ব্যর্থতার স্বীকারোক্তির জন্য ধন্যবাদ পেতে পারেন মির্জা ফখরুল
১৯ মে ২০১৮ ১২:০৮
মোস্তফা ফিরোজ ।।
আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে জেল থেকে মুক্ত করতে না পারাটা ব্যর্থতা বলে স্বীকার করলেন বিএনপির মাহসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার এই স্বীকারোক্তিরর জন্য অবশ্যই তিনি ধন্যবাদ পেতে পারেন। তিনি এই কথার মধ্য দিয়ে রাজনীতির একটি কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।
বিএনপির রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা হয়তো তাদের এই অসহায়ত্ব দেখে আনন্দ পেতে পারেন। কিন্তু গভীরভাবে ভাবলে এটা আনন্দের না উদ্বেগের কথা।
কেন সেটা ব্যাখ্যা করছি। একবার ভাবুনতো আজ থেকে ১৫/২০ বছর আগে খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনার মতো এমন উচ্চ মাপের কোন নেতাকে জেলে পুরে রাখার কথা ভাবতে পেরেছে? পারেনি। যদি ভাবতেই পারতো তাহলে জেনারেল এরশাদ দুই নেত্রীকে জেলে পুরে রাখতেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া। দীর্ঘ ৯ বছরের এই আন্দোলনে জেনারেল এরশাদের সাহস হয়নি এই দুই নেত্রীক নাজিমুদ্দিন রোডের কাটাগারে পাঠানোর। যদি সম্ভব হতো পাঠানোও হতো। কিন্তু এরশাদ জানতেন তাদেরকে জেলে পুরলো সামলানো যাবে না। গণআন্দোলন এমন তীব্র হতো যে তার কারণে তার স্বৈরশাসন তছনছ হয়ে যেতো।
কিন্তু ওয়ান ইলেভেনের সময় দূর্বল চিত্তের ফখরুদ্দীন সরকার ঠিকই জেলে পুরতে সাহস পেয়েছিল। যদিও সেটা পূর্ণাঙ্গ কারাগার না, তারপরওতো জাতীয় সংসদ ভবনে দুটি বাড়িকে অস্থায়ী কারাগার বানিয়ে তাদেরকে সেখানে রাখা হয়েছিল।
তাহলে কিভাবে সেটা সম্ভব হয়েছিল? এটাই বিশ্লেষণ করা দরকার ভালোভাবে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় হাসিনা-খালেদার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বী। তাই তাদেরকে স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু এরশাদ পতনের পর দুই দল যখনই পাঁচ বছর অন্তর ক্ষমতায় আসতে থাকলো তখনই দুই নেত্রী ও তাদের দল ও সরকারের কর্মকাণ্ডে মানুষের উচ্চাশা কমতে থাকে। দেশের মানুষ অত্যন্ত হতাশা নিয়ে দেখতে থাকলো আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শাসনব্যবস্থা কোন কোন ক্ষেত্রে সামরিক শাসনের চেয়েও খারাপ। গণতন্ত্রের নামে লুটপাটতন্ত্র ও অপশাসনে মানুষ গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। শুধু তাই না, রাজনীতির একপক্ষ অন্যপক্ষকে নির্মূল করে অপশাসনকে প্রলম্বিত করার অপচেষ্টায় গোটা গণতান্ত্রিক কাঠামো ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে।
এমন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বড়ো দুটি দল যখন জনসমর্থন হারাতে থাকে তখন ওয়ান ইলেভেন সরকার নীরব জনসমর্থনের ওপর ভর করে মাইনাস টু ফর্মুলা বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। অথচ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মতো কোন আন্দোলন ফখরুদ্দীন-মইনুদদীন সরকারের বিরুদ্ধে আর গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কেননা, ততক্ষণে দুই দলই জনসমর্থন হারিয়ে তাদের আন্দোলনের শক্তি বিনষ্ট করে ফেলেছে।
এমনকি, যদি সেনা হস্তক্ষেপ না হতো তাহলে বিএনপি-জামাত জোটের নেতৃত্বে ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকানো সম্ভব ছিল না। ওই সময়ে আওয়ামী লীগ আন্দোলনে ছিল, কিন্তু সেটা এমন তীব্র ছিল না যে তার প্রভাবে নির্বাচন বানচাল হয়ে যেতো বা সরকারের পতন ঘটাতো। বরং সেনা হস্তক্ষেপ হওয়াতে আওয়ামী লীগ এক অর্থে সৌভাগ্যের অধিকারি হলো এই কারণে যে তাদের পক্ষে কেবল আন্দোলন করে ২২ জানুয়ারির এক তরফা নির্বাচন প্রতিহত করা সম্ভব ছিল না।
আর সেনা হস্তক্ষেপ ছাড়া ২২ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন যদি হয়েই যেতো তাহলে আজ বিএনপি যে যে দূর্দশার ভিতরে পড়েছে আওয়ামী লীগের অবস্থাও একই দাঁড়াতো।
তখন আন্দোলন করে বিএনপি-জামাত জোটের বিরুদ্ধে সুবিধা করা যেতো না। তাহলে বলাই যায় এখনকার রাজনৈতিক দৃশ্যপট একই থাকতো। কেবল ক্ষমতায় থাকতো বিএনপি জোট। আর বিরোধী দলে থেকে সীমাহীন নিপীড়ন নিষ্পেষণের শিকার হতো আওয়ামী লীগ। কিছুই করার থাকতো না। মনে রাখা দরকার, কেবল সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে আন্দোলন ধরে রাখা যায় না। জনসম্পৃক্ততা লাগে। কিন্তু আগেই বলেছি, তারা বিএনপি ও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হতাশ। ক্ষমতায় থেকে তারা এমন নজীর রাখেনি যে এখন তারা তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে রাজপথে জীবন দেবে। তারা বড়ো জোর একবার একে আর একবার ওকে ভোট দিতে পারে। তাও যদি ভোট দেয়ার মতো পরিবেশ থাকে। না থাকলে ভোট কেন্দ্রে উঁকিও দেবেনা।
জনগণের যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেছে। এখন রাজনীতিবিমুখ এই জনতার কাঁধে ভর করে বড়ো কোন আন্দোলন সম্ভব না। বাস্তবে হচ্ছেও না। আর বড়ো শক্তি ছিলো ছাত্র আন্দোলন। কিন্তু সেটাও শেষ। গত ২০ বছর ধরে ডাকসু রাকসু চাকসু জাকসুসহ দেশের কোথাও ছাত্র সংসদ নেই। আছে দলীয় লেজুরবৃত্তির ছাত্র সংগঠন। ফলে, তরুণ মেধাবী ছাত্ররা চলে গেছে রাজনীতির বাইরে। আর আওয়ামী লীগ বিএনপি ক্ষমতার যে রাজনীতি জাতিকে উপহার দিয়েছে তাতে ছাত্ররা আরো হতাশ। তাহলে সরকার বিরোধী বড়ো আন্দোলন গড়ে উঠবে কিভাবে?
রাজনীতিতে হতাশ ছাত্র জনতা এখন আর আন্দোলনে উৎসাহী না। তারা নিশ্চুপ নির্বাক। এই কারণে বিএনপির পক্ষ থেকে খালেদার মুক্তির আন্দোলন বেগবান হয়নি। এভাবেই রাজনৈতিক দূর্ভাগ্যের শিকার হয়েছে বিএনপি। আগেই বলেছি সেনা হস্তক্ষেপ না হলে ২২ জানুয়ারি নির্বাচন করে বিএনপিও এখন ‘সৌভাগ্যের’ অধিকারী হতে পারতো।
রাজনীতির এই নির্মম বাস্তবতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বুঝেছেন। অন্যদেরও শিক্ষা নেয়া উচিৎ। বিষয়টি আনন্দের না, উপলদ্ধির। কারণ কোন কারণে গদি উল্টে গেলে তখন মির্জা ফখরুলের মতোই অন্যদেরও আফসোস করতে হবে।
মোস্তফা ফিরোজ : বার্তা প্রধান, বাংলাভিশন।
[এই কলামে তুলে ধরা সকল মতামত লেখকের নিজের]
সারাবাংলা/এমএম