Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন: হার জিতের ইকুয়েশন

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
১৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৬:৪৬

আরেকটি জাতীয় নির্বাচন এখন দরজায় কড়া নাড়ছে। বাঙালী পরবর্তী পাচ বছরের জন্য কোন দলকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আনতে যাচ্ছে তা নির্ধারনে ক্যালেন্ডারের পাতায় আর একটি মাসও বাকি নেই। তবে নির্বাচনের ফলাফলটা সম্ভবত এখনই বলে দেওয়া সম্ভব। আওয়ামী লীগ যে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে যাচ্ছে এ নিয়ে সম্ভবত সবচেয়ে বোকা লোকটিরও সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ক্ষমতা এবং আওয়ামী লীগের মাঝে এখন নির্বাচন যতটা না বাধা, তারচেয়েও বড় বাধা পশ্চিমা বিশ্বেও দু-একটি দেশের মোড়লগিরি। নির্বাচনে আওয়ামী লীগেরই যে বিপুল বিজয় ঘটতে যাচ্ছে সেটা না বোঝার মত ‘বোকাস্য বোকা’ আমি নই। আওয়ামী লীগের এই নিশ্চিত বিজয়টাকে কেন্দ্র করে আমার একসাইটমেন্টটা অবশ্য একেবারেই অন্য কারনে।

বিজ্ঞাপন

আওয়ামী লীগ গত তিন তিনটি নির্বাচনে টানা বিজয়ী হয়ে পরপর টানা তিনবার সরকার গঠন করেছে, কিন্তু গত দু’বারের বিজয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসলেও দল হিসেবে হেরে গিয়েছিল আওয়ামী লীগ। কারন গত দুটি নির্বাচনে সুস্থ নির্বাচনের কোন পরিবেশই থাকতে দেয়নি বিএনপি। প্রথমবার আগুন সন্ত্রাস আর পরেরবার একেকটি আসনে একাধিক প্রার্থীর কাছে ধানের শীষ বিক্রির তামাশা এবং সবশেষে গোল পোষ্টটাকে অরক্ষিত করে রেখে তারা নিশ্চিত করতে চেয়েছিল এদেশে গনতন্ত্রের অপমৃত্যু। এতে অবশ্য অবাক হওয়ারও কিছু নেই, কারন ক্যান্টনমেন্ট থেকে ‘কিংস পাটির্’ হিসেবে জন্ম নেওয়া বিএনপির জনক প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানই এই দলটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যটি তার জীবদ্দশাতেই ব্যাখ্যা করে গিয়েছিলেন। জিয়ার বিএনপি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যই ছিল, ‘টু মেক পলিটিকস ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়ানস’। অর্থাৎ রাজনীতির বিরাজনীতিকরন আর দেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক আর গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা এবং বাংলাদেশকে আবারো পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত করাই ছিল বিএনপি এবং এর প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মুল উদ্দেশ্য, যা এই দলটি এবং এর প্রতিষ্ঠাতা তার জীবদ্দশায় এবং প্রতিষ্ঠাতার পরিবারের সদস্যরা তার মুত্যুর পর খুব সফলভাবেই বাস্তবায়ন করেছিলেন এবং এখনও সে বিষয়ে সর্বান্তকরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অতএব এরকম একটি দল যে দেশে গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাকে ব্যহত করতে এমনি ধরনের নানা পোড়ামাটিনীতি অবলম্বন করবে তাতে আর অবাক হবার কিই বা আছে? লক্ষ্যনীয় এ দেশে বিএনপি যতবারই ক্ষমতায় এসেছে কোনবারই তারা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি। ৯৬-এ ১৫ই ফেব্রুয়ারীর দল এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায় টিকে থাকার চাক্রন্ত ব্যর্থ হয়েছিল। আর তারপরের নির্বাচনটির আগে আগে বিচারপতির অবসরের বয়সসীমা বাড়িয়ে দিয়ে তাদের ক্ষমতাকে পাকাপাকিভাবে কুক্ষিগত করার চক্রান্ত শেষমেষ দেশকে ফখরুদ্দিন- মইনুদ্দিনের দুটি বছরের দুঃশাসনের পংকিলাবর্তে নিয়ে ফেলেছিল। সঙ্গত কারনেই গত দু-দুটি নির্বাচনে দেশে গনতান্ত্রিক ধারাবহিকতা অব্যাহত রাখতে গিয়ে দেশকে প্রায় পুরোপুরি আর দলকে দল আর জনগনের পরিবর্তে অনেকখানি প্রশাসন নির্ভর হতে হয়েছিল। সেই প্রেক্ষাপটের প্রেক্ষাপটে এবারের নির্বাচনের প্রেক্ষাপটটা একেবারেই ভিন্ন। এবারের নির্বাচনে পুরো দেশ এখন নির্বাচনমুখী। কোথায় কোন বিএনপি নির্বাচনে এলো না এলো না, তা নিয়ে সাধারন মানুষে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ আছে বলে আমার মনে হয় না। ধানমন্ডিতে আমার সান্ধ্যকালীন পেশার জায়গাটায় বসে আমার প্রতিদিন শতাধিক মানুষের সাথে ভাবের আদান-প্রদান হয় যার পুরোটা পুরোপুরি স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট নয়। পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক-নাগরিক সংগঠনের সাথে আমার সক্রিয় সম্পৃক্ততাও আমার জন্য দেশটাকে আর দেশের মানুষগুলোকে আরেকটু ভালভাবে বোঝায় অনেকখানি সহায়ক।

বিজ্ঞাপন

আমার বিশ্বাস আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ রেকর্ডসংখ্যাক ভোটারের টার্ন আউট দেখতে যাচ্ছে। আর এর কৃতিত্ব যদি কাউকে দিতে হয় তবে তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দুটি যুগান্তকারী নির্বাচনী সিদ্ধান্ত। এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ একাধিক মন্ত্রীসহ ৭০জন সিটিং এমপিকে মনোনয়নের বাইরে রেখেছে। একটি দলকে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে দেখলে মানুষের মধ্যে এক ধরনের এন্টি-ইনকামবেন্সি মনোভাব দেখা দেয়। অনেক সময়ই তারা কোন সুনির্দিষ্ট কারন ছাড়াই এবং কখনো কখনো না বুঝেই নেতৃত্বের পরিবর্তন খোজেন। বাঙালী এবং বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তবে এখানে যা ব্যতিক্রম তা হলো পুরো দেশ একটা জায়গায় একাট্টা আর তা হলো শেখ হাসিনার প্রতি আস্থার জায়গাটায়। তারা ক্ষেত্র বিশেষে আওয়ামী লীগের এমপিদের পরিবর্তন চাইতে পারেন, কিন্তু শেখ হাসিনার নয়। ৭০ জন সিটিং এমপিকে পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রী মানুষের সেই মনোজাগতিক চাহিদাটি পুরন করেছেন।

পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটি আরো বেশি প্রনিধানযোগ্য। অনেকেই বলতে চাচ্ছেন যে আওয়ামী লীগ তার নেতা-কর্মীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের সুযোগ করে দিয়ে একটি মারাত্মক ভূল কাজ করেছে। এতে নাকি দলীয় শৃংখলা আর চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়লো বলে। অনেকে স্বতন্ত্র সদস্যদের জোটকে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসাচ্ছেন আর কেউ কেউতো পাড়লে তাদের ক্ষমতায়ও নিয়ে আসছেন। লক্ষ্য করবেন তারাই সরব যারা নৌকা প্রতীকপ্রাপ্ত প্রার্থীদের সাথে সম্পৃক্ত বা তাদের বেনিফিশিয়ারী। ১৯৮৮ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের সাথে আমার সম্পৃক্ততা। দলটির সাথে আমার এরপর কখনোই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা ঘটেনি। কাজেই এই দলটির অনেক নেতা এবং সাংসদই আমার সুপরিচিত। আমি লক্ষ্য করছি যে সব জায়গায় আওয়ামী লীগের বা এর কোন অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠনের কোন পদবীধারী নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন তেমনি অনেক জায়গাতেই দল মনোনীত এমপি পদ প্রার্থীদের এখন ‘থর হরিকম্প’ দশা। দীর্ঘদিন এলাকায় কাজ করে অথবা একাধিকবার দলীয় প্রতীকে এমপি নির্বাচিত হয়েও শুধুমাত্র দলকে অবজ্ঞা করায় আজ তাদের এই সব হেভিওয়েট প্রার্থীদের এই ‘ত্রাহি মধুসুদন’ অবস্থা। এবারের নির্বাচনে যেই জিতুক না কেন, তা তিনি নৌকা প্রতীকের প্রার্থীই হন কিংবা চেতনায় নৌকাধারী কোন স্বতন্ত্র, এতে সত্যিকারের জয় হতে যাচ্ছে নৌকার। কারন যারা আগামীতে নৌকার কান্ডারী হবার স্বপ্নে বিভোর, তারা এযাত্রায় হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন যে নৌকায় চড়তে হলে নৌকার সমর্থনটাই সবচেয়ে বেশি জরুরী।

