বাঙালি হবার ডাক শুনতে কি পাও?
১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৯:৫৮
দেশ যখন স্বাধীন হয় তখন আমাদের বালকবেলা। স্বাধীনতার পর পর শুরু হয় আমাদের তারুণ্য। তখন কি আর এতো কিছু বুঝতাম না জানতাম? সে সময়কালে বিনোদন মানে একটা সাদাকালো টিভি বক্স আর বাংলা সিনেমা। সাদাকালো বাংলা সিনেমার সোনালী জগত তখন। টিকেটের লম্বা লাইন আগের রাতে গিয়ে লাইন ঠিক রেখে আসা কিংবা কালো বাজারে চড়া দামে টিকেট কিনে সিনেমা দেখা। মাঝখানে বিরতিতে কাঁচের বোতলে ফানটা আর চানাচুর সব স্বপ্নের মতো। সে স্বপ্নের সময়কালে সদ্য স্বাধীন দেশে নির্মিত হয়েছিল— ‘ওরা ১১ জন’, ‘বাঘা বাঙালি’, ‘রক্তাক্ত’ বাংলা নামের ছায়াছবি। মান কেমন ছিলো সে তর্ক মুখ্য নয়, মূল বিষয় ছিলো স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট। ঠিক সে সময় খান আতাউর রহমান আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দিলেন এক বিতর্ক। সে সময় না বুঝলেও এখন স্পষ্ট বুঝি কী ছিলো নেপথ্যে।
খান আতাউর রহমান নিঃসন্দেহে এক গুণী প্রতিভা। গানে-সুরে-ছায়াছবি নির্মাণে তার ভূমিকা অবিসংবাদিত। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে— ব্যক্তিজীবনের মতো তার ভূমিকা জীবনও সন্দেহময়। বলা উচিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও জাতির পিতা বিরোধী। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর বিপথগামী সেনা অফিসারদের জন্য তার দরদ উথলে উঠেছিল। ছুটে গিয়ে বাংলাদেশ বেতারে গান লিখে সুর দিয়ে প্রচার করলেন জাতীয়তা বিরোধী বিশেষত বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী গান। সেসবের বাইরেও— আজ যদি আমরা পেছন ফিরে দেখি— দেখবো খান আতার নির্মিত মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বলে পরিচিত ছবি ‘আবার তোরা মানুষ’— ছবিটি মূলত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সে সময়ে মানুষের মনে নানা ধরনের সন্দেহ আর আওয়ামী লীগ বিরোধী প্রচারের জন্য এমন একটি নামের সিনেমা দরকার ছিলো বৈকি। তখন একটি বিশৃঙ্খল দেশ ও সমাজকে বঙ্গবন্ধু ঠিক জায়গায় ফিরিয়ে আনছিলেন। অস্ত্রধারী মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি অস্ত্রসমর্পণ করিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন দেশ গঠনে। সে সময় হঠাৎ খান আতার মনে হলো মুক্তিযোদ্ধারা অমানুষ। তাদের মানুষ করতে হবে। কিন্তু কী মুশকিল— তার একবার ও মনে হলো না রাজাকার দালালরা আত্মগোপন করে থাকা খুনিদের মানুষ হয়ে ওঠা দরকার। জাতিকে জানানো হলো— মুক্তিযোদ্ধাদের আবার মানুষ হতে হবে।
এখনতো মনে হয় সাংস্কৃতিক এসব কাজেই লুকিয়ে ছিলো আজকের এই অধঃপতন। কিছু গানের কথা শুনলেও আপনি টের পাবেন তখন থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ চেতনার বিরোধিতা। ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’ গানটি আপাত সরল মনে হলেও— মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা সব শক্তিকে কিন্তু একধরণের বাতিল করার খায়েশ ছিলো গানে। বলাবাহুল্য, এই শক্তি ভারত রাশিয়াসহ আমাদের মিত্রশক্তি। আপনি খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন— কোনো গানেই কিন্তু একটি বারের জন্য ও বেগম রোকেয়া, প্রীতিলতা কিংবা সূর্যসেনের কথা আসেনি। অথচ অবলীলায় ঈশা খানের নাম এসেছে। ঈশা খান কে? সুবেদার, ফার্সিভাষী এক কঠিন শাসক। যার কাজ ছিলো বাংলা বাঙালি দমন। সে মানুষটি কেবল ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে গানে এলেন, এলো না বাংলাভাষী আমাদের স্বজন-পূর্বপুরুষ বা নারীরা।
এরপর আরও আছে। জেমস আমার খুব প্রিয় একজন গায়ক। স্বনামধন্য প্রতিভা। গানের কথা বা গানের কথায় ইতিহাস নিয়ে মাথা ঘামানোর মানুষ নন। গানপাগল এই মানুষটিকে দিয়ে গাওয়ানো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি শ্রুতিমধুর ও জনপ্রিয়। কিন্তু সেখানে একবারের জন্য ও শহীদ আলতাফ মাহমুদের নাম উচ্চারিত হয়নি। গানগাওয়ার অপরাধে সুরের দায়ে শহিদ মানুষটিকে বাদ দিয়ে কতো নাম কতো বিকৃতি। শহিদ জিয়ার কথাও এসেছে সেখানে। কে যে শহিদ আর কে গাজী সব হিসেব তখনই গোল পাকিয়ে গেছে।
আমার মতো আমজনতাও বুঝতে পারি এরপর আর কেউ এসব বিষয় ঠিক করার কথা ভাবেনি। আওয়ামী লীগ এখন যদি বলে তারা ইতিহাস বিকৃতি করেনি তা এখন হাস্যকর। গত তিন বারের দেশ-শাসনে তারা কোনো বিষয়ে সংস্কার করে জাতিকে শুদ্ধ করতে পারেনি। পারেনি জট খুলতে। উল্টো শাহবাগের মতো জমায়াত আন্দোলনকে তারা হালকা করে তোলায় যুবশক্তির বিশ্বাস টাল খেয়েছে তাদের কারণে। আজ আমরা কী দেখছি? ভুল জানতে জানতে ভুল শিখতে শিখতে সংস্কৃতিও তার শক্তি হারিয়ে দুর্বল। এতোটাই যে— সে আর রুখে দাঁড়াতে পারে না। ভুলে গেছে তার ভেতরের তেজ। অথচ এরশাদ ও জোট সরকারের আমলে সংস্কৃতি বারবার প্রমাণ করেছিল তাকে চোখ রাঙানোর শক্তি নাই।
এখন ধর্ম অধর্মের এক অসম লড়াই চলছে সমাজে। এমন করে সামাজিকমাধ্যমে ওয়াজ আর ওয়াজ বিরোধিতা হতে পারে আমরা ভাবিনি কখনো। বাংলাদেশের মানুষ চিরকাল ধর্মভীরু। আমাদের আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব সবাই কোনো না কোনোভাবে ধর্মের গণ্ডিতে বাঁধা। কিন্তু সে সময় এমন বিদ্বেষ প্রসূত বক্তব্য বা আচরণ দেখা যেতো না। যে সমস্ত স্থাপনাগুলো কেউ কোনোদিন ভাঙা দূরে থাক, ছুঁয়ে দেখার চিন্তা করেনি— সেগুলো এখন কোপানলের শিকার। আমরা কিন্তু এটাও দেখছি— আওয়ামী লীগ, অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর দল দেশ-শাসনে। তার কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ মর্যাদা ও গৌরবে আসীন। বিরোধী দল বলতে কিছু নেই। বিএনপি-জামাতও প্রকাশ্যে নেই। তারপরও একতরফা শাসনের বেড়ী ভেঙে জাতির জনকের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে। একই এলাকায় সম্প্রতি কোপানলের শিকার হয়েছে বাঘা যতীনের ভাস্কর্য। ব্রিটিশ বিরোধিতা থেকে স্বদেশের বিপ্লবী মুক্তিযুদ্ধের স্তম্ভ কিছুই বাদ পড়ছে না। এই অবনতি, এই বিদ্বেষ আর হিংসা কি আওয়ামী লীগ ঠেকাতে পারবে?
একটা কথা মানতেই হবে— জোর করে কোনো অপশক্তিকে সাময়িকভাবে দমানো যায় বটে— তবে তাকে নির্মূল করা যায় না। আজকের সমাজ ও দেশের দিকে তাকালে এটা মনে করার কারণ আছে— সামনের দিনগুলো ভাল হতে পারে না। আর যে খারাপের নমুনা দেখা যাচ্ছে তার ধারাবাহিকতা মূলত একটি জাতির আত্মহননের সামিল। একথা অগ্রিম বলে দিতে পারি— যদি তা হয়, তবে কান্নার বা ঘুরে দাঁড়ানোর লোকজন ও পাওয়া যাবে না।
ফিরে আসি এই আলোচনা শুরুর কথাগুলো দিয়ে। শেষবার যদি উদ্যোগ ও চেষ্টা করা না হয় তবে আন্তরিকভাবে বাঙালি আর বাঙালি থাকতে পারবে না। আমরা যারা দেশের বাইরে থেকে বলি কিংবা লিখি— অনেকে মনে করেন আমরা নিরাপদ বলয়ে থেকে তা করি। আপনারা হয়তো জানেন না, দুনিয়ার কোনো দেশেই বাঙালি না আছে স্বস্তিতে, না অবাধ নিরাপত্তায়। দেশ ভাল না থাকলে বাংলাদেশের কেউ কোথাও ভাল থাকে না। ব্রতচারী গানে গুরুসদয় দত্তের লেখায় ছিলো— ‘কায়মনে বাঙালি হ’।
আমাদের একটাই প্রত্যাশা— আবার সবাই বাঙালি হ। তাতেই মুক্তি।
লেখক: কলামিস্ট, লেখক; সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
সারাবাংলা/এজেডএস