ইতিহাসের দায়মুক্তি
৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ০০:৩৯
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের পরপরই ২৬শে সেপ্টেম্বর একটি অধ্যাদেশ আকারে ইনডেমনিটি আইনটি প্রণীত হয়। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নং ৫০ নামে অভিহিত ছিল। পরে ১৯৭৯ সালে সংসদে অধ্যাদেশটি অনুমোদন করা হয়। এর প্রেক্ষিতে এটি একটি আনুষ্ঠানিক আইন হিসেবে অনুমোদন পায়। বিতর্কিত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ হয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া রোধ করার জন্য। ইতিহাসের নিকৃষ্টতম এই অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ উল্লেখ ছিল। প্রথম অংশে বলা হয়- ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না। দ্বিতীয় অংশে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি উল্লেখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো।
এই দায়মুক্তি (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া হয়। এই আইনের দ্বারা বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের সব পথ বন্ধ থাকে। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত দায়মুক্তি অধ্যাদেশে সহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ ঘোষণাকে আইনে বৈধতা দেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খুনিরা সামরিক আইন জারি করলেও সংবিধান বাতিল করেনি। সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হলে উপ রাষ্ট্রপতি কিংবা স্পিকার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন। খন্দকার মোশতাক মন্ত্রী ছিলেন, উপ রাষ্ট্রপতি কিংবা স্পিকার ছিলেন না। সে সময় উপ রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম আর স্পিকার ছিলেন আব্দুল মালেক উকিল। খুনিরা উপ রাষ্ট্রপতি ও স্পিকারকে রাষ্ট্রপতি না করে মোশতাককে বেছে নিয়েছিল রাষ্ট্রপতি হিসেবে। (বাংলা ট্রিবিউন ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০)
২০০২ সালের ১৬ অক্টোবর তৎকালীন বিএনপি সরকার অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে দেশব্যাপী অভিযান শুরু করে। অভিযানে বিমানবাহিনী বাদে অন্যান্য বাহিনীর মধ্যে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বর্ডার গার্ড, পুলিশ এবং আনসার বাহিনীর প্রায় ৪০ হাজার সদস্যের সমন্বয়ে প্রায় ৮৪ দিনের অভিযান পরিচালনা করে। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর হিসাব মতে, এই অভিযানকালে ৫৫ জন নিহত হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদের অনুমোদনক্রমে সারা দেশে সন্ত্রাস দমনের নামে যৌথবাহিনী মোতায়েন করা হয়। সেই অভিযানের সাংকেতিক নাম দেওয়া হয় অপারেশন ক্লিনহার্ট। সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে দেশে বিদেশে আলোচনার ঝড় ওঠে । সন্ত্রাস দমনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ক্ষেত্রে জনমনে নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অভিযান চলাকালে যৌথবাহিনী কর্তৃক ব্যাপক ধরপাকড় ও হতাহতের ঘটনায় তাদের জবাবদিহিতার প্রশ্নটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালের ৯ জানুয়ারি যৌথ অভিযান দায়মুক্তি অধ্যাদেশের ২০০৩ নামে একটি ইনডেমনিটি বিল পাস হলে বিষয়টি আরও স্পর্শকাতর হয়ে পড়ে। এই আইনের অধীনে অপারেশন ক্লিনহার্ট চলাকালে যৌথবাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সরকারের পক্ষে কৃত সকল কার্যের ক্ষেত্রে দায়মুক্তি প্রদান করা হয়। (সূত্র: মানবাধিকার বাংলাদেশ ২০০২, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।