তবে এবার বিরোধী দলে কারা বসতে যাচ্ছেন সে প্রশ্নটি করলে আমি অতটা আশাবাদি হতে পারছি না। আমার ধারনা বাংলাদেশে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির যে মসনদটি পচাত্তরের পর থেকে বিএনপির জন্য নির্ধারিত ছিল এবার তারা তা পাকাপাকিভাবে হারাতে বসেছে, অনেকটা ৫৪-এর নির্বাচন পরবর্তী মুসলিম লীগের মত। আমি খুশি হতাম যদি এর মধ্যে দিয়ে এদেশের রাজনীতি থেকে ‘পেয়ারে পাকিস্তানীদের’ পাকাপাকিভাবে বিদায় ঘন্টাটা বাজতো। কার্যত তা হবার নয়। এই অশুভ শক্তিটি স্বাধীন বাংলাদেশে অধিকাংশ সময়ে একদিকে যেমন নামে-বেনামে ক্ষমতায় থেকে হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে কিংবা এখনও অনেক ক্ষেত্রে ক্ষমতার সুফল ভোগ করছে, তেমনি অন্য দিকে আওয়ামী লীগও একটি গনতান্ত্রিক দল বলে তারা কখনোই বিপ্লবী শক্তির মত এদের বিলুপ্তির চেষ্টা করে না। এমনকি ৭১-এ ত্রিশ লাখ মরেও না, আর ২০০১-এ ব্ল্যাক অক্টোবরের পরেও না। স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির নেতৃত্বটা আগামী নির্বাচনের পর সম্ভবত দীর্ঘ্য সময়ের জন্য জামাতের করায়ত্ব হতে যাচ্ছে। নৌকার সবচেয়ে বেশি স্বতন্ত্র যে আগামীতে সাংসদ হতে যাচ্ছেন তা নিয়ে যেমন সন্দেহ নেই, তেমনি দাড়িপাল্লার স্বতন্ত্ররাই যে এর পরপরই সর্বাধিক সংখ্যায় জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন সেটাই সম্ভবত রূঢ় বাস্তবতা। পাশাপাশি বিভিন্ন নবসৃষ্ট দল আর জোটের থেকেও থাকবে জামাতের ক্যামোফ্লেজড সাংসদ।

সব মিলিয়ে আগামী সংসদ এবং তার চরিত্রে যে বড় একটা পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে এ নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। আগামী সংসদটি আমাদের জন্য যেমন সম্ভাবনার তেমনি শংকারও। এখন প্রশ্ন হচ্ছে আমরা কিভাবে একে কাজে লাগাবো? বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত দ্বিতীয় বিপ্লবের একটি অন্যতম জায়গা ছিল দেশে এমন একটি রাষ্ট্র কাঠামো তৈরী করা যেখানে নির্বাচনে যিনি বিজয়ী হবেন তিনি যেমন হবেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের, তেমনি বিজীতও হবেন তাই-ই। যারা স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি তারা দেশে থাকলেও থাকবে ঠিকই, কিন্তু দেশের শাসন আর নীতিনির্ধারনের জায়গাগুলো থেকে তারা থাকবে শত কিলোমিটার দুরুত্বে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের রাজনৈতিক শক্তি আর সুশীল সমাজের আগামী নির্বাচনোত্তর সুবুদ্ধি আর পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ আমাদেরকে সেই জায়গাটায় নিয়ে যেতে পারে, কিন্তু যদি এর বিপরীত কিছু ঘটে তবে আগমী দ্বাদশ নির্বাচনের ফলাফলকে পুজি করে ৭১-এ পরাজিত শক্তি যদি ২০৪১-এর উন্নত বাংলাদেশে নীতি নির্ধারনি জায়গায় যাওয়ার স্বপ্ন বুনে, তবে তাতে খুব সম্ভবত অবাক হবার খুব বেশি কিছু থাকবে না।

লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এসবিডিই

অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর