Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নোবেল বিজয়ীর অধিকারের যাঁতাকলে পিষ্ট শ্রমিকের অধিকার

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া
৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:০৯

অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে শ্রমিকদের স্বার্থ ও অধিকারের কথা ভুলে গিয়ে বিশ্বের ১৬০ বিশিষ্ট ব্যক্তি সাজাপ্রাপ্ত আসামি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা স্থগিত করতে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বরাবর চিঠি বা বিবৃতি দিয়েছেন। তাদের এই বিবৃতি নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের পরিপন্থী এবং পাশাপাশি বাংলাদেশের মতো স্বাধীন দেশের স্বাধীন বিচারকার্যের উপর সরাসরি হন্তক্ষেপের নামান্তর যা কোনোভাবেই গ্রহনযোগ্য নয়। এর চেয়েও অবাক হওয়ার বিষয় হচ্ছে একটি স্বাধীন দেশের সংবিধানের আলোকে সাজাপ্রাপ্ত একজন আসামি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দেওয়ার মানুষ আছে কিন্তু শ্রমিকদের অধিকারের পক্ষে বিবৃতি দেওয়ার কেউই নাই! এই ১৬০ জন বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তির বিবৃতি আন্তর্জাতিক শ্রম আইনের পরিপন্থী হওয়া সত্ত্বেও তার বিপক্ষে মানে শ্রমিকদের স্বার্থে বিবৃতি দেওয়ার মতো কোনো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার্থে কী তাহলে কারো কোনো ধরনের মাথাব্যথা নেই?

নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসের পক্ষে ক্রমাগত পর এক বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিনটনসহ শতাধিক নোবেল বিজয়ী এবং এমেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের মতো সংস্থা। সরকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে বিভিন্ন মামলায় জর্জরিত করে একজন নোবেল বিজয়ী ডঃ ইউনুসকে হয়রানী করছে সুতরাং এসকল মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া উচিৎ বলে সবাই একবাক্যে বলেছেন। এই বিবৃতিদানের পক্ষে বিপক্ষে দেশে বিদেশে তৈরি হচ্ছেন নানান মত।

ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে এখন পর্যন্ত প্রায় আড়াইশোটি মামলা যার মধ্যে একটি মাত্র ফৌজদারি মামলা ছাড়া বাকি সকল মামলাই দায়ের করেছে ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যান, গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশন ও গ্রামীণ কমিউনিকেশনের শ্রমিক কর্মচারীরা। শ্রমিকদের চাকুরি স্থায়ী না করা, কর্মচারী অংশীদারিত্ব ও কল্যাণ তহবিল গঠন না করা এবং কোম্পানির লভ্যাংশের ৫% কর্মচারীদের প্রদান না করা সংক্রান্ত শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে একমাত্র ফৌজদারি মামলাটি দায়ের করা হয়েছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর হতে। শ্রমিকের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, বিষয়ে মামলা যা সরকারের কোন স্বার্থ নেই। বরং রাষ্ট্র অসহায় শ্রমিকদের ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিতে করতেই এই মামলা করেছে। এই মামলা সমূহের মধ্যে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারীগণ তাদের দায়েরকৃত ১১০ টি মামলা লভ্যাংশ প্রাপ্তির প্রেক্ষিতে প্রত্যাহারের আবেদন করেছে। বাকি মামলাগুলো ‘সাবজুডিস’ ম্যাটার হওয়ায় সেগুলোর আলোচনা না করে গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকদের মামলাসমূহ সম্পর্কে একটু জানা যাক।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের চাকুরি স্থায়ী না করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করে আসছিল যা শ্রম আইনের পরিষ্কার ব্যত্যয়। লুকিয়ে আছে শ্রমিকদের অধিকার বঞ্চিত করার এক ঘৃণ্য পরিকল্পনা। শ্রম আইন অনুযায়ী একটি প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী কর্মচারীগণ প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের অংশীদার হয়, প্রভিনেন্ট ফান্ড সহ আনুষাঙ্গিক সুযোগ সুবিধা লাভ করে এবং নিজস্ব দাবি দাওয়া আদায়ে ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে পারে।

দেশের শীর্ষ স্থানীয় চার্টার্ড একাউন্টেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘হুদা ভাসি এন্ড কোং’ এর ২০১৪ সালের অডিট রিপোর্টের মাধ্যমে আশার আলো নিয়ে আসে। এই প্রতিষ্ঠানটি ২০০০ সাল থেকে গ্রামীণ টেলিকমের অডিট রিপোর্টের কাজ করে আসলেও ২০১৪ সালে তারা প্রথমবারের মতো উল্লেখ করে যে গ্রামীণ টেলিকমকে শ্রমিকদের ৫% লভ্যাংশ প্রদান করতে হবে। গ্রামীণ টেলিকমের পক্ষ হতে তাদেরকে এই রিপোর্ট পরিবর্তনের জন্য বলা হলে তারা সেটি করতে রাজি না হওয়ায় গ্রামীণ টেলিকম পরবর্তী বছর অডিট ফার্ম পরিবর্তন করে ‘একনাবিন চার্টার্ড একাউন্টস’ নামক নতুন অডিট ফার্ম নিয়োগ দেয়। ‘একনাবিন’ অডিট ফার্মটিও ২০১৫ সালের অডিট রিপোর্টে শ্রমিকদের লভ্যাংশ প্রদানের পক্ষ মতামত দিলে গ্রামীণ টেলিকম তাদেরকেও পরিবর্তন করে ‘জে আর চৌধুরী’ নামক নতুন অডিট ফার্মকে নিয়োগ দেয় যারা কিনা মাত্র দুইদিনের মধ্যে গ্রামীণ টেলিকমের পছন্দানুযায়ী অডিট রিপোর্ট প্রদান করে।

অডিট রিপোর্টের মতামত অনুযায়ী লভ্যাংশ প্রাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় গ্রামীণ টেলিকমের ২৭ জন শ্রমিক কর্মচারী ২০১৭ সালে সর্বপ্রথম শ্রম আদালতে চাকুরি স্থায়ী এবং লভ্যাংশ প্রাপ্তির দাবিতে মামলা দায়ের করে। পরবর্তী বছরগুলোতে গ্রামীণ টেলিকমের অন্যান্য শ্রমিকরাও একই দাবিতে মামলা করে। গ্রামীণ টেলিকমের পক্ষ থেকে শ্রম আদালতে দায়েরকৃত মামলা বাতিলের দাবিতে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করা হয়। শুধু তাই নয় এসকল মামলাসমূহের রায় নিজেদের পক্ষে আনার জন্য গ্রামীণ টেলিকম ‘ঢাকা লজিস্টিকস’ নামক একটি লবিস্ট ফার্মের সাথে তের কোটি আশি লক্ষ টাকার একটি চুক্তিও করে। যদিও গণমাধ্যমে এই খবর প্রকাশিত হবার পর সেই চুক্তি বাতিল হয়। গ্রামীণ টেলিকম তথা ডঃ ইউনুসের পক্ষ হতে কোটি কোটি টাকা আইনজীবী ফি বাবদ খরচ করা হয়েছে এসকল মামলাকে দীর্ঘায়িত করতে। এসব মামলা চলাকালীন সময়েই ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর এক নোটিশে গ্রামীণ টেলিকমের সকল কর্মচারীকে (৯৯ জন) চাকুরিতে থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। আইনগত ভাবে স্বীকৃত অধিকার আদায়ে আদালত প্রাঙ্গনে ঘুরতে থাকা অসহায় শ্রমিক কর্মচারীদের প্রতি কতটা ক্ষোভ ও আক্রোশ থাকলে কোভিড মহামারীর সময় তাদের চাকুরিচ্যুত করা যায়! কোথায় ছিলেন তখন ডঃ ইউনুসের পক্ষে দাঁড়ানো বিবৃতি দাতাগণ? নাকি সকল অধিকার শুধু নোবেল বিজয়ীর জন্যই বরাদ্দ!

গ্রামীণ টেলিকমের ১৮ জন শ্রমিক এবং গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ কমিউনিকেশন ও গ্রামীণ ডিস্ট্রিবিউশনের শ্রমিকগণ এখন পর্যন্ত কোন লভ্যাংশ পায়নি। সেই মামলাসমূহ এখনো চলমান রয়েছে। ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস আইনজীবীদের পেছনে কোটি কোটি টাকা খরচ করছেন এসকল মামলা দীর্ঘায়িত করা জন্য কিন্তু শ্রমিকদের দিচ্ছেন না ন্যায্য পাওয়া। ডঃ ইউনুস তার নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহে শ্রমিকদের অধিকার বারংবার লংঘন করেছেন, তাদেরকে ন্যায্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত করেছেন। যখন অধিকারের দাবিতে শ্রমিকরা আইনের আশ্রয় নিতে গিয়েছেন তখন তাদেরকেই হয়রানি করা হয়েছে, করা হয়েছে চাকুরিচ্যুত।

যদি তাই হয় তাহলে ১৯১৯ সালে ভার্সাই চুক্তির অধীনে শ্রমিকদের স্বার্থ উদ্ধার ও অধিকার আদায়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠা কেন গঠন করা হয়েছিল? এই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আন্তর্জাতিক শ্রম নীতিমালা ও কর্মসূচি প্রণয়ণ, শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ, আন্তর্জাতিক শ্রমমান উন্নয়ন, শ্রমিকদের সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, শ্রমিকদের অধিকার আদায় ও শ্রমিক-মালিকে সম্পর্কের উন্নয়ন, শ্রমিকদের জীবনমান ও কর্ম পরিবেশ উন্নয়ন, শ্রমিকদের পূর্ণ কর্মসংস্থান, কাজের সময় ও মজুরী নির্ধারণ, আন্তর্জাতিক শ্রমনীতি বাস্তবায়নে সদস্য দেশসমূহকে সহায়তা করা ইত্যাদি কাজসমূহ সম্পাদনের লক্ষ্য নিয়ে পথচলা শুরু করেছিল। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ এই আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সদস্যপদ লাভ করেছিল। কিন্তু অত্যন্ত বেদনাদায়ক বিষয় হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের স্বার্থ উদ্ধারে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ভুমিকা একাবারেই নীরব। বাংলাদেশ এই সংস্থার সক্রিয় সদস্য হওয়ায় বাংলাদেশে শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষায় আন্তজার্তিক শ্রম সংস্থা এগিয়ে আসা উচিত সত্ত্বেও তারা তা করেনি।

বঙ্গবন্ধু তনয়া জননেত্রী শেখ হাসিনার একান্ত প্রচেষ্টায় দেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে। এই তহবিল থেকে যে কোনো শ্রমিক কর্মরত অবস্থায় দুর্ঘটনাজনিত কারণে স্থায়ীভাবে অক্ষম হলে অথবা মৃত্যুবরণ করলে, জরুরি চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ ও দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার জন্য এবং শ্রমিকদের সন্তানের উচ্চ শিক্ষার জন্যেও আর্থিক সহায়তা পাচ্ছেন। বর্তমান আওয়ামীলীগ সরকার রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের সার্বিক কল্যাণে আর্থিক সহায়তা প্রদানে একটি কেন্দ্রীয় তহবিল গঠন করেছে এবং তার দ্বারা শ্রমিকদেরকে সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। সব সেক্টরে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে। তাদের যুক্তিক অধিকার আদায়ে দেশের প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক সংঘ বা শ্রমিক কল্যাণ পরিষদ গঠনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশ সংবিধানে শ্রমিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার্থে শ্রমিক আইন রয়েছে যা দিয়ে শ্রমিক শ্রেণি সম্পর্কিত যেকোনো অসংগতিকে সমাধান করা হয়। শ্রম আদালতে বিচারাধীন ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বর্তমান বিচারিক মামলার অভিযোগকারীরা তার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকমের কর্মী। এখানে সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। শ্রমিকরাই মামলা নিয়ে এসেছে এবং এই মামলা নিয়ে তারা কি করতে চায় তা সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার একান্তই তাদের। দ্বিতীয় শ্রম মামলাটি- শ্রম আইন লঙ্ঘনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের জন্য শ্রম বিভাগ থেকে করা হয়। প্রফেসর ইউনূসের পক্ষ থেকে অভিযোগগুলো সঠিক নয় এমন কোনো প্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়নি। যা দাবি করা হয়েছে তা হলো ‘ব্যতিক্রমবাদ’। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। ফলে বাংলাদেশের শ্রম আদালতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শ্রম আইন লঙ্ঘনের অপরাধে সাজা হয়েছে। এটা তো যেকোনো দেশের জন্য একদম স্বাভাবিক একটা বিষয়।

লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটিলিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া নোবেল বিজয়ীর অধিকারের যাঁতাকলে পিষ্ট শ্রমিকের অধিকার মত-দ্বিমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর