বাংলাদেশের রেলযোগাযোগে সোনালী বিপ্লব
১৫ নভেম্বর ২০২৩ ১৩:২০
কুষ্টিয়ার জগতি থেকে কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশন- বাংলাদেশের রেল যোগাযোগের ১৬১ বছরের ইতিহাস। ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে ১৮৫৪ সালে হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত রেললাইন চালু করে। এরপর ১৮৬২ সালে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে কলকাতা থেকে রানাঘাট পর্যন্ত রেলপথ তৈরি করে। এই লাইনকেই বাড়িয়ে ঐ বছরের ১৫ নভেম্বর কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেললাইন শাখা উন্মোচিত করা হয়। প্রতিষ্ঠিত হয় পূর্ববঙ্গের প্রথম রেল স্টেশন জগতি। ১৯৬২ সালের ১৫ নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের রানাঘাট থেকে জগতি পর্যন্ত শুরু হল রেল চলাচল। এ অঞ্চল প্রবেশ করে রেল যোগাযোগ যুগে। ধীরে ধীরে এই বঙ্গে বিস্তৃতি ঘটে রেল নেটওয়ার্কের। ২০২০ সাল থেকে ১৫ নভেম্বরকে ‘রেলদিবস’ হিসেবে উদযাপন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় হার্ডিঞ্জ ব্রিজসহ ছোট-বড় শতাধিক রেলসেতু ধ্বংস করে বাংলাদেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয় হানাদার পাকিস্তানীরা। স্বাধীনতার পরে ক্ষতিগ্রস্থ রেলযোগাযোগ ব্যবস্থা পুর্নগঠনের উদ্যোগ গ্রহন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধু নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হলে থমকে যায় বাংলাদেশের অন্য সব ক্ষেত্রের মতো রেলের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও। পরবর্তী সরকারগুলো দেশি-বিদেশী গোষ্ঠীর স্বার্থে রেলকে অবহেলা করে সড়ক যোগাযোগের দিকে নজর দেয়। বন্ধ করে দেয়া হয় নতুন রেলপথ নির্মাণ ও রেলওয়েতে বিনিয়োগ।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সামরিক স্বৈরশাষক জিয়া- এরশাদের শাষনামলে নতুন কোন রেলপথ নির্মাণ করা হয়নি। লোকসান দেখিয়ে একের পর এক বন্ধ করে দেয়া হয় অনেকগুলো রেলপথ। ১৯৯১ সালে বিএনপি-জামাত সরকার ক্ষমতায় এলে খালেদা জিয়া সরকার ‘গোল্ডেন হ্যান্ডশেক’-এর নামে ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারিকে ছাঁটাই করে। এতে পঙ্গু হয়ে যায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর অভাবে বন্ধ হতে থাকে একের পর এক রেলস্টেশন।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে ডুবতে বসা রেলওয়েকে উদ্ধারে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। নির্মাণকাজ চলমান থাকা যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতুতে সড়ক পথের সঙ্গে যুক্ত করেন রেলপথও। আওয়ামীলীগ সরকার নতুন রেলপথ নির্মাণ ও পুরনো রেলপথ সংস্কারের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশ রেলওয়ে বেঁচে যায় বিলুপ্তির হাত থেকে।
বিশ্ব ইতিহাসে যোগাযোগ ব্যবস্থার ধারণা পাল্টে দিয়েছিল রেলের আবিস্কার। বিশ্বজুড়েই রেল সামাজিক বিবর্তন এবং অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে। যে অঞ্চলের ওপর দিয়ে রেলপথ যায় সেখানে অর্থনীতি বেগবান হয়, জীবন ব্যবস্থায় খুলে যায় সমৃদ্ধির দুয়ার। বিশ্বের প্রায় সব উন্নত দেশেই রেলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা।
অর্থ-সময়-জ্বালানী সাশ্রয়ী এবং পরিবেশ বান্ধব ও নিরাপদ যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে বিশ্বজুড়েই রেল একটি জনপ্রিয় পরিবহন। আমাদের দেশের বিপুল জনসংখ্যা, সীমিত সম্পদ, নিম্ন আয় ও কৃষি নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থায় রেলপথের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু অন্য সরকারগুলো সব সময় এই রেলকে অবহেলা করেছে। এমনকি রেলকে বেসরকারীকরণের সব প্রক্রিয়াও চলছিল।
কিন্তু ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্ব দেন। তিনি প্রথমেই গঠন করেন রেলপথ মন্ত্রনালয়। আগে রেল ছিল যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। যোগাযোগ খাতের বরাদ্ধের ৯০ শতাংশ পেত সড়ক বিভাগ। মাত্র ১০ শতাংশ পেত রেল বিভাগ। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন ভাতাদি দেয়ার পর নতুন কোন প্রকল্প নেয়ার মতো টাকা থাকতো না। ২০১১ সালের ৪ ডিসেম্বর রেলপথ মন্ত্রণালয় গঠনের পর বদলে গেছে সে চিত্র। ২০০৯ সালে রেলের জন্য বাজেট ছিল ৫০০ কোটি টাকা। এখন রেলের উন্নয়ন বাজেটের অংক ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি।
এরপর দুরদর্শী প্রধানমন্ত্রী ঠিক করেন ‘ড্রিম ভিশন’ – দেশের প্রতিটি জেলায় যাবে রেল। এজন্য ২০১৩ সালে ২০ বছর মেয়াদী একটি মহা পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। ২০১৮ সালে সেটি হালনাগাদ করা হয়েছে। এ মহা পরিকল্পনায় ৫ বছর মেয়াদী ৪টি পর্যায়ে ২৩০টি প্রকল্প ২০৩০ সাল নাগাদ বাস্তবায়নের কথা রয়েছে। এতে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা ব্যয় হবে। সেই মহা পরিকল্পনা অনুযায়ী নেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প। ফলে দ্রুত রেল গেছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে। যাবে তিন পাহাড়ি শহরে। নদীর জাল ডিঙ্গিয়ে যাবে বরিশালে। যাবে হাওর কন্যা সুনামগঞ্জেও। এরই মধ্যে ৬৪ জেলার ৪৮টিতেই পৌছে গেছে রেল। সম্প্রতি যে প্রকল্পগুলো উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী, তাতেই রেল যোগাযোগে এক সোনালী বিপ্লবের সূচনা হয়েছে।
পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প
কেউ কি ধারণা করেছিল দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ রাজধানীর সঙ্গে রেল যোগাযোগের মাধ্যমে সরাসরি যুক্ত হবে? অকল্পনীয় সে স্বপ্ন এখন বাস্তব। এটি সম্ভব হয়েছে দুরদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অদম্য ইচ্ছাশক্তি, অসীম সাহস এবং মানুষের কল্যাণের জন্য অনড় কমিটমেন্টের কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণের সুবাদে। অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং প্রকৌশল কর্মযজ্ঞ রয়েছে ঢাকা-যশোর ১৭২ কিলোমিটারের এই রেলপথ নির্মাণে। অসংখ্য ছোট-বড় নদী এবং পানির সুষ্ঠু প্রবাহ ও জলবায়ুর প্রভাব বিবেচনায় রেখে বড় বড় সেতু, অসংখ্য ছোট ছোট সেতু, কালভার্ট, আন্ডারপাস, ওভারপাস তৈরি করতে হয়েছে। এখন ঢাকা-ভাঙ্গা পথে চলছে রেল। ২০২৪ সালের মধ্যে যশোর পর্যন্ত পুরো পথ তৈরি হয়ে গেলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষ রেল যোগাযোগের সুবিধা ভোগ করবেন। আরেক বন্দরনগরী খুলনার সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব কমবে ২১৫ কিলোমিটার। এটি একটি ম্যাজিকের মতো ব্যাপার হবে। এখন ঢাকা থেকে খুলনা যেতে ৪০০ কিলোমিটার পাড়ি দিতে হয়। সময় লাগে ১০-১২ ঘন্টা। নতুন রেল পথে ৩ ঘন্টায় যশোর এবং ৪ ঘন্টায় খুলনা যাওয়া যাবে। এই রেলপথ যুক্ত করবে চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা ও মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরকে। (ঢাকা-যশোর রেললাইনের একটি ব্রাঞ্চ লাইন যাবে কুয়াকাটা–পায়রা বন্দর পর্যন্ত। সেটি নির্মাণের প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে)। দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনাপোলের সঙ্গেও নিরবিচ্ছিন্ন পণ্য পরিবহনের সুযোগ তৈরি করবে।
ঢাকা-যশোহর রেলপথ শুধু দেশীয় সংযোগেই বিপ্লব ঘটাচ্ছে না। এই নতুন রেলপথ আন্তদেশীয় রেলরুট হিসেবেও ব্যবহৃত হবে। ট্রান্স এশিয়ান করিডোরে যুক্ত হওয়ায় ভবিষ্যতে আন্তদেশীয় পণ্য পরিবহনেও সক্ষমতা বাড়বে।
এই রেলপথকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হচ্ছে ১৮টি অর্থনৈতিক অঞ্চল। এসব অঞ্চলে কর্মসংস্থান হবে প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ মানুষের। বিপুল বিনিয়োগ, নতুন নতুন কলকারখানা আর উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ বদলে যাবে ২১ জেলার ৩ কোটি মানুষের জীবন মান। জিডিপিতে যুক্ত হবে প্রায় ১ শতাংশ।
দোহাজারি-কক্সবাজার রেলপথ
সমুদ্রকন্যা কক্সবাজারে রেল আসবে— স্থানীয় মানুষ সে গল্প শুনেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। অবশেষে ৫ নভেম্বর ট্রায়াল ট্রেন যখন প্রথমবারের মতো দোহাজারী স্টেশন পেরিয়ে কক্সবাজারের দিকে গেল তখন স্থানীয় মানুষ দেখলো সত্যি রেল এসেছে তাদের কাছে।
১১ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজারের আইকনিক রেলস্টেশন থেকে ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল গেজ এই রেলপথের উদ্বোধন করেন এবং উদ্বোধনী ট্রেনে চড়ে যান রামু পর্যন্ত। এই শুভ যাত্রার মধ্য দিয়ে একটি স্বপ্ন সত্যি হতে দেখলো স্হানীয় মানুষ। দেখলো কথা দিয়ে কথা রেখেছেন মুজিবের মেয়ে।
কক্সবাজারকে ট্রেন নেটওয়ার্কে যুক্ত করার ভাবনা ছিল ব্রিটিশদের, ১৮৯০ সালে। ১৩৩ বছর পর সেই ভাবনার বাস্তবায়ন হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের হাত ধরে। রেলপথ দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে পৌঁছেছে অনেক আগেই। এখন সর্ব দক্ষিণের কক্সবাজারও যুক্ত হলো রেল নেটওয়ার্কে। সরকার দেশের সব জেলাতেই পৌঁছাতে চায় রেল। নতুন এই পথের মাধ্যমে দেশের ৪৮টি জেলায় পৌঁছে গেল রেল।
নতুন এই রেলপথে ট্রেনযাত্রা অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। কেননা, বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘ সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছরই বিপুলসংখ্যক পর্যটক কক্সবাজারে আসেন। তাদের বেশির ভাগই যাতায়াত করেন বাসে। তাদের জন্য এখন আরামদায়ক, নিরাপদ, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব যাত্রা হবে এই রেলপথে। ঢাকা থেকে সড়কপথে কক্সবাজার যেতে ১০-১২ ঘণ্টা সময় লেগে যায়। রেলপথে সময় লাগবে শুরুতে ৮ ঘণ্টার কিছু বেশি। পর্যায়ক্রমে তা ৬ থেকে সাড়ে ৬ ঘণ্টায় নামিয়ে আনতে চায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
এই রেলপথের প্রধান আকর্ষণ হবে কক্সবাজার আইকনিক রেলস্টেশন। ‘ঝিনুক’ আকৃতির এই আইকনিক স্টেশনটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হবে। ২৯ একর জায়গার উপর ২২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে দেশের সবচেয়ে সুন্দর রেলস্টেশনটি। এতে ফুটে উঠেছে কক্সবাজারের ঐতিহ্য।
এ রেলপথকে কেন্দ্র করে উঁকি দিচ্ছে সোনালী ভবিষ্যৎ। এই প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো ২৯ কিলোমিটার পথ সংযোগ করে মিয়ানমারের কাছে গুমধুম পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে। ফলে খুলে যাবে মিয়ানমার, চীনসহ ট্রান্সএশিয়ান রেলওয়ের করিডোরে যুক্ত হওয়ার সুযোগ।
পরবর্তী সময়ে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরও আসবে এই রেল নেটওয়ার্কের আওতায়। পাশাপাশি এক ডজনেরও বেশি অর্থনৈতিক অঞ্চল, টেকনাফ নৌবন্দরকে ঘিরে পূর্বাঞ্চল রেলের সবচেয়ে ব্যস্ত রুট হতে যাচ্ছে কক্সবাজার পর্যন্ত সম্প্রসারিত এ রেলপথ।
কক্সবাজারের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হচ্ছে। গভীর সমুদ্র বন্দর হচ্ছে। ফলে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্টেশনের যুগে প্রবেশ করবে কক্সবাজার।
এই রেলপথকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামের চকরিয়ায় পণ্য পরিবহনের হাব তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। ফলে পর্যটনের পাশাপাশি লবণ, কৃষি, আবাসন, চিংড়ি, শুটকি প্রভৃতি শিল্পে নতুন বিনিয়োগ সম্ভাবনা তৈরি হবে। সুযোগ তৈরি হবে বিপুল কর্মসংস্থানের। এ রেলসংযোগের ফলে সহজে ও কম খরচে এ অঞ্চলে উৎপাদিত মাছ, লবণ, রাবারের কাঁচামাল এবং বনজ ও কৃষিজ দ্রব্য পরিবহন করাও সম্ভব হবে। যার মাধ্যমে ঘুরে যাবে এই অঞ্চলের অর্থনীতির চাকা।
মোংলা রেলপথ প্রকল্প
মোংলা বন্দরের পণ্য পরিবহনে এবং বিশ্বর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ সুন্দর বন্দরে পর্যটক আকর্ষণে বিশাল ভুমিকা পালন করবে মোংলা রেলপথ। খুলনা থেকে বাগেরহাটের মোংলা পর্যন্ত প্রায় ৬৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। নির্মাণ করা হযেছে রুপসা নদীর উপর ১৩ কিলোমিটার রুপসা রেল সেতু। এই রেলপথের মাধ্যমে খুলনার ৫টি উপজেলা ও বাগের হাটের ৪টি উপজেলায় নতুন রেললাইন যুক্ত হয়েছে। এই রেলপথে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য পণ্য পরিবহনে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটবে।
আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ
উদ্বোধন হয়েছে আখাউড়া-আগরতলা রেলপথ। এই রেলপথ ভারত, বাংলাদেশ এবং ভুটানের মধ্যে পণ্য পরিবহন সহজতর করবে। ভুটানের সব পণ্য ও ভারতের ৬০% পণ্য আমদানী করা যাবে আখাড়রা বন্দর দিয়ে। বাংলাদেশের সব ধরণের পণ্য ভারতে রপ্তানী করা যাবে এই রেলপথ দিয়ে। বৃদ্ধিপাবে বাংলাদেশ ও ভারতের ত্রিপুরাসহ সেভেন সিস্টার্সের যোগাযোগ।
এই রেলপথ চালুর মধ্য দিয়ে আখাউড়া থেকে কলকাতা পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করতে পারবে। চট্টগ্রাম থেকে পণ্যবাহী ট্রেন সরাসরি যেতে পারেবে ভারতের সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলে। দুই দেশের বাণিজ্যে গতি বাড়বে। বিশেষ করে পাথর ও গম আমদানি সহজ হবে। ভারতের পণ্যবাহী ট্রেন বাংলাদেশের ভেতরে আসতে পারবে। যার ফলে কমে যাবে আমদানী ব্যয়। ১২ দশমিক দুই চার কিলোমিটারের এই রেলপথের বাংলাদেশ অংশের ৬.৭৮ কিলোমিটার পথ তৈরি করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
বঙ্গবন্ধু রেলসেতু
রেল উন্নয়নের এক মেগা প্রকল্প বঙ্গবন্ধু রেল সেতু। যমুনার বুক চিরে ৪.৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই রেল সেতুর নির্মাণ কাজ এগিয়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। ২০২৪ সালে এই সেতু দিয়ে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। ১৯৯৮ সালে বঙ্গবন্ধু সেতুতে সড়কের পাশাপাশি রেল চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে ঢাকার সঙ্গে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রেল যোগাযোগ স্থাপিত হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে সেতুটিতে ফাটল দেখা দেয়ায় ট্রেনের গতি ২০ কিলোমিটারে কমিয়ে চলাচল করতে হয়। এতে সময় অপচয়ের পাশাপাশি ঘটছে সিডিউল বিপর্যয়। যাত্রী ভোগান্তি কমাতে শেখ হাসিনা সরকার যমুনা নদির উপর আলাদা নতুন একটি রেলসেতু তৈরির উদ্যোগ নেয়। ডাবল লাইনের এই সেতুটি নির্মাণ হলে ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার অবিরাম গতিতে চলতে পারবে। দিনে চলবে ৮৮টি ট্রেন। এতে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলের রেল যোগাযোগে মানুষের যাতায়াতের পাশাপাশি প্রসার ঘটবে ব্যবসা বাণিজ্যের। সূচনা হবে রেল যোগাযোগের নতুন দিগন্ত।
এসব প্রকল্প ছাড়াও আরো ৩৬টি প্রকল্পের কাজ চলছে। বর্তমান সরকারের আমলে ৮৫১ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ এবং ১ হাজার ৩৮৯ কিলোমিটার রেলপথ পুন:নির্মাণ করা হয়েছে। এ সময়ে ১ হাজার ১৪টি নতুন রেলসেতু নির্মাণ, ৯৫২টি পুরনো রেলসেতু সংস্কার, পুন:নির্মাণ, ১৩২টি স্টেশন ভবন নির্মাণ, ২৩১টি ষ্টেশন ভবন সংস্কার, ৩৪০ কিলোমিটার সিঙ্গেলগেজ রেলপথ ডুয়েল গেজে রুপান্তর করা হয়েছে। বিভিন্ন রুটে নতুন ট্রেন চালু হয়েছে ৭৪৮টি।
শুধু অবকাঠামো উন্নয়নই নয় রেল সরঞ্জাম আধুনিকায়নেও নজর দিয়েছে সরকার। নতুন রেলস্টেশনে রয়েছে কম্পিউটার বেইজড ইন্টারলক সিগনাল সিস্টেম এবং ডিজিটাল টেলিকমিউনিকেশন সিস্টেম। রেলে যাত্রীবাহী কোচ যুক্ত হয়েছে ৫৮৮টি। নতুন ব্রডগেজ যাত্রীবাহী কোচ যুক্ত হবে আরও ৫৮০টি। আর মিটারগেজ কোচ যুক্ত হবে ৪২০টি। পণ্য বহনের জন্য ওয়াগন যুক্ত হয়েছে ৫১৬টি। নতুন ওয়াগন যুক্ত হচ্ছে ১ হাজার ৩১০টি। ৭৫টি মিটারগেজ ও ৫০টি ব্রডগেজ লাগেজ ভ্যান যুক্ত হয়েছে। যুক্ত হচ্ছে আধুনিক আরও ১২৫টি লাগেজ ভ্যান। ৩০টি মিটারগেজ ও ২৫টি ব্রডগেজ লোকোমোটিভ রেল বহরে যুক্ত হয়েছে। যুক্ত হবে আরও ৪৬টি ব্রডগেজ ইঞ্জিন।
প্রয়োজন আধুনিক ওয়ার্কশপ ও দক্ষ জনবল
বিএনপি-জামাত সরকারের আমলে খালেদা জিয়া সরকার গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে ১০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকুরী থেকে বাদ দেয়ায় ব্যাপক জনবল ঘাটতি ঘটে রেলে। বর্তমান সরকার আড়াই হাজারের মতো জনবল নিয়োগ দিয়েছে এবং নিয়োগবিধি চূড়ান্ত করে আরো প্রায় ২৫ হাজার জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা করেছে।
নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে রেল বিপ্লব ঘটেছে। মহাপরিকল্পনার সুবাদে দ্রুত এই নেটওয়ার্কের আরও বিস্তৃতি ঘটবে। এই নেটওয়ার্ককে টেকসই করতে লোকোমটিভ কারখানা, ক্যারেজ ও ওয়াগন ওয়ার্কশপগুলোকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে। এই বিশাল নেটওয়ার্ক পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা এবং সঠিক রক্ষনাবেক্ষণের জন্য দরকার দক্ষ প্রকৌশলী এবং কারিগরী জনবল। এজন্য দক্ষ জনবল তৈরির পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। ওশেন বিশ্ববিদ্যালয় বা এভিয়েশন বিশ্ববিদ্যালের মতো বিশেষায়িত রেলপ্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এখন সময়ের দাবী। আপাতত প্রতিটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রেল প্রকৌশল বিভাগ চালু করে প্রয়োজন মেটানো যেতে পারে। এ ছাড়া প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন টেকনিশিয়ান। দেশে-বিদেশে এদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। যেমন করে জনবল তৈরী করছে মেট্রোরেল।
লেখক: প্রকৌশলী, সিনিয়র সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
বাংলাদেশের রেলযোগাযোগে সোনালী বিপ্লব মত-দ্বিমত মাহমুদুল হাসান শামীম