আওয়ামী লীগের ইশতেহার: স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:৩৬
৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ২৭ ডিসেম্বর হোটেল সোনারগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের ইশতেহার ঘোষণা করেন দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। এবারের সংসদ নির্বাচনে ইশতেহারের স্লোগান দেওয়া হয়েছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ:উন্নয়ন দৃশ্যমান বাড়বে এবার কর্মসংস্থান। ’২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা আসে আওয়ামী লীগ। দেশ গঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারের স্লোগান ছিল ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ:দিন বদলের সনদ। ’২০১৪ সালে স্লোগান ছিল ‘এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।’ ২০১৮ সালে স্লোগান ছিল ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ।’ আর এবারও বিগত ইশতেহার গুলোর ধারাবাহিকতায় লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এবারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশ।’ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ অর্থাৎ ‘স্মার্ট নাগরিক’, ‘স্মার্ট সরকার’, ‘স্মার্ট অর্থনীতি’ ও ‘স্মার্ট সমাজ’ গড়ার কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ইশতেহারে সুনির্দিষ্ট ১১ টি বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে_
(১) দ্রব্যমূল্যের দাম কমানো ও সবার ক্রয়ক্ষতার মধ্যে রাখা,
(২) কর্মোপযোগী শিক্ষা ও যুবকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা,
(৩) আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা,
(৪) ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা,
(৫) লাভজনক কৃষির লক্ষ্যে সমন্বিত কৃষি ব্যবস্থা ও যান্ত্রিকীকরণ,
(৬) নিম্ন আয়ের মানুষদের স্বাস্থ্যসেবা সুলভ করা,
(৭) দৃশ্যমান অবকাঠামোর সুবিধা নিয়ে এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে শিল্পের প্রসার ঘটানো,
(৮) সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সকলকে যুক্ত করা,
(৯) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকারিতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা,
(১০) সাম্প্রদায়িকতা এবং সকল ধরণের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রোধ করা,
(১১) সর্বস্তরে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুরক্ষা ও চর্চার প্রসার ঘটানো।
এছাড়াও চলমান কার্যক্রম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় ২০২৮ সালের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭১ বিলিয়ন ডলার, মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা, জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১ শতাংশে উন্নীত করা, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১৬ শতাংশে উন্নীত, প্রবাসী আয় ১৪ শতাংশের বৃদ্ধি, ২০৩১ সালের মধ্যে হতদরিদ্রের অবসান, ২০৪১ সালের মধ্যে দারিদ্র্য ৩ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের তিনটি নির্বাচনী ইশতেহার পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিগত সময়ে আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুত ইশতেহারের অধিকাংশই অত্যন্ত সফলতার সাথে বাস্তবায়ন করেছে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করা হয়েছে। একসময় যা ছিল কল্পনার বাইরে। কিন্তু সরকার রায় কার্যকর করে জাতিকে কলঙ্ক মুক্ত করেছে।
উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিনত করা হয়েছে। সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে সারা দুনিয়া হাতের মুঠে। দেশের ১৬ কোটি মানুষের কাছে প্রায় ১৯ কোটি সিম, ১০ কোটি লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। সরকারি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নির্মাণ করা হয়েছে সংখ্যা ৮ হাজার ৯২৮ টি ওয়ানস্টপ সেন্টার, ৫২ হাজার ২শ টি সরকারি ওয়েবসাইট।
নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মান, মেট্রোরেল,বঙ্গবন্ধু ট্যানেল,বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল নির্মান, পারমাণবিক বিদ্যুৎ, পায়রা বন্দর নির্মাণ, রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ কেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্প নির্মান করে বাংলাদেশ সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছে। পদ্মা রেল সেতু প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু রেল সেতু নির্মান,দোহাজারী-রামু-কক্সবাজার ও রামু ঘুমঘুম রেলপথ নির্মাণ, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে,ঢাকা ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট ডেভেলপমেন্ট(এমআরটি), ঢাকা – চট্রগ্রাম আট লেন এবং দেশের সব মহাসড়ক চার লেনে উন্নতকরণ করা হয়েছে। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
গ্রামকে নগরের সুবিধা,নারীর ক্ষমতায়ন, লিঙ্গসমতা ও শিশুকল্যাণ, সন্ত্রাস-সাম্প্রদায়িকতা-জঙ্গিবাদ ও মাদক নির্মূল করা, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন সুদৃঢকরণ, সর্বস্তরে শিক্ষার মান বৃদ্ধি, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, ডিজিটাল প্রযুক্তির অধিকতর ব্যবহার, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, দক্ষ ও সেবামূলক জনপ্রশাসন প্রতিষ্ঠা, জনবান্ধব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গড়ে তোলা, ব্লু-ইকোনমি সমুদ্রসম্পদ উন্নয়ন, প্রবীণ ও প্রতিবন্ধী-অটিজম কল্যাণ, টেকসই ও অন্তর্ভূক্তিমূলক উন্নয়ন, ভূমি ও গৃহহীন ৮ লক্ষ ৪৭ হাজার ৭১৪ টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
১০০ টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে দেশি-বিদেশি অনেক কোম্পানি উৎপাদন শুরু করেছে। পুরো প্রকল্প চালু হলে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হবে। আগামী পাঁচ বছরে সরকার ঘোষিত দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থানে দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চল গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখবে।
গত ১৫ বছরে বদলে গেছে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক সব সূচক। প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭ দশমিক ২ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ৫৪৩ ডলার থেকে বেড়ে ২ হাজার ৭৯৩ ডলার,বাজেটের আকার ৬১ হাজার কোটি থেকে ৭ লক্ষ ৬১ হাজার কোটি,জিডিপির আকার বেড়েছে ১২ গুণ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বেড়েছে ১৩ গুণ, রপ্তানি আয় বেড়েছে ৫ গুণ, দারিদ্র্যের হার ৪১ দশমিক ৫১ শতাংশ থেকে কমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, অতি দারিদ্র্যের হার ২৫ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ স্বাক্ষরতার হার ৪৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৭৬ দশমিক ৮ শতাংশ, প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ ৫৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯৮ দশমিক ২৫ শতাংশ এবং মানুষের গড় আয়ু ৫৯ বছর থেকে বেড়ে ৭২ দশমিক ৮ বছর হয়েছে।
বর্তমান সরকারের সময়ে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল থেকে উজ্জলতর হয়েছে। বাংলাদেশকে এখন কেউ দরিদ্র দেশ হিসেবে কটাক্ষ করে না। বাংলাদেশ উদীয়মান অর্থনীতির দেশ,উন্নয়নের রোল মডেল। প্রতিবেশী ভারতের সাথে স্থলসীমান্ত চুক্তি মাধ্যমে ছিটমহল বিনিময়ের মধ্যদিয়ে দীর্ঘ ৬৮ বছরের বন্দি জীবনের অবসান ঘটেছে। ভারত ও মিয়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমার শান্তিপূর্ণ বিরোধ মীমাংসার কারণে বঙ্গোপসাগরে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার সার্বভৌমত্বের অধিকার অর্জিত হয়েছে। ১২ লক্ষ রোহিঙ্গা শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বে মানবতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশ।
দুর্নীতি সব দেশেই কমবেশি হয়। তবে বর্তমান সরকার দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে না। দুর্নীতি প্রতিরোধে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’কে স্বাধীন ক্ষমতা প্রদানের কারণে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে,তিনি যতই শক্তিশালী হোন না কেন তাকে আইনের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে দল-মত বিবেচনা করা হচ্ছে না। তারপরও দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি বলেই এবারের ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিয়ে কাজ করে বলেই জনগণ আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করে ভোট দেয়। ইশতেহার বক্তব্যের শেষাংশে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জনগণকে আবারও নৌকায় ভোট দেওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হতে যাচ্ছে দেশ। এই উত্তরণ একদিকে সম্মান অন্যদিকে চ্যালেঞ্জেরও। ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকারের এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সক্ষমতা থাকতে হবে। একমাত্র আওয়ামী লীগই পারবে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে। মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়, মাতৃভূমির স্বাধীনতা থেকে শুরু করে এদেশের যা কিছু মহৎ অর্জন, তা এসেছে আওয়ামী লীগের হাত ধরে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বাহক বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাত ধরেই ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট ‘সোনার বাংলা’ প্রতিষ্ঠিত হবে।’
আওয়ামী লীগের ইশতেহার শুধুমাত্র দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ কেমন হবে তার একটি রূপরেখা।
লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সারাবাংলা/এসবিডিই
আওয়ামী লীগের ইশতেহার: স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা তাপস হালদার মত-দ্বিমত