Tuesday 15 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জীবনমান কমে, তরতর বাড়ে কেবল দ্রব্যমূল্য


১৮ মে ২০১৮ ১৩:৪৫ | আপডেট: ১৮ মে ২০১৮ ১৪:০৫
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

।। সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।।

প্রতিবছর রোজা এলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ে। এমনভাবে বাড়ে যা নিয়ে একটা হৈ চৈ শুরু হয়। মানুষ আক্ষেপ করে বলে, বিদেশে উৎসবে জিনিসের দাম কমে, আমাদের এখানে শুধু বাড়ে। বিদেশ কমে, কারণ বিষয়টি সততার। আমরা মুখে পবিত্র রমজান বলি ঠিকই, আচরণে পবিত্র মাসের শুদ্ধতা রাখার চেষ্টা থাকে না।

এক সৃষ্টিছাড়া অর্থনীতির চিত্র রমজান মাস। মানুষ দু’হাতে বাজে খরচ করতে থাকে এ মাসে। আর আমাদের ব্যবসায়ীরা চার হাত-পায়ে মানুষের পকেট কাটতে থাকে। এ দেশে যা কিছু মাপা যায় সবই নিম্নগামী, কেবল মূল্যবদ্ধি ছাড়া। রাজনীতির আলাপ-আলোচনার বাইরে সাধারণ মানুষ যা বুঝছে তা হলো— তাকে স্বস্তি দিতে পারে এমন যা কিছু আছে, তা সবই নিম্নমুখী। যথা— টাকার মূল্য, শেয়ারবাজারের সূচক, ভোগ্যপণ্যের বাজার। একটা জিনিস কেবল তরতর করে বেড়ে চলেছে; আর তা হলো দ্রব্যমূল্য।

বিজ্ঞাপন

আর্থিক ঘাটতি মেটাতে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, যার পরিণামে সাধারণ মানুষের জন্য সুদের হার বাড়ে। অর্থাৎ কমে যায় নতুন ব্যবসা বা চাকরির সম্ভাবনা। টাকার মূল্য নেমে যাওয়াও সরকারের বিলীয়মান বিশ্বাসযোগ্যতার উদাহরণ। জিনিসের দাম বাড়ে, মানুষের আয় কমে। বাড়ে কেবল সরকারি কর্মীদের বেতন-ভাতা আর স্ফীত হয় দুর্নীতিবাজের পকেট। ফলে গড়ে গিয়ে জাতির মাথাপিছু আয় বাড়ে ঠিকই, কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ পকেটে হাত দিয়ে দেখে, তা ফাঁকা।

গত কয়েক বছরে বেড়েছে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম, পরিবহন ব্যয়, বাসা ভাড়া। এর মধ্যে অর্থমন্ত্রী হুমকি দিয়েছেন, বিদ্যুতোর দাম আবার বাড়বে। আর ঠিক এ কারণেই গড়ে মাথাপিছু আয়ের যত বাড়-বাড়ন্তই দেখানো হোক না কেন, সীমিত ও নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে, প্রকৃত আয় কমে গেছে।

রমজান মাসে বাংলাদেশে মুড়ি, পেঁয়াজ, ছোলা ও বেগুনের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। সংযমের মাসে চাহিদা বাড়ে মাছ, মাংস, দুধ, মিষ্টি, সবজিরও। কিন্তু এ চাহিদা বৃদ্ধি যেহেতু নির্দিষ্ট সময়ের এবং আগে থেকেই জানা, সেজন্য এর জোগানও বেড়ে যায়। তবুও কেন বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকে না, সেটাই ভাবনা।

রমজান মাসের মতো বিশেষ সময়ের বা উপলক্ষের সময়ে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি তাই অর্থনীতির চাহিদা-জোগান দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। এখানে বিশেষ ভূমিকা পালন করে ভোক্তাদের জিনিসপত্র ক্রয়ের ব্যাপারে চাহিদার অনমনীয়তা। অর্থাৎ দাম বাড়লেও চাহিদা এখানে কমে না। এবং এ অনমনীয়তা বা বাধ্যবাধকতার সুযোগটিই গ্রহণ করতে চেষ্টা করেন ব্যবসায়ীরা। বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়াচ্ছে।

আয় ও জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় কৃষক, শ্রমিক, বেসরকারি খাতের পেশাজীবীসহ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিপদে আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আয়ের এই অবস্থা, তবুও চাহিদা কেন বাড়ছে— সে এক প্রশ্ন। প্রশ্ন উঠতেই পারে, মানুষের সমস্যা হচ্ছে, কিন্তু বাজারে তো কেনাকাটা বেড়েই চলেছে।

একটি শ্রেণির কাছে প্রচুর অর্থ কুক্ষিগত হয়েছে। তাদের চাহিদা ব্যাপক এবং তা পূরণের চেষ্টা আছে। সেই প্রতিযোগিতা তো আছেই। আরেকটা বিষয় হলো— আমরা মূলত এই চাহিদা-জোগান পরিস্থিতিকে দেখছি রাজধানী ও বড় শহরের প্রেক্ষাপট থেকে। প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষের অবস্থা খুব কমই বিবেচনায় আসছে। নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ আয়ের বাইরে আয়ের বিভিন্ন পথ অনুসন্ধান করছে। এর বাইরে আছে নানা ধরণের আর্থিক খাতের প্রণোদনা। ক্রেডিট কার্ডের নামে ঋণ করে ঘি খাওয়ার একটা সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে শহুরে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত। ফলে অনেক কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

দেশে দীর্ঘদিন ধরে চালের বাজার অস্থির। দাম বাড়ার প্রবণতায় রেশ টানা হলেও তা এখনো অনেক বেশি। দাম বাড়া দেখতে দেখতে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা দেখতে দেখতে এখন মানুষের তা সয়ে গেছে অনেকটা। ফলে খুব একটা আওয়াজ নেই গণমাধ্যমেও।

সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) কাজে লাগাতে সচেষ্ট সরকার। কিন্তু এর ভেতরেই রয়েছে দুর্বলতা। টিসিবি ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে। হাতেগোনা কিছু পণ্য মাঝেমধ্যে তারা খোলাবাজারে বিক্রি করে, যা বিদ্যমান বিশাল বাজারব্যবস্থায় কোনো প্রভাবই ফেলতে পারে না।

বাড়ছে বাসাভাড়া, পরিবহন-ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতের ব্যয়। সরকারি-বেসরকারি সেবার দামও বাড়ছে। সেই অনুপাতে বাড়ছে না মানুষের আয়। এর ফলে জীবনযাত্রার মানে প্রভাব পড়েছে। বাজার অস্থিতিশীল হওয়া মানেই দেশের বেশিরভাগ মানুষের ওপর চাপ পড়া। তাই দাম কমানোর দর্শনই একমাত্র উপায় নয়, উপায় খুঁজতে হবে কী করে মানুষের আয় বাড়ানো যায়। কালোবাজারি, মুনাফাখোর, মজুতদারদের নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মানুষের কর্মসংস্থান বড় ভূমিকা রাখবে স্থিতিশীলতায়।

অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ‘জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান ও বিভিন্ন ধরনের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রতি একটি দেশ তার সরকার এবং শেষ বিচারে তার রাজনৈতিক ব্যবস্থা কতটা মনোযোগী, এই বিষয়গুলোকে কতটা অগ্রাধিকার দেওয়া হয়— সরকারি ব্যয়বরাদ্দের বিন্যাস থেকে তার একটা সংকেত পাওয়া যায়।’

দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে জীবনযাত্রার সম্পর্ক নিবিড়। প্রয়োজনীয় প্রতিটি পণ্যের মূল্য যখন সহনীয় পর্যায়ে এবং সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে, তখন জীবন কাটে একরকম। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য যখন আর্থিক সঙ্গতির বাইরে চলে যায়, তখন পুরো সমাজেই অস্থিরতা দেখা দেয়। সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার সম্পর্ক রয়েছে। সেটা বোঝাই খুব প্রয়োজনীয়। দৃশ্য ও অদৃশ্যমান সব সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে সাধারণ ও নিম্ন আয়ের মানুষের ভালোভাবে বেঁচে থাকার নিরাপত্তার কথা ভাবনা আসুক নীতিনির্ধারণী স্তরে। আমরা বলছি, আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, কিন্তু আমরা এই আয়ের বৃদ্ধিকে ব্যাপক সামাজিক উন্নয়নের কাজে লাগাতে পারিনি বলেই মৌসুমভিত্তিক নিয়ন্ত্রহীণ দাম বাড়ার মতো এরকম সৃষ্টিছাড়া পরিস্থিতি দেখতে হয়।

লেখক: এডিটর-ইন-চিফ; সারাবাংলা ডটনেট, দৈনিক সারাবাংলা ও গাজী টিভি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর