দলের স্বতন্ত্রপ্রার্থী: দেশের নির্বাচনে নতুন ডাইমেনশন
২১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:০২
নির্বাচনের আমেজ দেশ জুড়ে। পুরো দেশই এখন নির্বাচনমুখী। নির্বাচনী ট্রেন ছুটছে পূর্ণ গতিতে। প্রচার প্রচরণায় মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন প্রার্থীরা। তবে এবারের নির্বাচনে নজীরবিহীন এক ঘটনা ঘটছে।
যে কোন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা হয় প্রধান প্রধান দলের মনোনীত প্রার্থীদের মধ্যে। তবে প্রতিটি নির্বাচনেই থাকেন দল নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র প্রার্থী। অনেক সময় তাদের মধ্যে থেকেও কেউ কেউ নির্বাচিত হয়ে সংসদেও যান।
তবে দলের নেতাদের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছেন এমন ঘটনা এর আগে কখনও ঘটেনি। এবার সেই অভিনব ঘটনাটিই ঘটছে। আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনা তার দলের মধ্যে আগ্রহীদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অনুমতি দেয়ায় দলের বিপুল সংখ্যক নেতা এবারের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে আওয়ামীলীগের দলীয়ভাবে মনোনীত প্রার্থীদের চেয়ে দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীর সংখ্যাই বেশী।
বর্তমানে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৪৪টি। এর মধ্যে ২৯টি দলের প্রার্থীরা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অংশগ্রহণের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেয়।
৩০০ সংসদীয় আসনে মোট ২ হাজার ৭১২টি মনোনয়নপত্র জমা পড়ে। মোট ২৯টি দল থেকে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার জন্য আবেদন করেন ১৯৬৫ প্রার্থী। বাকি ৭৪৭ জন্ স্বতন্ত্র্ হিসেবে আবেদন করেন।
শেষ পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এবার ৩০০ আসনে ১ হাজার ৮৯৬ জন প্রার্থী রয়েছেন। নতুন করে কিছু প্রার্থী আদালতের আদেশে প্রার্থিতা ফিরে পাচ্ছেন, তাদের নামও এ তালিকায় যুক্ত হবে।
মনোনয়নপত্র যাচাইবাছাই, প্রত্যাহার এবং আদালতে আপিল শেষে এসব প্রার্থী বৈধ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৮২ জন প্রার্থী স্বতন্ত্র থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
১৪ দলীয় জোটকে ৩১টি আসন ছেড়ে দিয়ে সবশেষে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী টিকেছে ২৬৩ আসনে। কিন্তু এই দলটির আরও ২৬৯ জন নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে টিকে গেছেন বাছাইয়ে। শতাধিক আসনে এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মূলত নিজ দলের নৌকার প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান ২৮ জন সংসদ সদস্য দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। জেলা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং পৌরসভার মেয়র পদ ছেড়ে স্বতন্ত্র হিসেবে লড়ছেন ৩৫ জন। তাদের বাইরেও সাবেক সংসদ সদস্য এবং স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী আরও অনেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। কোনো কোনো আসনে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। এরা ‘আওয়ামী স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হিসেবে ভোটের মাঠে পরিচিতি পাচ্ছেন।
প্রাথমিক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগের অন্তত ১১ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর জয়ের পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। তাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেয়েও স্বস্তিতে নেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া অন্তত শতাধিক আসনের প্রার্থী।
আবার আওয়ামী লীগ থেকে ছাড় পাওয়া জাতীয় পার্টির ২৬ আসনে ৮৮ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন। তাদের ৫৬ জনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ফলে জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাও স্বস্তিতে থাকতে পারছেন না। অনেকেরই ধারণা জাতীয় পার্টির অনেক প্রার্থীকেই হারিয়ে দেবেন আওয়ামীলীগের স্বতন্ত্ররা।
বিভিন্ন আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট করছেন অনেকটা ফুরফুরে মেজাজে। বিপরীতে নৌকার প্রার্থীদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ; বিশেষ করে বর্তমান সংসদ সদস্য (এমপি) যারা আবার নির্বাচন করছেন, তারা আছেন বেশ শঙ্কায়। আগে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বীতায় কিংবা শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর অবর্তমানে সহজেই সংসদ সদস্য হয়েছেন। আর সংসদ সদস্য হয়ে নিজের, স্ত্রীর, পরিবার পরিজনের সম্পদ বেড়েছে ৮ থেকে ২৫, ৪০ , ৫০ গুণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান পদ্মাসেতু, মেট্রোরেল, টানেল নিয়ে তারা উন্নয়নের গল্প বলেন। কিন্তু নিজের এলাকার কোন উন্নয়ন করেননি। তাদের পিএস এবং ঘিরে থাকা চাটুকারদের ব্যাপক উন্নতি মানুষ দেখেছে। কিন্তু এদের জন্য এলাকার মানুষের সঙ্গে, স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে স্থানীয় সংসদ সদস্যের জনবিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে।
এধরণের সাংসদদের এলাকার রাজনীতিতে নিজস্ব বলয় সৃষ্টি, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব ও দুর্ব্যবহার এবং জনবিচ্ছিন্নতাসহ বিভিন্ন বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে অনেক আসনে নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার দেয়া সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তারা এবার বঞ্চনা, অবহেলার জবাব দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই সুবিধা ঝুলিতে ভরতে বেগ পেতে হচ্ছে না স্বতন্ত্র প্রার্থীদের।
বড় দল বিএনপি নির্বাচনে না আসায় আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনা দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। উদ্দেশ্য মূলত দুটি । এক – কেউ যেন বিনা প্রতিদ্বনন্দ্বীতায় নির্বাচিত হতে না পারেন। সবাইকে যেন ভোটে লড়াই করেই জিততে হয়। আগে তিনি হুশিয়ারী দিয়েছিলেন এবারের নির্বাচন কঠিন হবে। সবাইকে লড়াই করে জিততে হবে। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ভোট কেন্দ্রে যেন ভোটার সংখ্যা বেশী হয়।
কিন্তু এই সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ধারায় নুতন মাত্রা যোগ হয়েছে। কারণ দলের মনোনয়ন সিদ্ধান্তে অনেকেই সন্তুষ্ঠ হতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে এলাকার মানুষও মনে করে মনোনয়নটি ঠিক হয়নি। যার মনোনয়ন পাওয়ার কথা সঠিক সেই ব্যক্তিকে মনোনয়ন না দিয়ে দেয়া হয়েছে অধিকাংশ মানুষ যাকে চাচ্ছে না তাকে।
সেদিন এক স্বতন্ত্র প্রার্থী তার নির্বাচনী সভায় বললেন- ‘কেন্দ্র অনেক সময় তৃণমূলের সঠিক তথ্য পায় না। যেসব রির্পোট দেয়া হয় তার অনেকটিতেই সুবিধাবাদীরা ম্যানেজ করে ফেলে। আর কানাকানি, চুপাচুপি, এদিক সেদিক করেও অনেক মনোনয়ন ম্যানেজ করে নেয়া হয়। এবার নেত্রী সেইসব কূটচাল ভন্ডুল করে দেয়ার জন্যই দলের স্বতন্ত্রপ্রার্থীদের আর্শিবাদ দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। আপনারা ৭ জানুয়ারি ভোট কেন্দ্রে আসুন। পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিন। অপছন্দের প্রার্থী হলেও দলের মার্কাতেই ভোট দিতে হবে এবার সে বাধ্যবাধকতা নাই।’
উনার কথায় বাস্তবতা আছে। নানা কারণে অনেককেই মনোনয়ন দিতে হয় দলকে। দলের বর্ষিয়ান হেভিওয়েট নেতা, দীর্ঘদিন আসনটিতে পারিবারিকভাবে কারোর অবস্থান, নানাদিক থেকে আসা রির্পোট, কেন্দ্রীয় নেতাদের রিকমেন্ডেশন, অনুরোধ ইত্যাদি কারণে অনেক সময়ই কাউকে কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু তৃণমূলে হয়ত দলের মনোনীত প্রার্থীর থেকে আরো বেশী গ্রহণযোগ্য, জনপ্রিয় প্রার্থী থাকতে পারেন। যিনি হয়ত সেভাবে দলের কেন্দ্রের মনোযোগ কাড়তে পারেন নি।
তাই আওয়ামীলীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবার নজীরবিহীন ঘটনা ঘটালেন দলের আগ্রহী নেতাদের স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনের সুযোগ দিয়ে। এতে এবারের নির্বাচনে দলের সেই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যদি নির্বাচিত হয়ে আসেন তবে সত্যিকারের জনরায়ের প্রতিফলন ঘটবে।
এবার ৩০০ আসনের মধ্যে ৭৮টি আসনে একজনও স্বতন্ত্র প্রার্থী নেই। স্বতন্ত্র প্রার্থীশূন্য ৭৮ আসনের বেশির ভাগেই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘হেভিওয়েট’ নেতারা প্রার্থীরা রয়েছেন। কিন্তু বাকি ২২২টি আসনে লড়বেন ৩৮২ স্বতন্ত্র প্রার্থী। সংবাদমাধ্যমগুলো দাবি করছে, এবার প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর সারাদেশের ৩০০ আসনের মধ্যে ১২৭ টির লড়াইয়েই আওয়ামিলীগের মনোনীত প্রার্থীকে চ্যালেঞ্জ করবেন দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
ধারণা করা হচ্ছে বিপুল সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী এবারের নির্বাচনে জিতবেন। এ নিয়ে দলের মনোনীত এবং জোটের প্রার্থীরা আশংকায় রয়েছেন। অনেকেই ধারণা করছেন আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থীদের পরই সংখ্যার দিক থেকে বেশি সিট পাবেন দলের স্বতন্ত্রপ্রার্থীরা। এর মধ্য দিয়ে দেশের গণতান্ত্রিক ধারায় নতুন ডাইমেনশন সৃষ্টি হবে।
আগামীতে হয়তো দেখা যাবে জাতীয় নির্বাচনের আগে যুক্তরাস্ট্রের মতো প্রাইমারী নির্বাচন হবে। দলের মনোনয়ন প্রার্থীরা আগে স্থানীয়ভাবে ভোটাভুটিতে মুখোমুখি হবেন। তারপর বিজয়ী নেতা জাতীয় নির্বাচনে দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করবেন অন্যদলগুলোর প্রার্থীদের সঙ্গে। সবদলই হয়তো এই ধরণের প্রাইমারী ও জাতীয় নির্বাচনে আগ্রহী হবে। এতে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে ভুলপ্রার্থী মনোনয়ন দেয়া কিংবা মনোনয়ন বাণিজ্যের যে অভিযোগ শোণা যায় তা দূরকরা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নতুন ধারার সূচনা হবে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, সংবাদ বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
দলের স্বতন্ত্রপ্রার্থী: দেশের নির্বাচনে নতুন ডাইমেনশন মত-দ্বিমত মাহমুদুল হাসান শামীম