Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অক্টোবর: উন্নয়ন বনাম আন্দোলন

অরুণ কুমার গোস্বামী
১১ অক্টোবর ২০২৩ ১৩:৫৪
‘কেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো অক্টোবরকে তাদের রাজনৈতিক ভাগ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে?’ “অক্টোবর : আন্দোলন বনাম উন্নয়ন” শিরোনামের এই লেখাটির জন্য উত্থাপিত এই প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেসব রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন সাংবিধানিক ও নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়ে “আন্দোলনে নেমে পড়েছে” সেসব দলের মধ্যে প্রধান হচ্ছে বিএনপি। স্মর্তব্য, পুনরায় ক্ষমতায় এলে বিএনপি ইতোপূর্বে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধান ছুড়ে ফেলার ধ্বংসাত্মক ঘোষণা দিয়ে রেখেছে! তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনী তফসিল নভেম্বরে ঘোষণার আগে অক্টোবর মাস তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আবার, সরকারি দল আওয়ামী লীগের জন্যও অক্টোবর গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন তথা বাস্তবায়নের দিক দিয়ে। কারণ, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর উন্নয়ন প্রকল্প ঘোষণা বা উদ্বোধন করা নির্বাচনী আইনে নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে ২০২৩ এর অক্টোবরের মধ্যেই সব মেগা উন্নয়ন প্রকল্প উদ্বোধন বা ঘোষণার কাজগুলো সমাপ্ত করার তাগিদ আওয়ামী লীগের আছে। সে অনুযায়ী, ৫ অক্টোবর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রুশ ফেডারেশন বাংলাদেশের কাছে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করেছে। ৭ অক্টোবর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১০ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা ও যশোরের মধ্যে রেল যোগাযোগের ঢাকা-ভাঙ্গা অংশের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছেন। রেল সার্ভিসের উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ট্রেনে পদ্মা সেতু অতিক্রম করার স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে।’ শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়েকে আন্ত:এশীয় রেলওয়ের সঙ্গে যুক্ত করার লক্ষ্য আমাদের রয়েছে।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম টানেলের উদ্বোধন হবে আগামী ২৮ অক্টোবর ২০২৩। উদ্বোধনের পরদিনই টানেলের ভেতরে যান চলাচল সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।   এর মাঝে ঢাকায় মেট্রোরেলের মতিঝিল পর্যন্ত চলাচল শুরু, এবং ১৪০টি সেতু, ১২টি ওভারপাস ও যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র (ভিআইসি) উদ্বোধন অনুষ্ঠান হবে। উদ্বোধন হতে পারে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেল চলাচলেরও।
এসব উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় এগিয়ে আসবে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে পারে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের তফসিলের পর উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করা যায় না। কারণ, তা নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য হয়। উল্লেখ্য, ভোট হতে পারে আগামী জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে।
২০০৯ থেকে টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘দিন বদলের সনদ’ শিরোনামে নির্বাচনী ইশতেহারে স্বপ্ন ছিল রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের। এরপর ২০১৪ সালের সরকার গঠন করে ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ স্লোগানে ইশতেহার দিয়ে। গ্রহণ করে ১০টি মেগা উন্নয়ন প্রকল্প। ২০১৮ সালে ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’শিরোনামে ইশতেহার প্রণয়ন করে, ২০৪১ সালের উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ এবং ২১০০ সালে ‘নিরাপদ ব-দ্বীপ’ প্রণয়নের রূপরেখা প্রদান করে। ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন। ইশতেহার প্রণয়নে কাজ শুরু করেছে দলটি। এবার লক্ষ্য- স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ। এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে বিশদ বিবরণও দিয়েছেন।
অপর দিকে, বিএনপি সূত্র উদ্ধৃত করে সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে ৮ থেকে ২০ অক্টোবর পর্যন্ত টানা নতুন কর্মসূচি দিচ্ছে তারা। তবে, ৮ তারিখ পাড় হয়ে গিয়েছে। ২০ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত পূজার সময় কর্মসূচি দিবে না দলটি। ২৪ তারিখের পর থেকেই চূড়ান্ত ‘ডু অর ডাই’ আন্দোলন করার পরিকল্পনা তাদের। তখন পর্যায়ক্রমে গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ঘেরাওসহ টানা অবস্থান কর্মসূচিতে যেতে পারে বিএনপি। পাশাপাশি রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের মতো কর্মসূচিও আসতে পারে। বিএনপির নেতারা জানায়, এ চূড়ান্ত ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণার আগে ১৮ অক্টোবরের দিকে ঢাকায় বড় সমাবেশ করে সরকারকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম দিতে পারে বিএনপি। ঘেরাও আন্দোলনের পরবর্তীতে দেশব্যাপী অবরোধ, ধর্মঘটের মতো দেশ অচল করার কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে। সবশেষে পরিস্থিতি বুঝে হরতাল কর্মসূচিতে যাবে বিএনপি।
কিন্তু বিএনপি চাইছে তফসিল ঘোষণার আগেই নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক ফয়সালা নিশ্চিত করতে এবং এ লক্ষ্যে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই বড় ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণার চিন্তা আছে দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। এসব কর্মসূচির মধ্যে ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘিরে কর্মসূচিসহ নানা ধরণের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে দলের অভ্যন্তরে।
তবে, ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা দেয়া সম্পর্কিত বিএনপি-র ইতিহাস বাংলাদেশ, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং বাংলাদেশের নির্বাচনের জন্য কল্যাণকর নয়। বরঞ্চ অঘোষিতভাবে সফল-ব্যর্থ অভ্যুত্থান ঘটিয়ে, নির্বাচনের নামে প্রহসন করা এবং অগণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্রে দলটির অনেক সফলতার ইতিহাস আছে। “প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড, সো হোয়াট…” বক্তব্যের বক্তা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট গণতান্ত্রিক  পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকার প্রধানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে গণতন্ত্রের প্রতি বেঈমানী ও কলঙ্কের সূচনা করেছিল। এরপর দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে তথাকথিত সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার বন্ধের জন্য ইনডেমনিটি আইন পাস করিয়েছিল; বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বৈদেশিক দূতাবাসে চাকুরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল; জাতিরপিতার খুনীদের রাজনৈতিক দল ফ্রিডম পার্টি গঠনের সুযোগ করে দিয়েছিল; বিচারপতি সায়েমকে অস্ত্রের মুখে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিল; সেনাবাহিনীর অসংখ্য সদস্যদের বিনাবিচারে ফাঁসি দিয়েছিল, যার বিচার এখন পর্যন্ত হয় নাই; সেনাবাহিনীর চাকুরিরত অবস্থায় জিয়াউর রহমান নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন; যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন; সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে এবং পরে জাতীয় সংসদে সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানকে ধর্মীয়ভাবে সাম্প্রদায়িকীকরণ করেছিলেন; রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকা অবস্থায় রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন; প্রহসনের ‘হাঁ’ ‘না’ ভোট করেছিলেন; প্রহসনমূলকভাবে প্রেসিডেন্ট এবং জাতীয় সংসদ ইলেকশন করেছিলেন। এতসব অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক কর্মকান্ডে সমৃদ্ধ বিএনপি-র ইতিহাস। অপর দিকে, বিএনপি যখন ১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬ মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল তখন দেশটাকে দুর্নীতি ও জঙ্গিদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিল।  ২০২৩-এর অক্টোবরে মূলত বিএনপি কর্তৃক ঘোষণা দেয়া নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে যেসব ঐতিহাসিক ঘটনা আছে সেগুলোর মধ্যে অল্পকিছু উপরে উল্লেখ করলাম।
সমগ্র আক্টোবর মাসব্যাপী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কেন্দ্রিক রাজনৈতিক যুক্তি-পাল্টা যুক্তি তথা তর্ক-যুদ্ধ স্বাভাবিকভাবেই অব্যাহত থাকবে। এই তর্ক-যুদ্ধ ততক্ষণ পর্যন্তই স্বাভাবিক যতক্ষণ তা সহিংস হয়ে না ওঠে। অতীতের ২০০১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগে, নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচনের পরের সহিংসতা আমাদের এব্যাপারে সতর্ক হওয়ার শিক্ষা দেয়। নির্বাচন কেন্দ্রিক সহিংসতার ব্যাপারে ২০১৪ সালের পেট্রল বোমা হামলা, নিরীহ মানুষ হত্যা এমনকি পুলিশ হত্যা বিএনপি-র সহিংসতার ব্যাপারে আরও বেশি সতর্ক হওয়ার জন্য আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে।
অক্টোবরে উদ্বোধনকৃত উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ উদ্বোধন ছাড়াও আমরা ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডের সংক্ষিপ্ত তথা-উপাত্ত উল্লেখ করা সঙ্গত হবে।
এই সময়ের মধ্যে যোগাযোগ খাতে বৈপ্লবিক উন্নয়ন হয়েছে। নদীমাতৃক বাংলাদেশে নিরবচ্ছিন্ন সড়ক ও রেলযোগাযোগ স্থাপনের জন্য পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু, তিস্তা সেতু, পায়রা সেতু, দ্বিতীয় কাঁচপুর সেতু, দ্বিতীয় মেঘনা, দ্বিতীয় গোমতী সেতুসহ শত শত সেতু, সড়ক, মহাসড়ক নির্মাণ, পুনঃনির্মাণ করেছে সরকার। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে জিডিপির আকার ছিল মাত্র ৬০ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপি’র আকার ৪৬০ দশমিক সাত-পাঁচ বিলিয়ন ডলার। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৩৭৩ কোটি টাকা; ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি; ২০০৫-০৬ অর্থবছরে কৃষি খাতে ভতুর্কি দেওয়া হয় ৫৯২ কোটি; ২০২২-২৩ অর্থবছর কৃষি খাতে মোট ভর্তুকির পরিমাণ ৪০ হাজার কোটি; ২০০৫-০৬ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছিল ১ কোটি ৭৯ লাখ মেট্রিক টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে চাল, গম, ভুট্টো ৪ কোটি ৭২ লাখ ৮৮ হাজার মেট্রিক টন।
২০০৯-২০২৩বছরে জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী দেশরতœ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রাজ্ঞ নেতৃত্বে টেকসই, বাস্তবসম্মত, অর্থনৈতিকভাবে ইতিবাচক ও মানবিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। একসঙ্গে যুগপৎভাবে অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনগণের জীবনমানের উন্নয়ন খুব কম দেশেই সাধিত হয়েছে। এই যুগপৎ কল্যাণমুখী উন্নয়ন শেখ হাসিনার জীবনের এক অনন্য অর্জন। তার দূরদর্শী নেতৃত্বে পৃথিবীর ৯৪তম আয়তনের অষ্টম ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশ আজ ৩৫তম অর্থনীতির দেশ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জনগণ স্বাভাবিকভাবেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে বিজয়ী করে উপরোল্লিখিত উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখবে।
লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ, ঢাকা

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এসবিডিই

অক্টোবর: উন্নয়ন বনাম আন্দোলন অরুণ কুমার গোস্বামী মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর