Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে আতঙ্কে ভুগছে সংখ্যালঘুরা

রনি অধিকারী
১৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ২২:০২

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে এলেই ক্রমশ ভয়-আতঙ্কে ভুগতে থাকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এ ভয়ভীতি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা মোটেই ভিত্তিহীন নয়। বরং সময়োচিত বাস্তব ঘটনা। নির্বাচনকে সামনে রেখে সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন হয়, তার জন্য দেশত্যাগ কোনো সমাধান নয়। সংখ্যালঘুদের দেশে থেকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে অধিকার আদায় করতে হবে। প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনকে যথাযথ ভূমিকা পালনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে হবে। একইভাবে যে ব্যক্তিরা সংখ্যালঘুদের নির্যাতন করে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল থেকে তাদের মনোনয়ন পেলেও ভোটে এসব ব্যক্তিকে বয়কট করতে হবে। উগ্র-সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি ঠেকাতে নির্বাচনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপপ্রচার রোধ, সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ৬৪টি জেলায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না হলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় উপরোক্ত বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় আনা উচিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও আক্রমণের চিত্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নির্যাতনের অধিকাংশ ঘটনাই সংঘটিত হয়েছে নির্বাচনকালীন, পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে। এ পরিস্থিতির প্রভাব দেখা গেছে নব্বইয়ের দশক থেকে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে; এর পূর্ববর্তী ও পরবর্তী পর্যায়ে। ১৯৯০-এর অক্টোবরে সংখ্যালঘুরা আক্রান্ত হয়, উদ্দেশ্য দেশের গণআন্দোলন স্থবির করা; ২০০১-এর নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার শিকার হয় এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। অতঃপর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন-পরবর্তী হামলার ঘটনাও সুবিদিত। যশোরের অভয়নগরের মালোপাড়ার সে ঘৃণ্য ঘটনাই কালের সাক্ষী! এছাড়া বিভিন্ন সময়ে নানা ইস্যুতে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ নির্যাতন যেন নিত্যঘটনা। শাসকশ্রেণি কী জবাব দেবেন এ সহিংসতার? যেমন প্রশাসন, তেমন সমাজ কারো জবাবদিহির মতো মুখ নেই। এছাড়া আরো সহিংসতার শিকার হয় ব্রাক্ষণবাড়িয়া, নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায়। এমনকি জবাব মিলবে না রামু, উখিয়া, কক্সবাজারে বৌদ্ধ ও হিন্দুপল্লীতে হামলার ঘটনারও। এগুলোর শাস্তি বিধান কি হয়েছে? ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন হয়তো কোথাও কোথাও হয়েছে; কিন্তু অপরাধীর বিচার ও শাস্তি কতটা হয়েছে? এই অনাচারের যথোচিত শাস্তি না হওয়ার কারণে এ প্রবণতা সমাজে বেড়ে চলেছে। নির্বাচনের আগে-পরে যেন দানবীয় কায়দায় রূপ নেয় নির্যাতন। এমতাবস্থায় নিরাপত্তার অভাবে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এই দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। এই দেশের কোনো সংখ্যালঘুই স্বেচ্ছায় তাদের মাতৃভ‚মি ছাড়তে চায় না। তারপরও কেন তারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে? পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর গড়ে ০.৫ শতাংশ হারে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী দেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের আর কোনো লোক থাকবে না। দেড় কোটি সংখ্যালঘু বিপন্ন মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের দায়িত্ব। এই বিষয়টি সবাইকে অনুধাবন করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করতে নির্বাচন কমিশনকে স্মারকলিপি দিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ। এছাড়া নির্বাচনের আগে ও পরে ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও জননিরাপত্তা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ, আনসার মোতায়েনের পাশাপাশি র‍্যাব, বিজিবির নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা এবং একটি ‘মনিটরিং সেল’ গঠনের দাবি জানায় সংগঠনটি। নির্বাচনে ব্যক্তি, গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্ম এবং সাম্প্রদায়িকতাকে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যবহার করে অসুস্থ রাজনৈতিক বাতাবরণ তৈরি করা হয়। নির্বাচনের পূর্বাপর ব্যক্তি হিসেবে নয়, সংখ্যালঘু হিসেবে টার্গেট করে তাদের ওপর নির্বিচারে নিপীড়ন, নির্যাতন চালানো হয়। ঘর-বাড়ি উপাসনালয়ে হামলা চালানো হয়, জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করা হয় বলা হয় স্মারকলিপিতে। স্বাধীন বাংলাদেশের বিগত পাঁচ দশকের সংখ্যালঘু পরিস্থিতি তুলে ধরা আবশ্যিক হয়ে দাঁড়িয়েছে সংখ্যালঘুদের স্বার্থ ও কল্যাণে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনের রেখে বাংলাদেশ পরাশক্তিগুলোর ক‚টনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হওয়ায় এ দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। আমরাও আশা করতে চাই, উৎসব ও আনন্দমুখর পরিবেশে দেশের সব রাজনৈতিক দল ও জোট আসন্ন সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে এবং দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে তুলবে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের সংখ্যালঘুদের টার্গেট (লক্ষ্য) করে বিশেষ মহল অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে চায় এবং করে। তাদের লক্ষ্য একটাই দেশকে সংখ্যালঘু শূন্য করা। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে সংখ্যালঘুদের অবস্থা কী দাঁড়াবে, তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছে বিশেষজ্ঞ মহল।

১৯৪৭ সালে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ছিলো ২৯ দশমিক ৭ ভাগ। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে ১৯-২০ ভাগে নেমে আসে। ১৯৭৫ সাল পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু সংকোচননীতি বা সংখ্যালঘু নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহতভাবে চালিয়ে গেছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন চালানো হয়েছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পরও সংখ্যালঘু সংকোচনের ধারার অবসান হয়নি। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে চিত্র উঠে এসেছে, বাস্তবতা তার চেয়েও ভয়াবহ।

১৯৭০-এর নির্বাচন বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুগম করে। ১৯৭১ সালে প্রথমবারের মতো বাঙালির নিজের স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্বমাঝে স্বীকৃত হয়। এই পরিচয় ৫২ বছরে পদার্পণ করেছে। কিন্তু জাতির একটি অংশের কাছে ভোট আসে আতঙ্ক হয়ে। পাকিস্তান ছিলো একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র ভেঙে জন্ম নিলো বাংলাদেশ নামক একটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র। এদেশ মুক্ত ও স্বাধীন করতে মুসলিম হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানসহ দেশের অন্যান্য নৃগোষ্ঠীর লোকও যুদ্ধ করেছে, রক্ত দিয়েছে, শহীদ হয়েছে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রেও এদেশ সকল ধর্মের মানুষের বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। স্বাধীনতার পরে রাষ্ট্রের মূলস্তম্ভ হিসেবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নির্দিষ্ট করা হয়েছিলো। রাজনীতি এমন এক জায়গায় চলে গেছে, যেখানে দেশের জনগণ অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দিকে। বিষয়টি সবার জন্য সঙ্কটের ও উদ্বেগের।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশাসন, রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা সংখ্যালঘু অজুহাতে নির্যাতনের সময় নীরব ভ‚মিকা পালন করে। তাই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অতীতের মতো মঠ-মন্দির, বাড়িঘর, পূর্বপুরুষের ভিটা বাড়িতে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী হামলা করতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

১৯৭৫-এর ১৫ অগাস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করার আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র তার নির্দিষ্ট ও সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছিলো। কিন্তু এর পরে দুঃখজনকভাবে ধর্মীয় রাজনীতি অবারিত করা হয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী নিষিদ্ধ ঘোষিত ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেওয়া হয়।

ধর্ম-ভাষা বা জাতিগত কারণে মানুষকে গৌণ করে তোলা। তাদের সংখ্যালঘু বানিয়ে ফেলা এক প্রকার অসভ্যতাই বটে। সভ্যতা ও আধুনিকতা হচ্ছে মানুষ পরিচিত ও বিচার্য করে তার সততা, সৎগুণ ও মানবিক গুণাবলী দিয়ে। ধর্ম দিয়ে কখনো নয়। ধর্ম তার একান্ত নিজস্ব বিশ্বাসের ব্যাপার। এ নিয়ে সমাজ বা রাষ্ট্রের ভ‚মিকা রাখা জরুরি নয়। রাষ্ট্র তার সকল নাগরিকের জন্য সমান আচরণ করবে। বাংলাদেশের মহান সংবিধানেও তাই উল্লেখ আছে। এক সময় প্রায় কাছাকাছি সংখ্যানুপাতে থাকা সংখ্যালঘুর সংখ্যা এখন ৯ থেকে ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

নির্বাচনে সবদলের অংশগ্রহণকে যেমন গণতন্ত্রের অংশ বলে অবহিত করা হচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ বলে আখ্যা দেওয়া হচ্ছে তেমনিভাবে সংখ্যালঘুরা যেন নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারে, তাদের পছন্দের দলকে ভোট দিয়ে নিরাপদ থাকতে পারে সে ব্যবস্থা সুনিশ্চিত থাকাও গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত সে কথা আমরা যেন ভুলে না যাই। সংখ্যালঘু থাকা মানে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব থাকা, মুক্তিযুদ্ধের অস্তিত্ব থাকা। দেশ যদি সংখ্যালঘু শূন্য হয়ে যায়, তাহলে অনিবার্যভাবেই হয়তো গণতন্ত্রের পথে এক নতুন সঙ্কট সৃষ্টি হবে।

লেখক : কবি, সাংবাদিক

সারাবাংলা/এজেডএস

জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে আতঙ্কে ভুগছে সংখ্যালঘুরা রনি অধিকারী

বিজ্ঞাপন

নামেই শুধু চসিকের হাসপাতাল!
২২ নভেম্বর ২০২৪ ২২:০৬

আরো

সম্পর্কিত খবর