রেকর্ড খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বস্তিতে দেশ
১৮ অক্টোবর ২০২৩ ২০:৪৪
অর্থনীতির অস্বস্তির মাঝেও দেশে এ বছর রেকর্ড খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছে। রেমিটেন্স ও রপ্তানি আয়ে নিম্নগতির ফলে রিজার্ভের পতন, রাজস্ব আয়ে নিম্নহারে বর্তমানে দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। এই অবস্থায় দেশে চার কোটি ৭৭ লাখ টনের রেকর্ড খাদ্যশস্য উৎপাদন সরকারকে রেখেছে স্বস্তির মধ্যে। এর মধ্যে শুধু চালই উৎপাদিত হয়েছে চার কোটি টনের বেশি। ফলে, সরকারকে চাল আমদানি নিয়ে ভাবতে হচ্ছে না। বাংলাদেশ শুধু খাদ্যশস্য উৎপাদনেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেনি, অন্যান্য ফসল উৎপাদনেও আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো, এ সময়ে ফসলের বহুমুখীকরণ হয়েছে। কৃষক এখন আর ধান-পাট চাষ নিয়েই ব্যস্ত থাকছে না, লাভজনক ফসল হিসেবে নানা ধরনের সবজি, ফল (দেশী-বিদেশী) উৎপাদনে পারদর্শিতা দেখিয়েছে। ফলে, দেশীয় চাহিদা পূরণ করে কৃষিপণ্যের রপ্তানির পরিমাণও বাড়ছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও সোমবার পালিত হয়েছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল– ‘পানিই জীবন, পানিই খাদ্য/ কেউ থাকবে না পিছিয়ে’। খাদ্য দিবসে বিগত ১৫ বছরের অগ্রগতি তুলে ধরে কৃষি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। এই বিশেষ সংখ্যা একনজরে কৃষির সাতটি সাফল্য তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সাতটি কৃষিপণ্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে। এর মধ্যে ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, জাম জাতীয় ফল উৎপাদনে চতুর্থ, ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ এবং আলু উৎপাদনে রয়েছে সপ্তম স্থানে। বাঙালির জন্য এটি পরম গৌরবের। সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০১৩ সালে নিরাপদ খাদ্য আইন তৈরি করে সরকার। ২০১৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর এই আইনের আওতায় ২ ফেব্রুয়ারি গঠন করা হয় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ।
খাদ্য উৎপাদনে স্বংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। ধান, গম, ভুট্টা আলু, আম বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ।স্বাধীন বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশের পর থেকে বাংলাদেশের কৃষিনীতির মূল লক্ষ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে খাদ্য-শস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন।ক্রমান্বয়ে কৃষিজমি কমতে থাকা, জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও বৈরী প্রকৃতিতেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে এই বাংলাদেশ এখন বিশ্বে উদাহরণ।ধান উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। অতীতের খাদ্য ঘাটতির বাংলাদেশ আজ খাদ্য উদ্বৃত্তের দেশে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতাপরবর্তী প্রারম্ভিক বছরগুলোয় দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছিল। সৃষ্টি হয়েছিল দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি। খাদ্যাভাবে মারা গিয়েছিল উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ। বাংলাদেশের খাদ্য সংকটকে ইঙ্গিত করে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ একটি ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন।তবে বাস্তবতা হচ্ছে সেই বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সেই বাংলাদেশ এখন ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশসহ বিশ্বের ১৪৪ দেশে খাদ্যপণ্য রপ্তানি করে। এখন সেই ঝুড়ি ভরে উপচে পড়ছে খাদ্যশস্য।জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যানুযায়ী, সবজি ও মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। ধান ও আলু উৎপাদনে যথাক্রমে চতুর্থ ও সপ্তম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও দুর্যোগসহিষ্ণু শস্যের জাত উদ্ভাবনেও শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন তিন গুণেরও বেশি, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ এবং ভুট্টার উৎপাদন বেড়েছে দশ গুণ।
কেবল উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অধিকাংশ দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষকরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বের জন্য উদাহরণ। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করছে। এ সাফল্য সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। চাল, মাছ, মাংষ ও সবজি উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম মাছ উৎপাদনকারী দেশ। পোল্ট্রি শিল্পে গত ১০ বছরে বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২০০ শতাংশ। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর এবং বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ী ২০১০ সালে হাঁস-মুরগির শিল্পে উৎপাদন আয় ছিল ১০ হাজার কোটি টাকা। যা বেড়ে ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার কোটিতে পৌঁছেছে। দেশের প্রায় ১ দশমিক ৬৫ লাখ মানুষ ডিম ও মাংস উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত। প্রাণিসম্পদ অধিদফতর দাবি করেছে, দেশে এখন মোট ৮১ হাজার ৬১৪টি পোল্ট্রি ফার্ম রয়েছে।
২০০৮-০৯ সালে বাংলাদেশের চালের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ১৩ লাখ টন, যা ২০২২-২৩ সালে ৪ কোটি টনেরও বেশিতে উন্নীত হয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে গমের উৎপাদন ছিল ৮ লাখ ৪৯ হাজার টন, ২০২২-২৩ সালে ১১ লাখ ৭০ হাজার টন, ভুট্টা ছিল ৭ লাখ টন যা এখন ৬৪ লাখ টন, আলু ৫ লাখ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ টন, সবজি ৩০ লাখ টন থেকে বেড়ে হয়েছে ২ কোটি ২০ লাখ টন। গত ১৫ বছরে বৈরী পরিবেশ সহনশীল জাতসহ মোট ৬৯৯টি উন্নত বা উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল উদ্ভাবন ও ৭০৮টি কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্যে ধানের জাত ৮০টি। ধানে বিশ্বে গড় উৎপাদনশীলতা প্রায় তিন টন, আর বাংলাদেশে তা ৪ দশমিক ১৫ টন। তা ছাড়া এক কোটি নয় লাখ টন আলু উৎপাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায়। সাড়ে ১০ লাখ টন আম উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্বে নবম স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তা ছাড়া হেক্টরপ্রতি ভুট্টা উৎপাদনে বৈশ্বিক গড় ৫ দশমিক ১২ টন। বাংলাদেশে এ হার ৬ দশমিক ৯৮ টন। খাদ্যশস্যে প্রতি হেক্টরে ১০ দশমিক ৩৪ টন উৎপাদন করে বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের পরে রয়েছে আর্জেন্টিনা, চীন ও ব্রাজিল।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। খাদ্যে এই স্বয়ংসম্পূর্ণ অবস্থান বজায় রাখতে সরকার নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। চলমান আন্তর্জাতিক সংকটেও দেশে খাদ্য নিরাপত্তা সুরক্ষিত আছে। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে দাঁড়িয়েছে। কৃষি গবেষণা, সম্প্রসারণ ও কৃষি ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উপকরণ ও নীতি সহায়তার ফলে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পেরেছে।কোভিড অতিমারী ও রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বে খাদ্যপণ্যসহ সকল ক্ষেত্রে যোগানব্যবস্থার সংকট সৃষ্টি হয়েছে কিন্তু এ সংকট মোকাবেলার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ সরকার প্রতিনিয়ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে চলতি অর্থ বছরে মূল্যস্ফীতি বাড়লেও সরকার তা নিয়ন্ত্রণ ও জনগণের ওপর এর প্রভাব প্রশমনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক সময় বলা হতো ‘মাছে ভাতে বাঙালি’। বর্তমান সরকার তার সুপ্রসারিত কৃষি নীতিতে শুধু মাছে ভাতে সীমিত নয় পুষ্টিতে বাঙালি হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিত হতে চায়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও বর্তমান জনগণবান্ধব সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। চলতি অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ২৭৬৫ মার্কিন ডলার। পরিশেষে বলতেই হয়, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের যত অর্জন আছে, তার মধ্যে খাদ্য-শস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো।
লেখক: ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়; সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটিলিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এজেডএস
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া রেকর্ড খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বস্তিতে দেশ