ক্ষণজন্মা এক কীর্তিমান পুরুষ শেখ মণি
৪ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:৩২
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং রাজনীতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় এক নাম শেখ ফজলুল হক মণি। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও অকুতোভয় এক বীর সৈনিক তিনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স তথা মুজিব বাহিনীর প্রধান কমান্ডার হিসেবে অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। মুজিব বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা তার নেতৃত্বে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কুমিল্লা-বরিশাল-সিলেটে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। স্বাধীন-সার্বভৌম লাল-সবুজের পতাকা খচিত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এই মুজিব বাহিনীর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান অনস্বীকার্য।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ, বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি ও স্বাধিকার আন্দোলনের উজ্জ্বল নক্ষত্র শেখ ফজলুল হক মণি ১৯৩৯ সালের ৪ ডিসেম্বর টুঙ্গিপাড়ায় ঐতিহাসিক শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মরহুম শেখ নূরুল হক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি। মা শেখ আছিয়া বেগম বঙ্গবন্ধুর বড় বোন। শিক্ষাজীবন শুরু করেন গোপালগঞ্জের গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর ঢাকা নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। অতঃপর ১৯৬০ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কারাগারে থাকাবস্থায় ড. আলীম আল রাজী আইন কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন তিনি। তখন থেকেই তার মধ্যে নেতৃত্ব গুণ ছিলো। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করার জন্য ছয় মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের হাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরোধীতে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। এই আন্দোলন সফল হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এমএ ডিগ্রি প্রত্যাহার করে। পরবর্তীতে মামলা করে মামলায় জয়লাভ করেন এবং ডিগ্রি ফিরে পান।
শেখ ফজলুল হক মণি ছোটবেলা থেকেই বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে অনেক স্নেহ করতেন ও ভালোবাসতেন। আদর্শবাদী রাজনীতির অন্যতম দিশারী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। আর সেই রাজনীতির দীক্ষা গ্রহণ করে নিজেকে তৈরি করেছিলেন মণি। ছাত্রজীবনেই তার রাজনৈতিক যাত্রা শুরু হয়েছিল। জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ছিলেন তিনি। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। স্বৈরাচারী শাসক আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে তার অবদান ছিল অপরিসীম। ১৯৬৬ সালে ছয়-দফা আন্দোলনের সময় তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বহুমাত্রিক প্রতিভাধর একজন মানুষ ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি। একজন সাংবাদিক, লেখক ও বাঙালি সংস্কৃতির একনিষ্ঠ ধারক হিসেবে খ্যাতি ছিলো তার। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক বাংলার বাণী পত্রিকা দৈনিকে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্ট তিনি সাপ্তাহিক সিনেমা পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯৭৪ সালের ৭ জুন তার সম্পাদনায় ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সময়ে তিনি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’, ‘দি পিপলস’ও ‘দৈনিক বাংলার বাণী’তে নিয়মিত কলাম লিখতেন তিনি। একজন গল্পকার হিসেবেও পরিচিতি ছিলো তার। ১৯৬৯ সালে তার রচিত গল্পের সংকলন বৃত্ত প্রথম প্রকাশিত হয়। স¤প্রতি সংকলনটি আবারও প্রকাশিত হয়েছে ‘গীতারায়’ নামে। শিশু-কিশোরদের সংগঠন শাপলা কুঁড়ির আসরের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। পশ্চিমবঙ্গের ‘দেশ’ পত্রিকার মতো একটি উন্নত ম্যাগাজিন প্রকাশ করার ইচ্ছে ছিলো তার। দৈনিক পত্রিকায় একটি বিশেষ প্রতিবেদন রঙিন অক্ষরে বাংলাদেশে প্রথম তিনিই করেছিলেন। তখনকার দিনে ‘বাংলার বাণী’ই ছিল বড় ও আধুনিক প্রকাশনা। পত্রিকার খুঁটিনাটি প্রেস, ফটোগ্রাফ, মেকআপ, কম্পোজ প্রভৃতির ব্যাপারে বিস্তারিত জ্ঞান রাখতেন। পত্রিকার প্রতি ভালোবাসা এতটাই ছিল যে রাত দুইটা, তিনটায় পত্রিকার প্রথম ছাপা কপি হাতে নিয়ে বাসায় ফিরতেন। পরের দিন দশটা এগারোটার মধ্যে অফিসে চলে যেতেন। তিনি ভীষণ জ্ঞানপিপাসু এবং বইপাঠক ছিলেন।
শেখ মণি একজন পরিপূর্ণ রাজনীতিবিদ। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যোগ্য পতাকাবাহক। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির নির্মাণে যারা সম্মুখসারিতে কাজ করেছেন, তারা প্রধানত ছাত্র-যুবা। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছাত্র-যুবারাই আন্দোলন করেছেন, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে নিজের জন্মভূমিতে ফিরে তারা দেখতে পান, শকুনির ধ্বংসযজ্ঞ। একদিকে স্বজনের লাশ, হাজারো নির্যাতিত নারী,গৃহহীন, সহায়সম্বলহীন অসহায় মানুষ, অন্যদিকে রাজাকার-আলবদরসহ সুবিধাবাদী কিছু মানুষের উল্লম্ফন। এ পরিস্থিতিতে ছাত্র-যুবা-তরুণদের অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু ঠিক সে সময়টিতেই তাদের নেতৃত্বে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের দায়িত্ব দেন শেখ মণির হাতে। প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। যার প্রধান লক্ষ্য ছিলো- দারিদ্র ও বেকারত্ব দূর করে আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং অসাম্প্রদায়িক ও ন্যায্যতার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পৃথিবীর অন্য স্বাধীন দেশ থেকে আলাদা। বাংলাদেশে একদিকে রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন এবং একই সাথে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব অর্জন- উভয় কাজই হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে দেশ নির্মাণে যুব শ্রেণির সক্রিয় ভূমিকা রাখা ছিল অপরিহার্য। বিশ্বের বিভিন্ন নতুন দেশে বিপ্লব বা স্বাধীনতার পর এমন ভূমিকাই নিয়েছে সে দেশের তরুণ-যুব সমাজ। প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসেবে শেখ মনির নেতৃত্বে যুবলীগ সেই কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টের পর থেমে যায় সেই প্রয়াস। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে ঘাতকরা তাকেও হত্যা করে সেদিন। কিন্তু ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। অনন্য কীর্তির মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে আছেন বাঙালির হৃদয়ে। মাত্র ৩৬ বছর জীবনকালে শেখ মণি যে অবদান রেখে গেছেন, তা বাঙালি জাতি কোনোদিন ভুলতে পারবে না। কীর্তিমান এই পুরুষের জন্মদিন আজ। এই দিনে তাকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়।
লেখক: শিক্ষক, কলামিস্ট ও কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, কেন্দ্রীয় কমিটি
সারাবাংলা/এসবিডিই
ক্ষণজন্মা এক কীর্তিমান পুরুষ শেখ মণি ডা. আওরঙ্গজেব আরু মত-দ্বিমত