মাতারবাড়ি হবে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী
১০ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৩৯
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও বন্দর চ্যানেলের উদ্বোধন করবেন আগামীকাল (১১ নভেম্বর)। বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়িতে ১ হাজার ৩১ একর জমিতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। জাপানের উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার(জাইকা) সহযোগিতায় বন্দরটি গড়ে তোলা হবে। মোট ব্যয় ৮ হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা। জাইকা ঋণ দিবে ৬ হাজার ৭৪২ কোটি টাকা। বাকি টাকা ব্যয় করবে বাংলাদেশ সরকার। বন্দরটি চালু হলে দক্ষিণ অঞ্চলই নয়, বদলে যাবে বাংলাদেশ। কারণ এটি হবে দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানী।
দেশ যত উন্নত হচ্ছে বৈদেশিক ব্যবসা বানিজ্য ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এজন্যই প্রতিবছর দেশে জাহাজ আগমন বৃদ্ধির হার প্রায় ১১ শতাংশের বেশি বাড়ছে। এভাবে বাড়লে ২০৪১ সালে কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমান গিয়ে দাঁড়াবে ১৪ মিলিয়ন টিইইউএস এবং জাহাজের সংখ্যা হবে ৮ হাজার দুইশটি। এত বিপুল সংখ্যক কন্টেইনার ও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা বিদ্যমান বন্দরগুলোর দ্বারা কোনো মতেই সম্ভব নয়। এছাড়া দেশে সমুদ্র বন্দরগুলো একটিও গভীর সমুদ্রবন্দর নয়। এজন্য বড় জাহাজ বন্দরে ভিড়তে পারেনা। অধিক গভীরতার জাহাজের জেটি সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছে সরকার।
২০০৯ সালে প্রথমে কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল, পরবর্তীতে পটুয়াখালীর পায়রার কথাও ভাবা হয়েছিল। কিন্তু ভূ-রাজনৈতিক কারণে সেটি বারবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও সম্ভব হয়নি। জাপানি গবেষণায় উঠে আসে এ অঞ্চলটি জ্বালানি শক্তির হাব হতে পারে, এজন্য তারা বিনিয়োগে উদ্যোগী হয়। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান সফরে গেলে সেখানকার প্রধানমন্ত্রী মহেশখালীতে জ্বালানি উৎপাদনে আগ্রহ প্রকাশ করে বিনিয়োগের প্রস্তাব দেন। এবং মাতারবাড়ি কয়লা ভিত্তিক ১২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বিনিয়োগ করে। কিন্তু কয়লাবাহী বড় আকারের জাহাজ ভিড়তে প্রয়োজন হয় চ্যানেল বা জেটি। যার জন্য ১৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য, ২৫০ মিটার প্রস্থ ও ১৮ দশমিক ৫ মিটার গভীর চ্যানেল নির্মাণ করা হয়। জাইকার গবেষণায় উঠে আসে এই চ্যানেল ব্যবহার করে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সম্ভব। সেই থেকে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। যা কাল থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করবে, ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে পূর্ণতা লাভ করবে।
জাপানের কাশিমা বন্দরের মডেলেই মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা হবে। তবে এটি কাশিমা বন্দরের চেয়ে আড়াই গুণ বড় করে তৈরি করা হচ্ছে। এটি সমুদ্রের সাথে নয়, চ্যানেল তৈরির মাধ্যমে বন্দরকে সমুদ্রের সাথে সংযুক্ত করা হবে। চ্যানেলে যাতে পলি জমতে না পারে, সেজন্য ব্রেকওয়াটার বাঁধ নির্মাণ করে পানির প্রবাহ রোধ করা হবে। এটি হবে বাংলাদেশের প্রথম খননকৃত বন্দর।
বঙ্গোপসাগর মালাক্কা প্রণালী হয়ে দক্ষিণ চীন সাগরের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। চীন ও জাপানের কাছে বঙ্গোপসাগরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। জাপান ‘বিগ বি’ (বে অব বেঙ্গল গ্রোথ -বেল্ট) নিয়ে যে বিশাল অর্থনৈতিক পরিকাঠামো চিহ্নিত করেছে তা বঙ্গোপসাগরকে আবর্তিত করেই গড়ে উঠবে। এজন্যই মহেশখালির মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
গভীর সমুদ্রবন্দরটি উদ্বোধনের পর সাড়ে ১৮ মিটারের গভীর চ্যানেলে ফিডার ভেসেল নোঙর করতে পারবে। এতে পণ্য পরিবহনে সময় ও অর্থ সাশ্রয় হবে। গভীর বন্দরটি পুরোপুরি চালু হলে আট হাজার দুইশো টিইইউএস ক্ষমতাসম্পন্ন কন্টেইনার বহনকারী জাহাজ নোঙর করতে পারবে। তখন পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে সিঙ্গাপুর, কলম্বো ও মালয়েশিয়া বন্দরে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের পণ্য নিয়ে বসে থাকতে হবে না। বর্তমানে আমেরিকা কিংবা ইউরোপে পণ্য পাঠাতে বড় জাহাজের জন্য বিদেশি বন্দরে অপেক্ষা করতে হয়। এখন আমেরিকায় পণ্য পৌঁছাতে সময় লাগে কমপক্ষে ৪৫ দিন। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে বন্দরটি পুরোপুরি চালু মাত্র ২৩ দিনেই পণ্য আমেরিকা পৌঁছে যাবে। কোনো প্রকার ট্রানজিট ছাড়া পণ্য আমদানি-রপ্তানি করা যাবে। যাতে করে প্রায় ৩০ শতাংশ পরিবহন ব্যয় কমে যাবে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের সমুদ্র পথে দূর ৩৪ নটিক্যাল মাইল। জাহাজে সময় লাগবে ২-৩ ঘন্টা। সড়কপথের দূরত্ব ১১২ কিলোমিটার। এখানেও সময় লাগবে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা। পায়রা বন্দর ১৯০ নটিক্যাল মাইল ও মংলা বন্দর ২৪০ নটিক্যাল মাইল। তাই মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে পণ্য খালাস করে স্বল্প সময়ের মধ্যে সড়ক কিংবা সমুদ্র পথে অন্যান্য বন্দরে পরিবহন করা যাবে। চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে মাত্র ৯ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফট বিশিষ্ট জাহাজ ল্যান্ড করতে পারে। যা ৮শ থেকে সর্বোচ্চ ২৪শ টিইইউএস কন্টেইনার বহন করতে পারে। যেখানে মাতারবাড়ির ধারণ ক্ষমতা হবে ১০ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার। যা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ৮ হাজার টিইইউএস কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতা বেশি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও জাপান সরকার বিগ-বি এর উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর প্রধান কেন্দ্র হিসেবে মাতারবাড়িকে বেছে নেয়া হয়। এজন্যই বাণিজ্যিক বন্দর তৈরি করার জন্য কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র, এলএমজি টার্মিনাল, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে।এখানে প্রচুর পরিমানে বৈদেশিক বিনিয়োগ হবে। ভূ-অবস্থানগত কারণে এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্যিক রাজধানীতে পরিনত হবে।
মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্রকে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।বিপুল লোকের কর্মসংস্থান হবে। আমদানি-রপ্তানি বৃদ্ধিতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি পাবে। দেশের ব্লু ইকোনমি তথা তেল, গ্যাস অন্যান্য সমুদ্র সম্পদ আহরণ ও ব্যবহারের সুযোগ বৃদ্ধি পাবে। যা দেশের অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার পথে মাইলফলক হবে।
দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর টার্মিনালের পুরোদমে চালু হলে সামগ্রিক অর্থনীতির চিত্রই বদলে যাবে। ভারত, নেপাল, ভুটান, মায়ানমার, চীন এই বন্দর ব্যবহার করতে পারবে। যা থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করবে বাংলাদেশ। জাতীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে বন্দরটি ২ থেকে ৩ শতাংশ অবদান রাখবে।
বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের একটি গভীর সমুদ্রবন্দরের নির্মাণের স্বপ্ন ছিল। দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতে বাস্তবায়িত হচ্ছে। এটি বর্তমান সরকারের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার আরেকটি অনন্য মাইলফলক।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এজেডএস