বাবা জানতে চাইবেন না, কাকে বেশি ভালোবাসি
৩ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:২৪
সাধারণত ‘বাবা’ মানেই রাশভারী একজন পুরুষ। অন্তর পর্দায় এই মানুষটিকে ঘিরে থাকে ভয়, রাগ, শাসন আর গাম্ভীর্য। আসলেই কী তাই? একজন কন্যা সন্তানের কাছে বাবা মানে এক আকাশ নির্ভরতা এবং রাশি রাশি আস্থার অনুভূতি নয় কি? সত্যিকার অর্থে বাবা আর কন্যার সম্পর্ক সব সময়ই যেন একরৈখিক; আলাদা কিছু নয়। এ যেন একে অপরের জন্য শ্রষ্ঠার শ্রেষ্ঠ দান। কন্যার কাছে বাবা হলেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা অ্যাঞ্জেল। বাবাই কন্যার বড় দার্শনিক ও বন্ধু। অ্যাঞ্জেল আর দার্শনিকের মধ্যেই কন্যার প্রত্যাশা সিমীত থাকে না। এসব ছাপিয়েও কন্যার কাছে বাবা মানেই আদর, স্নেহ, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা, নির্ভরতা, আস্থা, আত্মবিশ্বাস ও মান-অভিমান। বাবা যেন মাথার উপর শীতল-কোমল ছায়া। বাবার কাছে কন্যা হলো হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান- ‘আয় রে আমার কাছে আয় মামণি, এ হাতটা ভালো করে ধর এখনই…’। কন্যাই বাবার আনন্দ, প্রশান্তি এবং চিরায়ত নির্মল সুখ। অর্থাৎ একে অপরের জান ও জীবন।
পিতা-কন্যার এই চিরায়ত মায়া, ভালোবাসা, হৃদ স্পন্দন, নির্ভরতা বা টান যাই বলি না কেন, কোথা থেকে তা আসে? যা অন্য কারো ক্ষেত্রে হয় না? এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাবা-মায়ের মস্তিষ্ক ছেলে বা মেয়ে সন্তানের প্রতি সমান সাড়া ফেললেও মেয়ে সন্তানের প্রতি বাবার আবেগ অনুভূতির কম্পন ভিন্ন। ফলে বাবার প্রতি ছেলে সন্তানের চেয়ে মেয়ে সন্তান বেশি অনুরক্ত হয়। তেমনি সম্পর্ক ছিল বাবা ভুবন চন্দ্র শীল এবং মেয়ে ভূমিকা রানী শীলের মাঝেও। ভুবন চন্দ্র শীলের একমাত্র মেয়ের আর্তনাদ ভারি হয়ে উঠেছে চারদিকে পরিবেশ। বাবাকে হারিয়ে নির্বাক ভূমিকা। ‘বাবুই (বাবা) তো তার সবকিছু ছিল। ভূমিকার বাবা স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন মেয়ে বাবার মতো আইনজীবী নন, বড় চিকিৎসক হবেন; কিন্তু মেয়ে ব্যবসায়ী হওয়ার কথা জানান বাবাকে। বাবাও তাই মেনে নিয়েছিলেন। একমাত্র মেয়ের ছোট ছোট দাবি ও স্বপ্ন পূরণ করতেন বাবা। এখন মেয়ের স্বপ্নগুলো কে পূরণ করবে? বাবা দিবসে মেয়ে বাবাকে কীভাবে উইশ করবে? মেয়ে ভূমিকা রাগ করলে কে মা বলে রাগ ভাঙাবে? ভূমিকা দুই চোখে তার বাবাকে খুঁজে ফেরেন। একমাত্র মেয়ে জন্মদিন আর জাঁকজমকভাবে হবে না?
মেয়েকে নিয়ে ভারতে তীর্থস্থানে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল ভুবন চন্দ্র শীলের। সেই বাবাকেই রাস্তায় গুলি করে মেরে ফেলেছে সন্ত্রাসীরা! মেয়ের ভাষ্য, ‘আমার বাবার তো কোনো দোষ ছিল না, তিনি নিষ্পাপ-নির্দোষ ছিলেন, তাকে মারল কেন?’ বাবার মৃত্যুর খবর শুনে মা রত্নার কাঁধে মাথা রেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিলেন ভুবন চন্দ্র শীলের মেয়ে ভূমিকা। অস্পষ্ট কণ্ঠে ভূমিকা বলছিলেন, বাবার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল সন্ত্রাসীদের গুলি লাগার আগের দিন রাতে। এ সময় বাবা বলছিলেন, কদিন পরই বাড়ি আসবো। তোমার জন্য কী আনতে হবে মা? বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় তারা মাঝে মধ্যে আমাকে নিয়ে বাজি ধরতেন। আমি কাকে বেশি ভালোবাসি সেটি নিয়ে। কিন্তু আমি বাবাকেই বেশি ভালোবাসতাম। আবার বাবা ঢাকায় চলে এলে মাকে সরি বলতাম। এটি নিয়ে ফোনে আবার তাদের মধ্যে খুনসুটিও হতো। কান্নাজুড়ে দিয়ে ভূমিকা এখন বলেন, এখন কাকে নিয়ে মজা করবো? বাবা তো আমাদের ফেলে রেখে চলে গেলেন। বাবা আমাকে সবসময় মা বলে ডাকতেন। এখন আমাকে কে ডাকবে মা বলে? আর আমি কার মা হবো? প্রতিদিন ফোন করে কে বলবে মা তুমি আজ সারাদিন কী করেছো, কী খেয়েছো? তোমার কী পছন্দ? তোমার জন্য কী নিয়ে আসবো? আমার শখগুলো কে পূরণ করবে?
ভুবনের মেয়ে ভূমিকা চন্দ্র শীল সদ্যই এসএসসি পাস করেছেন। নোয়াখালীর মাইজদীতে একটি কলেজে ভর্তির প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছিল। মেয়েটিকে ঘিরে নানা স্বপ্ন ছিল বাবা ভুবন চন্দ্র শীলের। বাবার স্মৃতি হাতড়ে মেয়ে বলেন, এসএসসি পাস করার পর বাবা ফোনসেট কিনে দিয়েছিলেন। এরপর নানা কথা হতো তার সঙ্গে। আমি খাসির মাংস পছন্দ করায় বাবা তা খেলেই আমাকে ফোন দিতো।
রাজধানীর সড়কে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া আইনজীবী ভুবন চন্দ্র শীলের একমাত্র মেয়ে ভূমিকা হাসপাতালের মেঝেতে বসে এসব বলেই বিলাপ করছিলেন। এ সময় তাকে সান্ত্বনা দেওয়ারও কেউ ছিল না, পরিবারের অন্য সদস্যরাও বিলাপ করছিলেন চোখের জলে। অসময়ে বাবার এই অনাকাক্সিক্ষত চলে যাওয়ার পর মেয়ে ভূমিকা এখন বাবাকে ঘিরে নানা ঘটনা, নানা স্বপ্ন হাতড়াচ্ছে। ‘নির্দোষ বাবাকে মারল কেন?’- মলিন মুখে কিশোরী ভূমিকার সত্য-শক্ত সেই প্রশ্নের জবাব যেন কারো কাছে নেই। আর কিছুদিন পরেই শারদীয় উৎসব দুর্গাপূজা। এই বড় উৎসবে ভূমিকার পছন্দের জামা-কাপড় কে কিনে দিবে? কার হাত ধরে পূজামণ্ডপগুলো ঘুরে বেড়াবেন তিনি?
ঘটনার দিন ভুবন ছিলেন পথচারী। তেজগাঁওয়ে রাস্তা পার হওয়ার সময় একটি গুলি এসে লাগে ভুবন চন্দ্র শীলের মাথায়। যে সন্ত্রাসীরা গুলি করেছিল, তাদের সঙ্গে ভুবনের কোনো বিরোধ ছিল না। কিন্তু তাদের ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলিতেই সাত দিন হাসপাতালে অচেতন থাকার পর প্রাণ হারান ভুবন। ভুবনহীন পৃথিবীতে তার স্ত্রী রত্মা রানী শীল, মেয়ে ভূমিকা রানী শীল অসহায় হয়ে পড়লেন। মা গিরিবালা শীল হারালেন একমাত্র ছেলেকে। অথচ কথা ছিল, মোটরসাইকেলে ভুবন চন্দ্র শীল দ্রুত বাসায় ফিরবেন। ফিরে হয়তো স্ত্রীকে ফোন করতেন, মায়ের ও মেয়ের খোঁজ নিতেন।
ভুবনের মৃত্যুর খবর শোনার পর কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছেন স্ত্রী রত্না। ভুবনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে ঢাকা চলে আসেন স্ত্রী রত্না ও মেয়ে ভূমিকা। স্ত্রী রত্না হাসপাতালের সিঁড়িতে অপেক্ষায় ছিলেন। চিকিৎসকের মুখ থেকে ভুবনের মৃত্যুর সংবাদ শুনে তিনি বলে ওঠেন, ‘স্যার, ভুবন আমাদের রেখে মরতে পারে না। আপনারা আরো একটু চেষ্টা করেন, তাকে মৃত ঘোষণা করবেন না। তাকে বাঁচানোর জন্য আরো চেষ্টা করুন। ও চলে গেলে এই শূন্য পৃথিবীতে আমি বেঁচে থেকে কী করবো? আমার মেয়েটা বাবাকে ছাড়া কিছু বুঝত না। আজ তার বাবা নীরবে চলে গেল। আমার মেয়েটা এত অভাগা, তার ছোট ছোট স্বপ্নও আর পূরণ হলো না।’
রত্না কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, ভুবন খুব শখ করে একটি আংটি বানিয়ে দিয়েছিল। সেটিও ওর চিকিৎসার জন্য বিক্রি করে দিলাম। তারপরও ভুবনকে বাঁচাতে পারলাম না।
ধীরে ধীরে এই নারী, এই মা, এই স্ত্রী, নীরবে সিঁথির সিঁদুর মুছে ফেলবেন। হিন্দু বিধবার দুঃসহ জীবনে আটকে পড়বেন। একমাত্র কন্যা ভূমিকাকে নিয়ে আগামীর দিন যাপন করবেন। একদিন ভূমিকার নিজের সংসার হবে। স্মৃতি হাতড়ে ভূমিকা বাবাকে খুঁজবেন।
মনোবিজ্ঞানীদের গবেষণা দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ শেষে পিতা-কন্যার সম্পর্ক নিয়ে একটি উপসংহারে আসার চেষ্টা করা যেতে পারে। তা হচ্ছে- একজন কন্যা সন্তানের কাছে বাবা তার জন্য সম্পূর্ণ একটি ‘পৃথিবী’। আর সেকারণেই সে তার এই ‘পৃথিবীর’ যত্ন আর দেখাশোনায় কোনো কমতি রাখে না। বাবাকে খুশি করতে তার ভালো-মন্দের খোঁজ রাখতে এমনকি বাবার হয়ে অন্য সবার সঙ্গে লড়তে একজন কন্যা সন্তানের কখনো ক্লান্তি আসে না। তাই কন্যা সন্তানের বাবা কখনোই নিজেকে দুর্বল বা অরক্ষিত ভাবার সুযোগ পান না। একজন কন্যার কাছে তার বাবাই সবচেয়ে সেরা মানুষ বলে বিবেচিত হন। অনেকটা সুপার হিরোদের মতো। আর সেকারণেই একজন কন্যা সন্তানের বাবা সেরা প্রশংসাটি শুধু কন্যা সন্তানের কাছ থেকেই শুনতে পান। সুতরাং একজন বাবা বা একজন কন্যার জীবনে এরচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত আর আসতে পারে না। ভালো থাকুক সকল বাবা ও কন্যা।
লেখক: সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই
পলাশ চন্দ্র দাস বাবা জানতে চাইবেন না- কাকে বেশি ভালোবাসি মত-দ্বিমত