২০ বছর আগে মধুপুর বনে ঝরা রক্ত
৫ জানুয়ারি ২০২৪ ১৭:৪০
গহীন শাল অরণ্যে হা.বিমার মান্দিদের বসতে এককালে কোনো চু ছিল না। চু মানে মান্দিদের নিজস্ব পানীয়। নানান জাতের ধানের ভাত রেধে মান্দি বয়স্ক নারীরা নিজের ঘরেই এই চু তৈরী করেন। রাষ্ট্র কর্তৃক জুম চাষ নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত যখন হাবাহ্আু ছিল তখন মি.মিদ্দিম ধানের চু ছিল পানের জন্য সেরা। মান্দি সমাজে মেংমেংখারিরাই পয়লা চু তেরী করেছিল নিজেদের চাকে। মেংমেংখারি পোকার চাক থেকে এই চু সংগ্রহ বেশ কঠিন ছিল। মান্দিরা গহীণ বনে ঘুরে ঘুরে দেবতা ব্রারা-দুগনির ধারে সহজ ভাবে চু চাইল। তারবাদে চু তৈরী হল স্নেংনাগোড়া পোকার কানের গোড়ায়। এখান থেকেও চু সংগ্রহ করা সবসময় মান্দিদের জন্য সহজ ছিল না। তখন মান্দিরা জানতে পারল মি.মান্দি থেকে চু তৈরী করতে হয়। নানান জাতের ঔষধি লতাগুল্মের নানান অংশ দিয়ে চুমান্থি তৈরী করতে হয়। মান্দিদের ভেতর পয়লা চু তৈরী করেন গানজেং নকমা দুজংরাচ্ছা। এরবাদে এই চু পয়লা রান্দিবিমা রাই মিচ্চিকের বাড়িতে রূগালায় ব্যবহৃত হয়। দুনিয়ার পয়লা মান্দি সঙ নকমা (গ্রামপ্রধান) জারেম নকমার বাড়িতে এই চু সমাজের সবাই মিলে পান করার আয়োজন হয়। মধুপুর গড়ের বলসালব্রিং (শালবন) এর মান্দি নারীরাও সময়ের ধারাবাহিকতায় শাল জংগলের নানান লতাগুল্ম দীর্ঘ দিনের পরীক্ষা নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে এই চু তৈরীতে ব্যবহার করা শুরু করেন। তারপর কেটে যায় কত দিন কত রাত। মধুপুর শালবনে আর হাবাহুয়া (জুম আবাদ) করতে পারেন না মান্দিরা। আর মিজামে (গোলাঘর) জমা থাকে না মি.মিদ্দিম, মি.জেংগেম, মি.খচ্চু , মি.সারেংমাসহ নানান মান্দি জুম ধান।
আমেরিকার ওয়াশিংটন ডিসি শহরে অবস্থিত বিশ্বব্যাংক এর সদর দ্প্তরেই ‘সিজিআইএআর (কনসালটেটিভ গ্র“প অন ইন্টারন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল রিসার্চ) এর মূল কেন্দ্রীয় কার্যালয়। সিজিআইএআর নির্দেশে এবং পরিকল্পনায় দুনিয়ার তাবত শস্য ফসলের বীজ ও জাত চলে যায় কৃষি উন্নয়ন গবেষণায়। ফিলিপাইনের লস বানুস বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবস্থিত ‘ইরি (ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইন্সটিটিউট/আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান) বাংলাদেশসহ নানান প্রান্তের স্থানীয় ও দেশীয় ধানজাত গুলো গবেষণার নাম করে ডাকাতি করে নিয়ে যায়। এর ভেতর মি.ম্িিদ্দম, মি.সারেংমা এইসব মান্দি জুম ধানগুলোও আছে। শালবনের মান্দি গ্রামের মান্দি জুম ধান আজ শালবন এলাকায় নাই, আছে লসবানুসে ইরির বোতলের ভিতরে। ইরি এইসব মান্দি ধানের এক্সেশন নাম্বার দিয়েছে মা্িন্দদের না জানিয়ে। অথচ বাংলাদেশ জাতিসংঘের আন্তজার্তিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদ(সিবিডি ১৯৯২) স্বাক্ষর ও অনুমোদন করেছে। সিবিডিতে কোনো জনগোষ্ঠীকে না জানিয়ে তার সম্পদ ব্যবহার করা না করা বিষয়ে অনেকগুলো অনুচ্ছেদ রয়েছে। যার একটিকেও না মেনে দেশের আদিবাসীদের সব সম্পদই আজ চলে যাচ্ছে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণে। এইসব ধান হয়তোবা ইরি এতদিনে বদলে ফেলেছে। ্ বা অন্য কোন ভাবে ইরি থেকে কোনো কোম্পানী এটি প্যাটেন্ট নিয়ে একতরফা বীজের ব্যবসা করছে। ঠিক যেমন দেশের জনগনের ধান জাত থেকে তৈরী ব্রিধান-২৯ এর সবচে বড় ব্যবসা এখন সুইজারল্যান্ডের সিনজেনটা কোম্পানির।
আমরা আজকের আলাপে এখন একটি গল্প বলা শুরু করবো।
একদেশে ছিল এক শালবন। নাম তার মধুপুর। মধুপুর শালবনের আদিবাসিন্দা মান্দিরা এই এলাকার নাম দিয়েছেন হা.বিমা মানে মাতৃভূমি। আর শালবনের মান্দি নাম বলসালব্রিং। বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর উপজেলার এই শালবনের ভেতর জয়নাগাছা নামের এক মান্দি গ্রামে সাইলো স্নাল আর নেজেন নকরেকের এক পুত্র আর সব মান্দি বাচ্চা কাচ্চার সাথেই বড় হয়ে উঠে। বড় হতে হতে তার চেনা হয়ে যায় বনের ঝরে পড়া শালপাতা বা লাকড়ী বা বনআলু বা দুয়েকটা ঔষধের গাছ যাই আনা হোক না কেন তা আনতে হয় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। কারণ এই জংগল বনবিভাগ পাহাড়া দেয়। রূপকথার গল্প গুলোতে যেমন সে শুনেছে তার আচ্চু-আম্বির(দাদু-নানী) কাছে। রাক্ষসপুরীতে রাক্ষস-দেও-সকস-শয়তান পাহাড়া দেয় রাজকন্যাকে। শালবনও তেমনি যেন এক বন্দী রাজকন্যা। রাক্ষসদের কবল থেকে রাজকন্যাকে উদ্ধার করতে তারও মন চায়। তারও দি¹ি-বানদী হতে ইচ্ছে করে। তারও মাঝে মাঝে শেরানজিং হতে ইচ্ছে করে।কিন্তু দিন যায়, মাস যায়, বছরের পর বছর। বনবিভাগের বন্দুকের গুলি কমে না। এত গুলি কেনার টাকা পায় কোথায় বনবিভাগ? এর ভেতর কত কি হয়, সংরক্ষিত বনে সংরক্ষণ বাদ দিয়ে বিমানবাহিনীর ফায়ারিং ও বোম্বিং রেঞ্জ তৈরী হয়, শাল বন কেটে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের রাবার বাগান ও একাশিয়া বাগান হয়। বনবিভাগ গুলি করে হত্যা করে বিহেন নকরেককে। খুন হয় একে একে গীদিতা রেমা, অধীর দফো, নিন্তনাথ হাদিমা, সেন্টু নকরেক। সামাজিক বনায়নের নাম করে শালবন তুলে দেয়া হয় বহিরাগত বাঙালিদের কাছে।
আনারসের পর শালবন হয়ে ওঠে সর্বনাশা কলার বাগান। সিনজেন্টা, বায়ার ক্রপ সায়েন্স, এসিআইসহ কর্পোরেট কোম্পানিগুলো যারা সিজিআএআরকে আর্থিক সহযোগিতা করে এইসব কোম্পানি মধুপুর শালবন এলাকার জন্য কলার বাজারকে চূড়ান্ত করে। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত এই কলার বাগানের এক নিতান্ত সাধারন দিনমজুর হিসেবেই দিন কাটে সেই মান্দি ছেলের। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কলার বাগানে যেতে হয়, বাগানে বিষ দেয়া, সার দেয়া, কলায় হরমোন ¯েপ্র করা, কলাছড়ি কাটা, কলা ট্রাকে বোঝাই করা কত কি কাজ। সেই মান্দি ছেলে যখন পান্থি(যুবক) হয় তখন তার বিয়ে হয় সীতা নকরেকের সাথে। এখন আর মান্দি ছেলেরা নক্রম(জামাই হয়ে মেয়ের বাড়ীতে যাওয়া) হয় না। এখন যাও কিছু চু তৈরী হয় সবই ব্রিধান-২৮, ব্রি-ধান-২৯ এর ভাত থেকেই। নামা বা বাইদ জমিতে এইসব ধানের জমিনে মান্দি যুবকও অন্যদের সাথে কাজে যায়। ওইসব জমিতেও সিনজেনটার সার-বিষ আর বীজ ব্যবহৃত হয়। এরই মাঝে আবারো ২০০৩ সালে শকস-শয়তান-রাক্ষসেরা শালবন আক্রমণ করে। রাক্ষসদের সবাই জানে বনবিভাগ হিসেবেই আর আক্রমণের নাম জানা হয় ‘ইকোপার্ক’। এই প্রকল্পই ১৯৬২ সন থেকে মধুপুর জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্প হিসেবে বাস্তবায়ন করার উপুর্যপরি হামলা চালাচ্ছে বনবিভাগ। মান্দি যুবকও তার দিনমজুরীর ফাঁকে ফাঁকে মধুপুর জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্পের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ইকোপার্ক বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়। সেদিন ছিল ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি। শীতকালের শিশির কলাপাতা থেকে সিনজেন্টার বিষ খেয়ে খেয়ে মৃত শালবনের দেল্লাং(মৃতের স্মরণে নির্মিত ঘর) এ আছড়ে পড়ছিল। যেন শালবনের শিশিরের শেষ নিয়তি কর্পোরেট বিষে মৃতু্যূ। জালাবাদা, চুনিয়া, সাধুপাড়া, জয়নাগাছা, সাতারিয়া, গায়রা, রাজাবাড়ি, জলছত্র, গাছাবাড়ি, জলই, ইদিলপুর, সাইন্যামারি, টেলকী, বেদুরিয়া, ক্যাজাই, পেগামারিসহ নানান গ্রাম থেকে প্রায় দশহাজার মান্দি-কোচ বর্মণ এমনকি কিছু বাঙালিরাও জমায়েত হয় রাক্ষসদের হাত থেকে রাজকন্যাকে বাঁচাতে। জমায়েত থেকে গ্রামের মানুষ বলে, আমরা ইকোপার্ক চাই না। রাক্ষস বনবিভাগ বলে, হাউ মাউ খাউ আদিবাসীদের গন্ধ পাও।
হেলিবার্টন, রেথিয়ন কোম্পানির অস্ত্র ব্যবসার ভাগ বনবিভাগ পায় বলে বনবিভাগ ও রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী ২০০৪ সালের ৩ জানুয়ারি মধুপুর শালবনের জালাবাদা রাজঘাট এলাকায় সশস্ত্র হামলা করে ইকোপার্কবিরোধী আদিবাসীদের মিছিলে। কর্পোরেট অস্ত্র ব্যবসার হাত থেকে শালবন বাঁচাতে রাষ্ট্রের গুলিতে শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায় বেদুরিয়া গ্রামের আরেক মান্দি কিশোর উৎপল নকরেকের। আর সেই মান্দি যুবক রাক্ষসদের হাত থেকে রাজকন্যাকে বাঁচাতে নিজের বুক ও কলিজা পেতে দেয়। গল্পটির এইজায়গাখানিই রূপকথার গল্পের সাথে দারুন অমিল। মান্দি যুবকের সাথে আর মিলন হয় না রাজকন্যার। রাক্ষস বনবিভাগের হাতে বন্দী বলসাল রাজকন্যা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ বহুজাতিক উন্নয়ন রাক্ষসরা আগেই রাজকন্যার মা বাবা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীকে খেয়েফেলেছিল । বাকী আছে কেবল রাজকন্যার একটুকরা শালের শরীর। রাজকন্যাকেও বনবিভাগ বন্দুক আর বনআইন দিয়ে বেহুস করে রাখে সারাদিন। বনবিভাগ রাজকন্যার ৩০০০ একর কোর এলাকাকে দেয়াল দিয়ে ঘিরে ইকোপার্ক বানাতে চায়। মান্দি যুবক ত্ইা অন্যদের সাথে রাজকন্যাকে বাঁচাতে জীবন দিয়ে দেয়। যুবককে খুন করে বনবিভাগ আবার যুবককেই আসামী করে টাঙ্গাইল কোর্টে তার নামে মামলা করে। যুবকের মাসুম বাচ্চা রাত্রি নকরেক আর উৎস নকরেক তারা এখনও জানেনা তাদের বাবা কেন আসে না? উৎস-রাত্রির মা সীতা নকরেক জানে জংগলে এমন হরহামেশাই হয়। মান্দি নারীদের গন্তব্য তার জানা হয়ে গেছে। ফরেস্টের লাত্থি গুতা বন্দুকের গুলি খেয়ে জ্বালানির জন্য কিছু লাকড়ী বা বনআলু সংগ্রহ, কলার বাগানের মজুর, মিশনে ফরমাইশ, শহরে কাজের মেয়ে আর খুব ভালো কপাল হলে ঢাকা শহরের বিউটি পার্লার।
গল্পটি আমাদের শেষ হচ্ছে না।
এই গল্পের মান্দি যুবকের নামই পীরেন স্নাল। পৃথিবীর ইতিহাসে ইকোপার্কবিরোধী আন্দোলনের পয়লা শহীদ। এই গল্পের একটা স্থিতিশীল পরিণতি হতে পারে যদি রাষ্ট্র মধুপুর জাতীয় উদ্যান উন্নয়ন প্রকল্প মানে ইকোপার্ক প্রকল্পের মতো প্রাণ ও প্রতিবেশবিনাশী উন্নয়ন-বাহাদুরি গুলো আর তৈরি না করে। যদি বনপ্রতিবেশ সংরক্ষণের দায়দায়িত্ব বননির্ভর জনগণের কাছে থাকে, যদি উপনিবেশিক বনআইন বাতিল হয়, যদি কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত কলাসহ বাজারি ফসলের চাষ না হয়। আর এইগুলোই হল আজকে রাক্ষসের হাত থেকে বন্দী রাজকন্যাকে বাঁচানোর একমাত্র কায়দা। পীরেন স্নাল হত্যার পর বনবিভাগ গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয় সাতারিয়া গ্রামের শিশিলিয়া স্নালকে। এসব গল্প ও কহিনির কোনো শেষ হয় না। দীর্ঘ ২০ বছরেও পীরেন ¯œাল হত্যার কোনো তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে না পারা রাষ্ট্রের চরম ব্যর্থতা। আমরা রাষ্ট্রকে ব্যর্থ আর দায়িত্বহীন হিসেবে দেখতে চাই না। পীরেন ¯œালস মধুপুর শালবনের সকল আদিবাসী খুন-জখম-দখলের ন্যায়বিচারের জোর দাবি আবারো জানাই।
লেখক: গবেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই