Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিজয়ের আনন্দ এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী
১৬ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:৫৫

বাংলাদেশে বিজয়ের আনন্দ সংহতকরণ প্রক্রিয়াটি, অন্যান্য কিছুর পাশাপাশি গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার অন্তর্নিহিতভাবে সম্পৃক্ত। গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী হওয়া একান্ত প্রয়োজন। এই মুহূর্তে এই চাওয়ার বিকল্প হচ্ছে বিএনপি-জামায়াত জোট কর্তৃক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করে দেয়া। যেমন বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক দালাল আইনের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হয়েছিলো। পরে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর জিয়াউর রহমান তা বন্ধ করে দিয়েছিল। এর প্রায় ৩৫ বছর পরে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনরায় গঠনের পর সেই বিচার আবার চালু হয়েছে এবং তা এখন চলমান আছে।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য দায়ী পরাজিত শক্তির দোসররা ২০২৩-এ ৫২ বছর আগের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য অগ্নি সন্ত্রাস ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে মানুষ হত্যা অব্যাহত রেখেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার অজুহাতে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীসহ সমমনা দলগুলোর অবরোধ-হরতালে বিভিন্ন এলাকায় গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। নিরাপদ বাহন ট্রেনে ঘটছে নাশকতার ঘটনা। এতে আতঙ্কিত ট্রেনযাত্রীরা।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের শেষ ভাগে ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের চারদিক থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে। মিত্রবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে তারা টিকতে না পেরে পিছু হটে গিয়ে বড় শহরগুলোতে সমবেত হতে থাকে। একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পাকিস্তানি সেনাদের ছোট ছোট দল মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে।

১৬ ডিসেম্বর দিনটি বাঙালি জাতির জন্য চিরায়তভাবে ঐতিহাসিক বিজয় আনন্দের বার্তাবাহী হয়ে আছে। ওই দিন বিকেল ৪টা ৫৫ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (সে সময়ের রেসকোর্স ময়দান) এই আত্মসমর্পণের দলিলে সই হয়। এতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর পক্ষে সই করেন কমান্ডার-ইন-চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, আর যুদ্ধরত পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের কমান্ডার লে. জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ছিলেন তখনকার বিমান বাহিনীর প্রধান ও মুক্তিবাহিনীর উপপ্রধান এয়ার কমোডর এ কে খন্দকার।

ভারতের পক্ষে ছিলেন সে দেশের তখনকার পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের চিফ অফ স্টাফ লে.জেনারেল জ্যাকব রাফায়েল জ্যাকব। আর পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তানি নৌবাহিনীর কমান্ডার ভাইস অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ শরীফ ও পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় বিমান বাহিনীর এয়ার ভাইস মার্শাল প্যাট্রিক ডি কলাঘান। আত্মসমর্পণের দলিলটি ছিল ইংরেজিতে।

আত্মসমর্পণের আগে পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা দীর্ঘ নয় মাস ব্যাপী বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে নির্বিচারে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেছে। আজ থেকে ৫২ বছর আগের এইসব গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এখনও আসে নি। আর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের বিচার পুরোপুরি হয়নি। তবে আশার কথা হচ্ছে শেখ হাসিনার সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য আদালত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এই আদালতের কার্যক্রম চলমান আছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো বিচার হয়েছে। পাশাপাশি একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছেন শেখ হাসিনার সরকার। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় হওয়া প্রয়োজন।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে দখলদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় কুখ্যাত সহযোগী বাহিনী রাজাকার, আলবদর এবং আলশামস্ কর্তৃক ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুটসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা সংঘটন দেশে-বিদেশে সকলেরই জানা।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বর্বর অপরাধ সংঘটনে যেসব ব্যক্তি অংশ নিয়েছিল এবং পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সদস্যদের সহায়তা করেছিল এবং উস্কানি ও প্ররোচনা দিয়েছিল তাদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালে ২৪ জানুয়ারী ‘দ্য বাংলাদেশ কোলাবরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার, ১৯৭২’ প্রণয়ন করে রাষ্ট্রপতির ৮ নং আদেশের মাধ্যমে জারি করা হয়। এই আইনটি দালাল আইন, ১৯৭২ হিসেবে পরিচিত ছিল। দালাল আইনের অধীনে প্রায় ৩৭ হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠিত ট্রাইব্যুনালে বিচারের আওতায় আনা হয়। ঐ আইনটি বলবত থাকা সত্ত্বেও ১৭ জুলাই ১৯৭৩-এ তৎকালীন আইনমন্ত্রী শ্রী মনোরঞ্জন ধর জাতীয় সংসদে ‘দি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) বিল, ১৯৭৩’ সংসদের বিবেচনার জন্য উত্থাপন করেন। উত্থাপনের পরে বিলটির ওপর রিপোর্ট পেশের জন্য বাছাই কমিটিতে প্রেরণ করার প্রস্তাব করা হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মাননীয় সংসদ সদস্য বিলটির ওপর ব্যাপক আলোচনা ও মতামত প্রদান করেন এবং ওই দিনই বিলটি সর্বসম্মতভাবে জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়।

কিন্তু একাত্তরের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দোসররা ষড়যন্ত্র করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাদের বিরুদ্ধে বিচার থেমে যায়।

১৯৭৫-এর ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় চারটি সুনির্দিষ্ট অপরাধে কারাগারে আটক ১১ হাজার আসামি, এমনকি সাজাপ্রাপ্তরাও জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যায়।

দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পরে ২০০৮-এর নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে ’৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। এই অঙ্গীকারের সূত্র ধরে ২৯ জানুয়ারি, ২০০৯ বৃহস্পতিবার নবম জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের তৃতীয় বৈঠকে মাননীয় সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরী (সিলেট-৩) কর্তৃক উত্থাপিত সিদ্ধান্ত প্রস্তাব -‘সংসদের অভিমত এই যে, দেশের চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের দ্রুত বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হউক’ জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২০১০ সালের পর থেকে গত ১৩ বছরে ৫১টি মামলার রায় হয়েছে। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের সন্নিবেশিত তথ্য অনুযায়ী বিচার ও প্রাক্-বিচার (তদন্ত শেষ হয়েছে) পর্যায়ে রয়েছে ৩৫ মামলা। আর ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে করা ৪০টি আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে। স্বাধীনতার ৩৯ বছর পর মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়।

আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ। এ হিসাবে যাত্রা শুরুর ১৩ বছর পূর্ণ হয়েছে। পরে ২০১২ সালের ২২ মার্চ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ২০১৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দুটিকে একীভূত করে আবার একটি ট্রাইব্যুনাল করা হয়। এখন একটি ট্রাইব্যুনালে (আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১) চলছে বিচারকাজ। এর আগে ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ৪০টি ও ট্রাইব্যুনাল-২ থেকে ১১টি মামলার রায় হয়। রাষ্ট্রপক্ষের তথ্যমতে, দণ্ডিত ১৩১ আসামির মধ্যে ৯১ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়। তাঁদের মধ্যে ৪৪ জন পলাতক। দণ্ডিত ১৩১ আসামির মধ্যে ৯১ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায়। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে ৪০ আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। বিচার ও প্রাক্-বিচার পর্যায়ে রয়েছে ৩৫ মামলা। এ পর্যন্ত ছয়জনের ফাঁসিসহ সাত আসামির দণ্ড কার্যকর হয়েছে।

সংবাদ মাধ্যমে পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে ৩৫টি মামলার বিচার চলছে। এসব মামলার আসামি ২১৪ জন। এ ছাড়া সাত শর বেশি অভিযোগের তদন্ত চলছে।

এই অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় সুসংহতকরণের লক্ষ্যে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান রাখা বাংলাদেশে ন্যায় বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী গোষ্ঠী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার তা আবার শুরু করেছে। তাই, আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেই কেবল ন্যায় বিচার ও আইনের শাসনের প্রতিষ্ঠার স্বার্থে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার চলমান থাকবে।

লেখক: পরিচালক, সেন্টার ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ। সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, ও সাবেক চেয়ারম্যান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

অধ্যাপক ড. অরুণ কুমার গোস্বামী বিজয়ের আনন্দ এবং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর