বিএনপির উচিত ভোটে যাওয়া
২ নভেম্বর ২০২৩ ১৬:৫৮
২৮ আগস্ট মহাসমাবেশ ডেকে সারা দেশ থেকে নেতা-কর্মীদের ঢাকায় এনে বিএনপির সরকার পতনের মহাযাত্রার ফল কি দলটির জন্য ভালো হলো? ঢাকার সমাবেশ থেকে অশান্তির চেষ্টা হলে পরিণতি হেফাজতের চেয়ে খারাপ হবে বলে যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, তখন বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, বিএনপিকে কোনোভাবেই হেফাজতের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। জিয়া-খালেদা-তারেকের দল দুর্বল নয়। দলটি যে দুর্বল নয়, সেটা কি ২৮ অক্টোবরে প্রমাণ করা গেছে?
এ নিয়ে আলোচনার আগে পাঠক এক বার স্মরণ করুন কী হয়েছিল ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরের সমাবেশকে ঘিরে। শাপলা চত্বর ও এর আশপাশ এলাকা সেদিন সকাল থেকেই দখলে রেখেছিল হেফাজতে ইসলাম। দিনভর হেফাজত নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্য সরাসরি একাধিক টিভি চ্যানেলে প্রচার করা হচ্ছিল। পুরানাপল্টনে সিপিবি অফিস আক্রান্ত হয়েছিল। গুলিস্তানে আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালানোর চেষ্টা হয়েছিল। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। সন্ধ্যায় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া দলের নেতা-কর্মীদের নির্দেশ দেন সর্বশক্তি দিয়ে হেফাজতে ইসলামের পাশে দাঁড়াতে। এইচ এম এরশাদও তার দলের নেতাদের একই নির্দেশ দেন। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে হেফাজতে ইসলামের ‘জনসমুদ্র’ উধাও হয়ে যায়। মতিঝিল ও এর আশপাশ এলাকায় পড়ে থাকে হাজার হাজার স্যান্ডেল, লাঠি-বাঁশ ও ইটের টুকরা। ক্ষমতা দখলের যে কল্পনার ফানুস তৈরি করেছিল হেফাজত, তা মুহূর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়!
হেফাজতের চেয়ে শক্তিশালী বলে দাবিদার বিএনপি ২৮ অক্টোবর কি করল? সারা দেশ থেকে নিয়ে আসা ‘মানুষের ঢল’ নয়াপল্টন ও এর আশপাশ এলাকায় তো কয়েক মিনিটও টিকতে পারল না। বলা হচ্ছে, পুলিশের সশস্ত্র আক্রমণের সামনে নিরস্ত্র মানুষ কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে?
সরকারের শক্তি ও তার প্রয়োগ ক্ষমতা সম্পর্কে বিএনপির হিসাবে ভুল ছিল। সরকারের চেয়ে নিজেদের শক্তি বড় করে দেখার কারণে বিএনপি হম্বিতম্বি বেশি করলেও বাস্তব চিত্রটা ভিন্ন। বিএনপি এখন সব দোষ সরকার ও পুলিশের দমননীতির ওপরে চাপাতে চাইলেপ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে এটা জানা যায় যে বিএনপির নেতাকর্মীরাই সেদিন সহিংসতা শুরু করেছিল। তারা প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা চালিয়েছে। পুলিশ হাসপাতাল তছনছ করেছে। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের ইনস্টিটিউটে ভাঙচুর করেছে। নৃশংসভাবে পিটিয়ে একজন দায়িত্ব পালনরত পুলিশকে হত্যা করেছে। সাংবাদিকরা যেন অপরাধের চিত্র ধরে রাখতে না পারে, এ জন্য তাদের মারধর করেছে।
বিএনপির নেতাকর্মীরা উশৃঙ্খল আচরণ শুরু করলে বাধ্য হয়েই পুলিশ অ্যাকশনে যায়। এটা পুলিশের স্বাভাবিক দায়িত্ব। তাছাড়া পুলিশ হত্যার খবর শুনেও পুলিশ শুধু হুইশেল বাজিয়ে দায়িত্ব পালন করবে – এটা আশা করা কি যুক্তিযুক্ত? ঢিল মারলে যে পাটকেল খেতে হয় – এটা কি বিএনপি নেতৃত্বের জানা ছিল না? নাকি হুমকি ধামকি দেওয়াটাই বিএনপি নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে? দেশের মানুষ নিশ্চয়ই ভুলে যায়নি যে গত বছরের অক্টোবরে বিএনপির কোনো কোনো নেতা বলেছিলেন, ১০ ডিসেম্বরের পর বাংলাদেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়। কিন্তু সেটা যে চলেনি, তাতো ঠিক। মানুষ যা চায় না, তা বিএনপি চাইলে সেটা কি পূরণ হয়? মানুষ চায় ভোট দিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে নির্বাচিত করতে। আর বিএনপি চায় আন্দোলন করে সরকার হটাতে। বিএনপির কৌশলে যে ভুল আছে, এটা তারা যতদিন বুঝতে না পারবে ততদিন শক্তিক্ষয় করবে কিন্তু লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে বলে মনে হয় না।
অন্যদিকে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঘটনাবলী এই প্রসঙ্গে মনে করা যেতে পারে। ২৮ অক্টোবর তারিখটি শেখ হাসিনার ‘লগি-বৈঠা’ আন্দোলনের জন্য আলোচনায় রয়েছে। সেদিন ছিল খালেদা জিয়া সরকারের মেয়াদের শেষ দিন। দিনটি যেন বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর জোট সরকারের জন্য কণ্টকপূর্ণ হয়ে থাকে, এ জন্য আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ‘মহাজোট’ ঢাকার রাজপথ দখলের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। অন্যদিকে খালেদা জিয়া চেয়েছিলেন নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে যেন সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি কেএম হাসান দায়িত্ব পালন করেন, যিনি সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনে থাকাকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ছিলেন। ওই সময় রাষ্ট্রপতি পদে ছিলেন অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ, যিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পদে দায়িত্ব পালন করেছেন বহু বছর। সেই ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে। অষ্টম জাতীয় সংসদে এ দলের আসন ছিল ৬০টিরও কম। কিন্তু শেখ হাসিনা রাজপথে জয়ী হয়েছিলেন। বিচারপতি কেএম হাসানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া হয়নি। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর পদে ইস্তফা দেন। তখন থেকে ১৭ বছর তিনি ক্ষমতার বাইরে।
এর আগে ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসেও শেখ হাসিনা রাজপথে জয়ী হয়েছিলেন। ওই সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী বা সংসদে বিরোধী দলের নেতার পদে ছিলেন না, এমনকি সংসদ সদস্য পদেও ছিলেন না। অথচ তার ডাকে সচিব থেকে পিয়ন-দারোয়ানসহ সচিবালয়ের শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী রাজপথে নেমে তোপখানা রোডের সমাবেশে একযোগে দাবি তোলেন খালেদা জিয়াকে পদত্যাগ করতে হবে, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল বাতিল করতে হবে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের কাজও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার ডাকে। এ নির্বাচনে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগসহ অনেক দল অংশ নেয়নি। কিন্তু রাজপথের নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতে। তিনি খালেদা জিয়াকে সংবিধান সংশোধন করাতে বাধ্য করেছিলেন।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের মানুষ অসহযোগ আন্দোলনে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর নৈতিক শক্তি ও আইনি ভিত্তি ছিল- তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। জনগণ তাঁকে স্বাধীনতা ঘোষণার ম্যান্ডেট দিয়েছিল। তিনি সেটি প্রয়োগ করেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। জনগণ তার ডাকে সাড়া দেয়। কিন্তু এর ২৫ বছর পর শেখ হাসিনা যখন এমনকি জাতীয় সংসদ সদস্যও নন তখন তার ডাকে কেন জনগণ, প্রশাসনসহ অসংখ্য মানুষ সাড়া দিল? বিষয়টি বিএনপি কি কখনো ভেবে দেখেছে? এ নিয়ে দেশের নতুন গজিয়ে ওঠা চিন্তক-বিশ্লেষকদেরও খুব কথা বলতে দেখা যায় না।
বিএনপি ও তার দরদিরা স্বীকার করতে না চাইলেও এটাই সত্য যে বিএনপি গায়ের জোরে পাহাড় ঠেলতে গিয়ে দফায় দফায় হোঁচট খেয়েও সম্বিৎ ফিরে পায় না। আত্ম সমীক্ষা ও ভুলত্রুটি থেকে শিক্ষা নেওয়ার ধারা থেকে দূর থাকা যে বিএনপির একটি বড় দুর্বলতা, এটা দলের নেতৃত্ব বুঝতে নারাজ।
সরকার খুব স্বাভাবিকভাবেই ২৮ অক্টোবরের ঘটনার পর বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কঠোর মনোভাব গ্রহণে বিএনপির পক্ষ থেকেই প্ররোচিত করা হয়েছে। রাজনীতির পাশা খেলায় ভুল চাল দিয়ে বিএনপি আবারও রাজপথে দিশেহারা অবস্থানে গেল বলে মনে করা হচ্ছে। ২৮ অক্টোবর সহিংসতার পর রাজপথের দখল নিজেদের হাতে রাখার কথা বললেও বিএনপি যে এখানে ব্যর্থ হয়েছে তা এখন পরিষ্কার।
সন্ত্রাসী আন্দোলনের খেসারত দিতে হবে দলটিকে। ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ ও পরের দিনের হরতালে ঝরল রক্ত, ঝরে গেল তাজা পাঁচটি প্রাণ। আগুনে পুড়ে কয়লা হয়ে গেল গাড়ির ভেতর ঘুমন্ত বাসচালক। ফের আগুনসন্ত্রাসের রাজনীতিতে আতঙ্কিত জনগণ। এই অবস্থায় জনগণের নিরাপত্তায় জিরো টলারেন্সে সরকারে, কঠোর অবস্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজপথে পাহারায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশে হামলা, নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, বাসাবাড়িতে তল্লাশি ও হয়রানির প্রতিবাদসহ সরকার পতনের এক দফা দাবিতে ঢাকাসহ সারাদেশে মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার তিন দিনের সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি দিয়েও কি বিএনপি খুব লাভ হলো? জামায়াতসহ সরকার বিরোধী প্রায় অর্ধশত দলের এই আন্দোলনে সরকার এতটুকু বিচলিত বলে মনে হচ্ছে কি?
তিন দিনের অবরোধ কর্মসূচি একদিকে যেমন শান্তিপূর্ণ উপায়ে পালন করা যায়নি অন্য দিকে তেমনি ঢাকাকেও সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়নি। উল্টো দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসসহ অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। অন্য শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার আতঙ্কে আত্মগোপনে গেছেন। এই অবস্থায় আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার সাংগঠনিক সক্ষমতা বিএনপির কতটুকু আছে সেটাও দেখার বিষয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, গত কয়েক দিনের ঘটনায় বিএনপির নেতৃত্বের দুর্বলতা পরিস্ফুট হয়েছে। এছাড়া দলটির মধ্যে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা নেই বললেই চলে। সব মিলিয়ে আবারো ব্যাকফুটে চলে গেছে বিএনপি। মাঠ পুরোটাই ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণে। এই অবস্থায় জোর করে আন্দোলন টেনে নেওয়ার চেষ্টা কোনো ভালো ফল দেবে না। আন্দোলন করার ক্ষমতা বিএনপির নেই- এই সত্য মেনে নিয়ে এখন তাদের উচিত হবে জনগণের দ্বারস্থ হওয়া, নেতাকর্মীদের ভোটে উজ্জীবিত করা এবং নির্বাচনে অংশ নেয়া। সংঘাত আরও না বাড়িয়ে নির্বাচনের ধারায় ফিরে আসার সুবুদ্ধি দেখাতে বিএনপি নেতৃত্ব ব্যর্থ হলে দলটি এবার সত্যি অস্তিত্বের সংকটে পড়তে পারে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
সারাবাংলা/এসবিডিই