পারমাণবিক যুগে দেশ: শাবাশ শেখের বেটি, শাবাশ বাংলাদেশ
৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:৫২
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপ্ন দেখেছিলেন বাংলাদেশ হবে পারমাণবিক শক্তি সম্পন্ন দেশ। সেলক্ষ্যে তিনি কাজও শুরু করেছিলেন। আজ তারই কন্যা প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করলো। ৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ইউরেনিয়াম হস্তান্তর উদ্বোধন করেন। হস্তান্তর প্রকৃয়ার মধ্যদিয়ে পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় ৩৩ তম দেশ হিসেবে বিশ্ব অঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করলো বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রোসি অনলাইনে সংযুক্ত ছিলেন। রূপপুর প্রান্তে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমানের হাতে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করেন পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদনকারী রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পারমাণবিক শক্তি করপোরেশনের (রোসাটম) মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ।
বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৩ তম পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশে পরিনত হয়েছে। রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রে জ্বালানি হিসেবে পারমাণবিক বা ইউরেনিয়াম এসে পৌঁছানোর কারণেই বাংলাদেশ পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হলো। এটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে একটি বিশাল অর্জন। গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাশিয়া থেকে বিশেষ বিমানে পারমাণবিক জ্বালানি ঢাকায় পৌঁছেছে। পরদিন রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে পৌঁছানো হয়।
বাংলাদেশের আগে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, জার্মানি, জাপান, স্পেন, ইউক্রেন, সুইডেন, বেলজিয়াম, চেকপ্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, পাকিস্তান, হাঙ্গেরি, স্লোভেনিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, রোমানিয়া, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলারুশ, স্লোভাকিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইরান ও আর্মেনিয়া।
১৯৬১ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এই রূপপুরেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিন্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। পদ্মার পাড়ে প্রকল্প স্থাপনের জন্য ২৬০ একর ও আবাসিকের জন্য আরো ৩২ একর জমিও অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু সম্পূর্ণ রাজনৈতিক কারণে হঠাৎ কাজ বন্ধ করে প্রকল্পটি পশ্চিম পাকিস্তানের করাচিতে সরিয়ে নেয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এবং প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব দেয়া হয় বিশিষ্ট পরমানু বিজ্ঞানী ডক্টর এম ওয়াজেদ মিয়াকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর প্রকল্পটি মুখ থুবড়ে পড়ে। পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে আওয়ামী লীগ পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশিয়া সফরকালে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এবং একই বছরের ২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাশিয়ার রোসাটমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান অ্যাটমস্ট্রয় এক্সপার্টের সঙ্গে বাংলাদেশের পরমাণু শক্তি কমিশন চুক্তি করে। এবং ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর পারমাণবিক প্রকল্পের চুল্লীর জন্য কংক্রিটের মূল স্থাপনা নির্মাণের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন পরমানু শক্তি কমিশন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাশিয়ার অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট। সকল ধরনের প্রযুক্তিগত যন্ত্রাংশ রাশিয়া থেকে আনা হয়েছে। রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান জেএসসি অটোমেনারগোম্যাশ- চুল্লিপাত্র, স্টিম জেনারেটরের যন্ত্রাংশ, প্রধান সঞ্চালন পাইপলাইন, প্রধান সঞ্চালন পাম্প, চাপ কমানো যন্ত্র, জরুরি শীতলীকরণ ব্যবস্থা, নিস্ক্রিয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ ১৪ ধরনের সরঞ্জাম তৈরি করেছে। ‘পারমাণবিক চুল্লি’ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ। যেখানে মূল জ্বালানি ইউরেনিয়াম থাকবে। এটিকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হার্ট বা হৃদপিণ্ড বলা হয়। পারমাণবিক চুল্লি পাত্রটির ওজন ৩৩৪ টন এবং স্টিম জেনারেটরের ওজন ৩৪০ টন। এ ধরনের যন্ত্রাংশ পরিবহন একটি জটিল প্রকৃয়া। এগুলো রাশিয়ার বৃহত্তম শিল্প কারখানা ভোলগোদোনস্কের অটোম্যাসের কারখানায় প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখান থেকে প্রথমে বিশেষ যানে সিমলিয়ান্সক বন্দরে নেয়া হয়। তারপর জাহাজে কৃষ্ণ সাগর,সুয়েজ ক্যানেল পাড়ি দিয়ে ১৪ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের মোংলা বন্দরে পৌঁছায়।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রাশিয়ার ভিভিইআর ১২০০ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি তৃতীয় প্রজন্মের চেয়েও অগ্রগামী বা থ্রি-প্লাস বলা হয়। যা পুরোপুরি বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন হয়ে গেলেও কোনো প্রকার অপারেটরের সাহায্য ছাড়াই এই ধরনের প্রযুক্তি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে। পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা বলয়ের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনকালীন দুর্ঘটনা ঝুঁকি নেই বললেই চলে। এছাড়া রয়েছে রাশিয়ান প্রযুক্তির স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা। তারপরও যদি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটে তাহলেও এর তেজস্ক্রিয় পদার্থ জনগণের সংস্পর্শে যাবেনা। শক্তিশালী ঘুর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার সক্ষমতা আছে। তিন দিন বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকলেও প্লান্টির কোনো প্রকার ক্ষতি হবে না। পরিবেশ দূষণ হবে না।প্লাট থেকে ধোঁয়া বের হবে না, কোনো প্রকার শব্দও হবে না। পারমাণবিক শক্তির সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ‘স্পেন্ট নিউক্লিয়ার ফুয়েল’ অর্থাৎ ব্যবহৃত তেজস্ক্রিয় জ্বালানি রাশিয়া ফেরত নিয়ে যাবে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি একক ভাবে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা। ঋণ হিসেবে রাশিয়া মোট ব্যয়ের ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা দিয়েছে, বাকিটা বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে ব্যয় করছে। বাস্তবায়ন ব্যয় তুলনামূলক বেশি হলেও তেল, গ্যাস ও কয়লার মতো দামি জ্বালানি না থাকার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় কম হবে। এক কেজি ইউরেনিয়ামে যে পরিমান উৎপাদন করা যাবে, তা করতে তেল লাগবে ৬০ টন অথবা কয়লা লাগবে ১০০ টন। প্রকল্পের স্থানীত্বকাল ধরা হয়েছে কমপক্ষে ৫০ বছর এবং সংস্কার করলে স্বায়ীত্বকাল গিয়ে দাঁড়াবে ১০০ বছর। প্রকল্পে সাড়ে চার হাজার রাশিয়ান ও বাংলাদেশের প্রায় ১৮ হাজার লোক সাড়ে ছয় বছর কাজ করেছে ।
রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুইটি ইউনিট থেকে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ২০২৪ সালের মাঝামাঝি থেকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে। আর ২০২৬ সালের মধ্যে পুরো দুইটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।পুরো উত্তরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবং জিডিপিতে ২ শতাংশ অবদান রাখবে।
২০৪১ সালে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মানের ক্ষেত্রে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের বিকল্প নেই। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে ব্যাপক বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে বিদ্যুৎ ছাড়া সব কিছুই অচল। জীবনযাপন, উন্নয়ন, উৎপাদন কোনো কিছুই বিদ্যুৎ ছাড়া কল্পনা করা যায়না। বিদ্যুতের প্রধানত উৎস তেল, গ্যাস, কয়লা ও পানি।দিনে দিনে এসব উৎসের যোগান কমে যাচ্ছে, যার কারণে অস্বাভাবিক ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ঠিক রাখার পরিকল্পনারই একটি অংশ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র।
স্বাধীনতার ৫২ বছর পর পারমাণবিক শক্তির যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ। এটি শুধুমাত্র একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নয়। এর মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে নিউক্লিয়ার দেশের কাতারে স্থান করে নিয়েছে। আত্মমর্যাদার ক্ষেত্রে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বক্তব্যের শেষাংশে কবিতার ভাষায় যথার্থই বলেছেন, ‘পিতা চেয়েছিল পরমানু যুগ শুরু হোক রূপপুরে, পিতার চাওয়া হয়েছে পূরণ কন্যার হাত ধরে। রূপপুর আজ রূপ পেয়েছে অর্জন অশেষ; এই না হলে শেখের বেটি শাবাশ, শাবাশ বাংলাদেশ।’
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই
তাপস হালদার পারমাণবিক যুগে দেশ: শাবাশ শেখের বেটি- শাবাশ বাংলাদেশ মত-দ্বিমত