Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের বিরামহীন সহযোগিতা

ওয়ারেছা খানম প্রীতি
২১ অক্টোবর ২০২৩ ১০:৪৬

দীর্ঘ একটা সময় পর্যন্ত সন্তানের মা হিসেবে কোথাও কোনো লিখিত ডকুমেন্টেশন ছিল না। পুরুষ শাসিত সমাজ অভিভাবক হিসেবে মাকে কখনোই প্রয়োজন মনে করেনি। তাই সন্তানের জীবনযাত্রার কোনো কার্যক্রমেই মায়ের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। একেতো পুরুষ নারীর মাতৃত্বকে স্বীকৃতি দিতে চায় না বলে ডকুমেন্টশন নেই, তার ওপরে সন্তান যদি কখনো বলে এটা আমার মা না তাহলে কিন্তু সেটাই প্রমাণিত হবে। ঘটনা অপ্রিয়, তারপরেও এইটুকু সার্কাজম করতে ইচ্ছে হলো। কারণ স্কুল থেকে শুরু করে সন্তানের পরবর্তী পেশাগত জীবনের কোনো স্তরেই বোঝার উপায় ছিল না সন্তানের মা কে।

বিজ্ঞাপন

নারীর সেই বিরল ক্ষমতা প্রাপ্তির সুযোগ করে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সন্তানের একাডেমিক ও যেকোনো প্রফেশনাল ফর্ম পূরণের ক্ষেত্রে অভিভাবকের নাম যুক্তকরণের প্রয়োজন পড়লে সেখানে বাবার নামের পাশাপাশি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য হিসেবে মায়ের নামের একটি ছক থাকে। এটা যে নারীর প্রাথমিক অধিকার সেটা নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কেউ হয়ত মানতেই পারেননি। দেশব্যাপী নারী সমাজ বিশেষ করে মায়েরা সেই অধিকার প্রাপ্তিতে অশ্রুসজল হয়েছিল। এদেশে নারীর অধিকারহীনতা এবং নারীর প্রতি বৈষম্য এতোটাই প্রকট যে, কোনটা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিলীন করতে হবে সেটাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু সেটা সম্ভব হয়েছে এক ঐতিহাসিক রায়ের ফলে। সন্তানকে নয় মাস দশ দিন পেটে রেখে এবং রাতদিন এক করে লালনপালন করেও সন্তানের নাকি অভিভাবক মা নন। নারীর প্রতি কী চূড়ান্ত পরিহাস! অথচ মায়ের পরিচয়ই সন্তানের প্রথম পরিচয় হওয়া উচিত। সন্তানের প্রতি মায়ের একক অভিভাবকত্বের বিষয়টা সরকারের একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। বৈবাহিক স্ট্যাটাস বদলে যাওয়ার পরেও সন্তান নিয়ে যুদ্ধ করছেন নারী। দাম্পত্যের টক্সিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা মায়েরা এখন থেকে নিজের একক পরিচয়ে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে পারবেন। যে সম্পর্ক একসময় ছিল অসম্মান ও গ্লানির, এখন থেকে সেই অতীত সম্পর্কের জের ধরে এক্স হাসব্যান্ডের নাম সন্তানের সঙ্গে বয়ে বেড়াতে হবে না। নারীকে একক অভিভাবক হিসেবে ক্ষমতায়ন করে বর্তমান সরকার নারীকে কী ভীষণ অসম্মান থেকে মুক্তি দিয়েছে এবং জীবনে স্বস্তি এনে দিয়েছে সেটা একমাত্র ভুক্তভোগী মায়েরাই জানে।

নারীর পারিবারিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক অবদানকে অগ্রাহ্য করার কোনো সুযোগ নেই এবং সেটা আপামর নারীর ক্ষেত্রে সত্য হয়ে উঠেছে বর্তমান সরকারের শাসনামলে। লেখাপড়া করে উচ্চপদে চাকরি করা যায়, ক্যারিয়ার নিয়ে আমাদের ভাবনার সর্বোচ্চ পরিধি ছিল এই পর্যন্তই। কিন্তু ব্যবসা করেও যে নিজেকে উচ্চপদে নিয়ে যাওয়া সম্ভব সেই ভাবনাটা তৈরি হয়েছে মাত্র এই কয়েক বছর হলো। এর কারণ বর্তমান সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি ও পর্যাপ্ত পরিমাণে লজিস্টিক সাপোর্ট দিতে সমর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) অধীন আইডিয়া প্রকল্পের আওতায় ইতোমধ্যে দুই হাজার নারী উদ্যোক্তাকে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়েছে এবং ২০২৫ সাল নাগাদ আরও পাঁচ হাজার উদ্যোক্তাকে এই অনুদানের আওতায় আনা হবে। এমন অভাবনীয় সহযোগিতা কত লাখো পরিবারকে যে আর্থিক সচ্ছলতার দিকে নিয়ে যাবে সেটা কেবল সময়ই বলে দেবে।

আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে উল্লেখযোগ্য শক্তি হবে এই বিপুল সংখ্যক নারী উদ্যোক্তা। শুধু করোনা ও তার পরবর্তী সময়ে দেশে প্রায় দশ লাখ নারী উদ্যোক্তা বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছেন। এদের অনেকে হয়ত জানেনই না ব্যবসা কীভাবে করতে হয়। কিন্তু শুরু করেছেন প্রবল মনোবল নিয়ে যে তিনি পারবেন। একারণেই নারী উদ্যোক্তাদের সার্বিক সহযোগিতার জন্য সরকার একের পর এক দুর্দান্ত সব পরিকল্পনা গ্রহণ করছে, তারই একটি হলো ‘হার পাওয়ার’। ২৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘হার পাওয়ার’ নামে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এই প্রকল্পের আওতায় ২৫ হাজার নারী উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ এবং প্রত্যেককে এককালীন ২০ হাজার টাকা করে ব্যবসায়িক পুঁজি সরবরাহ করা হবে। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে লিঙ্গ সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণ ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য দেশব্যাপী একটি নারীবান্ধব বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সেইসঙ্গে উৎপাদন ও বিপণনে সাপ্লাই চেইন গড়ে তুলতে সরকারের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করছে জয়িতা ফাউন্ডেশন। এছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসায়িক প্রশিক্ষণ, তাদের পণ্য প্রদর্শনী ও বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন এসএমই ফাউন্ডেশন। গ্রামগঞ্জের একেবারে তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে অভাবনীয় সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। নানারকম প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীকে কর্মক্ষম করার যে প্রক্রিয়া সেটা সত্যিকার অর্থেই ভীষণ আশাপ্রদ।

সুতরাং নারীদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী করতে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপক একটা উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ কিন্তু চলমান। নারীদের শুধু ইচ্ছা থাকতে হবে সরকার প্রদত্ত সেই সুবিধাগুলো গ্রহণ করার। ইচ্ছা থাকতে হবে প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হওয়ার। ইচ্ছা থাকতে হবে প্রতিনিয়ত নিজেকে আপডেট করার।  সে চাকরি হোক কিংবা ব্যবসা; বেশিরভাগ নারীর ক্ষেত্রে প্রাথমিক সমস্যা হলো পরিবার ও সমাজ। সাংসারিক কাজের বাইরে উপার্জনশীল কাজ করার ক্ষেত্রে একেতো পরিবার গররাজি থাকে, তার ওপরে ব্যবসার পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসাতে যদি প্রয়োজন হয় বাড়তি অর্থ বিনিয়োগের কিংবা প্রয়োজন হয় ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের তাহলে তো হয়েই গেল। সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসাপাতি বাদ দিতে বলে দেবে পরিবার। খুব কম পরিবারই নারীকে ব্যবসার এই পর্যায়ে সহযোগিতা করে। জামানতসহ তো উপায়ই নাই কারণ আমাদের দেশের নারীর নামে প্রায় কোনো সম্পদ থাকেই না। এছাড়া জামানতসহ ঋণের ঝক্কিও পরিবার মেনে নিতে চায় না। সুতরাং ব্যবসা গ্রোথ লেভেলে নিয়ে যাওয়া কঠিনতর হয়ে যায়।

বাংলাদেশ সরকার নারী উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্প সুদে ঋণ সুবিধা দিয়েছে। আরও দিয়েছে প্রণোদনা প্যাকেজে নারীর অগ্রাধিকার। নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পেতে কোনো সম্পদ জামানত রাখার প্রয়োজনও পড়ে না। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার ও স্মার্ট সমাজ নির্মাণের এই ধাপগুলো কার্যক্ষেত্রে ভীষণরকম স্পষ্ট। আমরা নারী যারা উদ্যোক্তা হিসেবে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করছি তারা আসলে চাই আগামীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে নিতে। সেখানে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে সরকারের সঠিক নীতি নির্ধারণ যেমন প্রয়োজন তেমনই প্রয়োজন এমন আকণ্ঠ সহযোগিতার। নারীর পারিবারিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হলে এবং প্রতিটা ঘরে নারীরা উপার্জনক্ষম হলে তবেই দেশ স্মার্ট লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে।

লেখক: প্রেসিডেন্ট, হার ই-ট্রেড 

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর