নের অপপ্রচেষ্টার ইঙ্গিত বহন করছে। যা কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারেনা। আর এদিকে, রাজনীতির বর্তমান সময়ে নিজ দেশের জনগণের কাছে না গিয়ে লবিং করে তৃতীয় কোনো দেশকে দিয়ে নিজ দেশের ক্ষতি করানোর বিএনপি-জামায়াতের যে প্রবণতা তা যে কোনো মানদন্ডে রাস্ট্রদ্রোহীতা। খালেদা জিয়া তা করেছেন এবং তার দলের শীর্ষ কিছু নেতৃবৃন্দ এই ধরনের নেগেটিভ রাজনীতিতে বিশ্বাস করেন, যা হতাশাজনক ও লজ্জার। আমাদের বোধগম্য হয় না, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমাদের যেখানে আর কোনোদিনই ৭১-এর পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া সম্ভব না, সেখানে, বিএনপি এই বাস্তবতা মানতে পারছে না কেনো? তারা কেনো জনগণের কাছে যেতে পারছে না? বাংলাদেশের জনগণের এই টাকাটা দিয়ে তারা কিছু লবিস্ট নিয়োগ দিয়েছে, যারা বাংলাদেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে।বিএনপি-জামায়াত তাদের ব্যাপারে মানুষের মনোজগতে অবিশ্বাস, ঘৃণা ও দূরত্ব তৈরিতে এই একটি স্ক্যান্ডালই যথেষ্ঠ। আর এভাবে তাঁরা নিজেদেরই ক্ষতি করছে। এখনও সময় আছে বিএনপি-জামায়াতের বোঝা উচিত যে মুক্তিযুদ্ধের শক্তিতে উদ্বুদ্ধ বাঙালি জাতি কখনো অন্যায়ের কাছ মাথা নত করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবেনা। দেশের স্বার্থে রক্ত দিতে পারা বাঙালি জনগণ সকল অন্যায়ের দাঁতভাঙা জবাব দিতে সবসময় প্রস্তুত। বাঙালি জনগণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাঁর অযুক্তিক নিষেধাজ্ঞা এবং বিএনপি-জামায়াতের অর্থে লালিত লবিস্টদের রাজনৈতিক অপতৎপরতাকে তোয়াক্কা করেনা। বাঙালি জনগণের শক্তি ও সমর্থনে বিশ্বাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালি জনগণ বিএনপি-জামায়াতের অর্থে কেনা বব মেনেনডেজের মতো লবিস্টদের এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার উপযুক্ত জবাব দিবে সঠিক সময়ে এবং সঠিক উপায়ে।

গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নীতি নিঃসন্দেহে বিএনপি এর লবিং রাজনীতির অপতৎপরতা ফসল। জনগণের সমর্থন হারিয়ে বিএনপি-জামায়াত এখন লবিং অপরাজনীতিকে তাঁদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘদিন যাবৎ। বাংলাদেশের সম্পদ আত্মসাৎ করে বিএনপি-জামায়াত যে সম্পদ অর্জন করেছে তা ব্যবহার করে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে লবিং অপরাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে তাঁরা। তাঁদের এই অপতৎপরতাকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কিছু অসৎ এবং দূর্নীতিবাজ নেতৃবৃন্দ। তাঁরা বিএনপি-জামায়াত থেকে অর্থ খেয়ে নিজেদের ফায়দা লুটতে বিএনপি-জামায়াতের লবিস্ট হিসেবে কাজ করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের গণতন্ত্রের চর্চায় বাঁধা তৈরী করে যাচ্ছে।

লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটিলিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া মত-দ্বিমত লবিস্ট অপরাজনীতি ও মার্কিন সিনেটর বব মেনেনডেজ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর