Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দুর্গোৎসব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বড় নিদর্শন

তাপস হালদার
২২ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:১৩

দুর্গাপূজা বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন ধর্মীয় আচার পালন করলেও উৎসবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ সকল সম্প্রদায় অংশগ্রহণ করছেন। সবাই শারদীয় দুর্গোৎসবের অনাবিল আনন্দে মেতে উঠছেন। যা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বড় নিদর্শন। দুর্গাপূজা শুধুমাত্র বাংলাদেশ ও ভারতেই সীমাবদ্ধ নেই। পৃথিবীর যে যে প্রান্তে বাঙালিরা বসবাস করছেন, সেখানেই দুর্গাপূজা ছড়িয়ে পড়েছে। পরিনত হয়েছে বাঙালিদের মিলনোৎসবে।

বিজ্ঞাপন

হিন্দু ধর্মীয় রীতি অনুসারে মহালয়ার মধ্যদিয়ে দেবী দুর্গার আগমনের দিন গননা শুরু হয়। আশ্বিন মাসের ষষ্ঠী তিথিতে দেবী দুর্গার আগমনের অধিবাস শুরু হয়, দশমী তিথিতে বিজয়া দশমীর মধ্যদিয়ে দেবীর বিসর্জন হয়। পৌরাণিক যুগে শুরু হলেও কালের বিবর্তনে দেবী দুর্গা বাঙালির ঘরের একজন সাধারণ মেয়ে মতো হয়ে উঠেছে। তবে সাধারণ হলেও দেবী দুর্গা নারী শক্তির রূপ। একই অঙ্গে বহুরূপ। শরৎকালে আবাহন করেছেন বলে দেবীর একনাম শারদীয়া। এছাড়াও তিনি মহিষাসুরমর্দিনী, কাত্যায়নী, শিপানী, ভাবনী, আদ্যাশক্তি, চন্ডী, শতাক্ষী, ঊমা, গৌরী, সতী, রুদ্রাণী, কল্যাণী, অম্বিকা, অদ্রিজা সহ অনেক নামেই পূজিত হন। দেবী দুর্গা ১০৮ টি বিশেষণে ভূষিত হন। ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র অকালে ১০৮ টি নীলপদ্ম দিয়ে দেবীর পূজা করেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

একজন নারীকে যেমন একহাতে বহুকাজ করতে হয়। ঠিক তেমনি সন্তানদের রক্ষা করতে মহিষাসুর বধে মা দুর্গাকে দশ হাতে অস্ত্র ধরতে হয়েছিল। দেবী দুর্গা সন্তান কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে শ্বশুর বাড়ি কৈলাশ থেকে বাপের বাড়ি হিমালয়ে আসেন। ঘরের মেয়ে বাড়িতে আসলে যেভাবে আনন্দ দেখা দেয় তেমনি মা দুর্গা আসার পর সকল দুঃখ কষ্ট ভুলে বাঙালি ঘরে ঘরে আনন্দ উৎসব শুরু হয়। একটি ধর্মীয় উৎসব তখন সামাজিক উৎসবে পরিনত হয়।

দুর্গাপূজার প্রচলন সম্পর্কে ইতিহাসে বলা হয়েছে, রাজা সুরথ প্রথম দুর্গাপূজা শুরু করে। বসন্ত কালে পূজার করা হয়েছিল বলা এ পূজাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। কিন্তু শরৎকালে রামচন্দ্র রাবনের হাত থেকে সীতাকে উদ্ধারের জন্য যে পূজার আয়োজন করেছিল তাকে শারদীয় দুর্গাপূজা বলে রামচন্দ্র নিদ্রিত সময়ে দেবতাদের জাগ্রত করেছিলেন বলেই এই পূজাকে অকালবোধন বলা হয়। যা বর্তমানে শারদীয় দুর্গোৎসব। রাবণের বিনাশের জন্য রামের প্রতি অনুগ্রহবশত অকালে দেবী আবির্ভূত হয়েছিলেন। দুষ্ট শক্তি রাবণকে বিনাশ করে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দুর্গার দশটি হাত, এজন্য তাকে বলা হয় দশভুজা। তিনি দশ হাতের অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করে শত্রুদের দমন এবং সৎ, ধার্মিক ভালো মানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। ঈশ্বরের মাতৃরূপের নাম হচ্ছে-মা দুর্গা।

ব্রিটিশ আমলে পারিবারিক স্তরে দুর্গাপূজা কেবলমাত্র ধনী পরিবার গুলোই আয়োজন করতো। এসব দুর্গাপূজাকে ‘বনেদি বাড়ির পূজা’ নামে পরিচিত ছিল। এছাড়াও আঞ্চলিক স্তরে বাসিন্দারা যৌথভাবে যে দুর্গাপূজার আয়োজন করতো তাকে ‘বারোয়ারি পূজা’ বা সর্বজনীন পূজা বলা হতো। ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে সর্বজনীন পূজার প্রচলন শুরু হয়। মুলতঃ দেবী দুর্গার ধারণা মাথায় রেখেই দেশমাতৃকা অর্থাৎ ভারতমাতা জাতীয়তাবাদী ধারণা বিপ্লবের জন্ম দেয়। দেবী দুর্গার ধারণা থেকেই বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বন্দে মাতরম’ গানটি রচনা করেন। যা ভারত বর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র ছিল। মাতৃরূপে সংস্থিতা অর্থাৎ মা যেমন সন্তানের প্রতিপালন করেন তেমন জগতের প্রতিপালনে সৃষ্টিকর্তা মাতৃরূপে বিরাজ করেন। যিনি সকল প্রকার দুর্গতি থেকে রক্ষা করেন তিনিই দুর্গা। মাতৃপূজার উৎসব সার্থক করার জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘এসো হে আর্য, এসো অনার্য, হিন্দু মুসলমান-এসো আজ তুমি ইংরাজ, এসো এসো খ্রিস্টান। এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন ধরো হাত সবাকার—‘

অসুরদের রাজা মহিষাসুরকে বধ করে দেবী দুর্গা হলেন মহিষাসুর মর্দিনী। তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়া। সকল পাপ ও অন্যায় কাজের আধার অসুর শক্তিকে নিধন করে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। মা দুর্গা দুর্গতিনাশিনী অর্থাৎ সকল দুঃখ দুর্দশার বিনাশকারী। দেবী দুর্গাকে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির প্রতীক বলা হয়। মানব জীবনে অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটিয়ে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠা করাই দুর্গা পূজার মূল দর্শন।

দুর্গাপূজা সর্বজনীন রূপ থেকে বিশ্বজনীন রূপে পরিনত হয়েছে। দুর্গাপূজার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বকে বিবেচনা করে ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০২১ সালে কোলকাতার দুর্গাপূজাকে ইউনেস্কো ও বিশ্বের ইনট্যানজিবল হ্যারিটেজের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। দুর্গাপূজাকে ইউনেস্কো শুধুমাত্র পূজা হিসেবে দেখেনি। দুর্গাপূজাকে একদিকে ধর্মানুষ্ঠান ও অন্যদিকে শিল্পের একটি অনিন্দ্য সুন্দর রূপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তাদের ভাষায় দুর্গাপূজা হলো সর্বজনীন অনুষ্ঠানের একটি সর্বোত্তম উদাহরণ। বিশ্বে এরকম অনুষ্ঠান বিরল যেখানে শ্রেণী, ধর্ম ও জাতি ভেদাভেদ মুছে যায়। ধর্মীয় উৎসব যেখানে শ্রেণী, ধর্মের ভেদাভেদ ভুলে যেতে সহায়তা করে সে উৎসবের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব ভিন্ন ব্যঞ্জনার সৃষ্টি করে।

বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই দুর্গোৎসব সর্বজনীন হয়ে উঠে। ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর দুই বাংলাতেই ব্যাপক আকারে সর্বজনীন দুর্গাপূজার প্রচলন চলতে থাকে। এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাঝে মাঝে সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন বিষে দুর্গোৎসবে বিঘ্ন ঘটলেও পূজার আকার ও পরিধি বেড়েই চলছে। মানুষ যখন উৎসবকে ঘিরে সম্প্রীতির বন্ধনে মিলিত হয়, তখন ক্ষুদ্র একটি ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী মাঝেমধ্যে হিংসা ছড়িয়ে অশান্তির পরিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করে। বর্তমান দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ও দেশের শুভ চিন্তাসম্পন্ন মানুষ বারবার তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ, এরা সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেনা। বৃহৎ জনগোষ্ঠীই উৎসবে শামিল হয়। দুর্গোৎসব হয়ে উঠে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা ঘোষিত ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার। ‘এই চেতনার কারণে বাংলার ঐতিহ্যের সাথে গেছে শারদীয় দুর্গোৎসব। পূজার অংশটুকু হিন্দু ধর্মের আচার হলেও উৎসবে জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল শরিক হচ্ছে। সেখানে নাই কোনো ভেদাভেদ। দুর্গোৎসব সর্বজনীন উৎসবে পরিনত হয়েছে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এজেডএস

তাপস হালদার দুর্গোৎসব সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বড় নিদর্শন

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

শরৎ বাংলাদেশের কোমল স্নিগ্ধ এক ঋতু
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৪

সম্পর্কিত খবর