অধ্যাদেশটির ৩-এর (খ) অংশে বলা হয়েছে: “(ক)-এ উল্লিখিত ১৬ই অক্টোবর, ২০০২ তারিখে প্রদত্ত আদেশ বা তৎপরবর্তী সময়ে প্রদত্ত আদেশ বা কার্যের দ্বারা কাহারও প্রাণহানি ঘটিলে, কাহারও জান বা মালের কোন ক্ষতি হইলে বা কাহারও কোন অধিকার ক্ষুণ্ণ হইলে বা কেহ আর্থিক, শারীরিক বা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইলে বা কেহ অন্য কোনভাবে সংক্ষুব্ধ হইলে তজ্জন্য সংশ্লিষ্ট সকল আদেশ প্রদানকারীর বিরুদ্ধে বা কার্যনির্বাহীর বিরুদ্ধে বা উক্ত দফায় উল্লিখিত কোন সদস্য বা ব্যক্তি বা শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্যগণের বিরুদ্ধে বা তাহাদিগকে আদেশ প্রদানকারীর বিরুদ্ধে বা যৌথ অভিযানে নিয়োজিত শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্য কোন সদস্যের বিরুদ্ধে বা সরকার বা সরকারের কোন সদস্যের বিরুদ্ধে বা সরকারের কোন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কোন আদালতে কোন প্রকার দেওয়ানি বা ফৌজদারি মকদ্দমা বা কার্যধারা বা তৎসম্পর্কে কোন আদালতের নিকট কোন অভিযোগ বা প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না এবং এতদসম্পর্কে এই প্রকার কোন মোকদ্দমা বা কার্যধারা কোন আদালতে দায়ের করা হইলে বা এই ধরনের কোন মোকদ্দমা বা কার্যধারার বা প্রশ্নের ভিত্তিতে কোন রায়, আদেশ বা সিদ্ধান্ত দেওয়া হইলে তাহা বাতিল, অকার্যকর হইবে বা হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।” এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে, উপরোক্ত অংশ অনুযায়ী কেবল শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরই তাদের কৃতকার্যের জন্য দায়মুক্তি দেওয়া হয়নি, সরকার ‘আদেশদাতা’ হিসেবে নিজের জন্যও দায়মুক্তির ব্যবস্থা করেছে।
অধ্যাদেশটির ৬ (খ) অংশে বলা হয়েছে: “১৬ই অক্টোবর ২০০২ তারিখ হইতে ৯ জানুয়ারি ২০০৩ তারিখ কার্যদিবস পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দেশের শৃঙ্খলা রক্ষার প্রয়োজনে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা প্রদানের জন্য সরকার কর্তৃক ১৬ই অক্টোবর ২০০২ তারিখে প্রদত্ত আদেশ এবং তৎপরবর্তী সময়ে প্রদত্ত সকল আদেশ, উক্ত আদেশসহ বাস্তবায়নের জন্য কৃত যাবতীয় কার্যে এবং উক্ত আদেশসমুহ বলে ও অনুসারে যৌথ অভিযানের জন্য কোন সদস্য বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত সময়ের মধ্যে তাহার দায়িত্ব বিবেচনায় প্রদত্ত আদেশ, মৃত্যু, আটক, গ্রেফতার, তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদসহ সকল প্রকার কার্য ও গৃহীত ব্যবস্থা, প্রচলিত আইনে ও আদেশসমূহে যাহাই থাকুক না কেন, ১৬ই অক্টোবর, ২০০২ তারিখ প্রদত্ত আদেশ প্রদানকারী এবং কার্য সম্পাদনকারী এবং যৌথ অভিযানে নিয়োজিত শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যগণকে সর্বপ্রকার দায়মুক্ত করা হইল।”
এই অধ্যাদেশ জারি ও পরবর্তী সময়ে জাতীয় সংসদে বিলটি পাসের মাধ্যমে হত্যা-নির্যাতনের মতো গুরুতর অপরাধকে দায়মুক্ত করা হলো। বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো। ন্যায়বিচার প্রার্থনার স্থল আদালতের দুয়ার হলো রুদ্ধ। হত্যা ও নির্যাতনের এরূপ দায়মুক্তি কেবল বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নজিরবিহীনই নয়; বরং আইনের শাসন, গণতন্ত্র, সাংবিধানিক শাসন ও মানবাধিকারের মুলে চরম কুঠারাঘাত।
দায়মুক্তির সাংবিধানিক বৈধতা প্রদানের প্রশ্নে সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদের আশ্রয় গ্রহণের সুযোগ রয়েছে কিনা, এখন সেই প্রশ্ন বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। দায়মুক্তি বিধানের ক্ষমতা সংবলিত ৪৬ অনুচ্ছেদে বলা আছে : “এই ভাগের পূর্ববর্ণিত বিধানাবলীতে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি বা অন্য কোন ব্যক্তি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রয়োজনে কিংবা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে কোন অঞ্চলে, শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কোন কার্য করিয়া থাকিলে সংসদ আইনের দ্বারা সেই ব্যক্তিকে দায়মুক্ত করিতে পারিবেন কিংবা ওই অঞ্চলে প্রদত্ত কোন দণ্ডাদেশ, দণ্ড বা বাজেয়াপ্তির আদেশকে কিংবা অন্য কোন কার্যকে বৈধ করিয়া লইতে পারিবেন।’
উপরোক্ত অনুচ্ছেদে সংসদকে অত্যন্ত সীমিত ও শর্তসাপেক্ষ আইনের দায়মুক্তি সংক্রান্ত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কেবলমাত্র (ক) জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজনে কিংবা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে যে কোনো অঞ্চলে শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে যদি কোনো কার্য করা হয়, তবে সংসদ আইনের দ্বারা সেই ব্যক্তিকে দায়মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারে।
‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ২০০৩’- এ সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদের তিনটি শর্তের একটিও উপস্থিত নেই। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সময় অর্থাৎ ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কোনো ঘটনা এই দায়মুক্তি অধ্যাদেশের বিষয়বস্তু নয়। কোনো অঞ্চলে শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের কারণেও এই অধ্যাদেশ জারি করা হয়নি। অধ্যাদেশটি সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদের এখতিয়ার-বহির্ভূত। আইনের দায় থেকে অব্যাহতিকরণের ব্যাপারে সংবিধানে যে সীমাবদ্ধতার উল্লেখ আছে, তার বাইরে কোনো আইন করা সম্ভব নয়।
উপরন্তু শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহাল ও প্রণীত অধ্যাদেশের বৈধতা প্রদানে অপারগ। দেশে একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাসীন। রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা রক্ষাকারী যন্ত্রের কোনো অংশ বা অন্য কোনো বিদ্রোহী দল বা গোষ্ঠী কোনো প্রকার বিদ্রোহাত্মক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত নয় বা ছিল না। পুলিশ প্রশাসনের অদক্ষতা এ দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়, সরকারের সন্ত্রাস দমনের ব্যর্থতা জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানকে বিপর্যস্ত করে। তবে সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত থাকা অবস্থায় প্রশাসন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল।
৩৫(৫) অনুচ্ছেদে বলা আছে: “কোন ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাইবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনার দণ্ড দেওয়া যাইবে না কিংবা কাহারও সহিত অনুরূপ ব্যবহার করা যাইবে না।” এই অধ্যাদেশ জারির ফলশ্রুতিতে প্রতিটি নাগরিকের জীবনের অধিকার, আইনের সমান আশ্রয়লাভের অধিকার, বিচার পাওয়ার অধিকার (Access to Justice) চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। দায়মুক্তি অধ্যাদেশ কেবল সংবিধানে সন্নিবেশিত মৌলিক মানবাধিকারেরই লঙ্ঘন নয়, বরং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মানবাধিকার সমুন্নত রাখার অঙ্গীকারকে ম্লান করে দেয়।
বাংলাদেশ কনভেনশন এগেইন্সট টর্চার অনুসমর্থন করেছে। Internation Convenant on Civil & Political Rights (ICCPR) 972 International Criminal Court এর স্বাক্ষরকারী দেশ বাংলাদেশ। দায়মুক্তি অধ্যাদেশ প্রবর্তন ও পরবর্তী সময়ে তা দেশের আইনে পরিণত করা আন্তর্জাতিক চুক্তির আলোকে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারকে কেবল ম্লান করে দেয় না, করে তোলে প্রশ্নের সম্মুখীন। বাংলাদেশে মানবাধিকারের অগ্রযাত্রাকে করে ব্যাহত, বিপর্যস্ত ও বাধাগ্রস্ত। ‘যৌথ অভিযান দায়মুক্তি অধ্যাদেশ ২০০৩’-কে জাতীয় সংসদ কর্তৃক আইনে পরিণত করার মাধ্যমে সেনাসদস্যসহ পুলিশ, বিডিআর ও সরকারের সদস্যদের হত্যা, নির্যাতন, গ্রেফতার, হয়রানি, তল্লাশি ইত্যাদি অপরাধ থেকে দায়মুক্তি প্রদান সংবিধান পরিপন্থি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারের বিরোধী।
এই দায় মুক্তির ইতিহাস যেন ঘুরেফিরে আমাদের বর্তমান তৈরি হয়েছে। এই বর্তমান থেকে বেরিয়ে আসার অঙ্গীকার কারও মধ্যে দেখা যায় না। আর তাই বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের পেয়ে বসেছে। যেখানে জীবনের অধিকার অনিশ্চিত সেখানে অন্য সকল ব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ। ক্রসফায়ার, গুম আর হেফাজতে নির্যাতন সয়ে যাওয়া স্বত্বেও মৃদু প্রতিবাদ দায় মুক্তিতে কিঞ্চিত বাধা হয়ে কতদূর অগ্রসর হবে তা সময়েই বলে দিবে।
সারাবাংলা/আইই